গোয়েন্দা গল্প : প্রথম রহস্যের সমাধান

জলপাইগুড়ি শহর—এক চিলতে ছোট্ট শহর, যেখানে সকালবেলা স্নিগ্ধতা মাখা রোদ আর বিকেলের শীতল হাওয়া মিলে অনন্য পরিবেশ তৈরি করে। এই শহরকে অনেকে ভালোবেসে বলে ‘জল শহর’। শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে করলা নদী, যার সবুজ জলের কোলাহল শহরের প্রতিটা মানুষকে একসময় আকর্ষণ করত। তবে এখন সেই গৌরব আর আগের মতো নেই। তবুও, জলপাইগুড়ির প্রতিটি প্রাচীন বাড়ি, পথঘাট, আর স্নিগ্ধ প্রকৃতি যেন হাজারো গল্প বলে।

এই শহরেই বাস করে ইধিকা সেন, বাবা দেবাশিস সেন আর মা সোনালী সেনের সঙ্গে। দেবাশিসবাবু পেশায় একজন পুলিশ অফিসার, আর সোনালী সেন একজন গৃহিণী। ইধিকার স্বভাব ছোটবেলা থেকেই অন্যরকম। ইধিকা যখন সবে দশ বছর বয়সে পা দিল, তখন থেকেই তার ভেতরে রহস্য সমাধানের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। বাড়িতে সারি সারি গোয়েন্দা গল্পের বই— ফেলুদা, ব্যোমকেশ বক্সী, কিরীটি রায়, শার্লক হোমস— সবই পড়ে ফেলে। ওর স্বপ্ন, বড় হয়ে সে হবে দেশের সেরা মহিলা গোয়েন্দা।

ইধিকা এখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। তার দু’জন প্রিয় বন্ধু, পায়েল আর অনুরাগ, দুজনেই একই ক্লাসে পড়ে। তারা তিনজন মিলে এর আগে স্কুলের হারানো ডায়েরি, পাড়ার চুরি যাওয়া সাইকেল, এমন ছোটখাটো রহস্য সমাধান করেছে। তবে, বড় কোনো রহস্যের সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ আজও আসেনি।

একদিন সকালবেলা, ইধিকা তার পড়ার টেবিলে বসে ইংরেজির একটা পাঠ পড়ছিল। এমন সময় মোবাইলের রিং বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল বাবার অফিসের নাম্বার। দেবাশিসবাবুর মুখে চিন্তার ছাপ, তিনি ফোন রেখে ইধিকার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ইধি, তোমার একটু সাহায্য দরকার।”

ইধিকার মনে কৌতূহল জেগে উঠল। বাবা তাকে কোনো তদন্তে সাহায্য করতে ডাকছেন? এটা যেন স্বপ্নের মতো শোনাচ্ছে। সে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে, বাবা? আমি কী করতে পারি?”

দেবাশিসবাবু বললেন, “শহরের বিখ্যাত ব্যবসায়ী মিস্টার সেনগুপ্তের মেয়ে মেঘনা গতকাল থেকে নিখোঁজ। পুলিশ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এখনো কোনো সূত্র পায়নি। আমি চাই, তুমি একটু খতিয়ে দেখো। তোমার চোখ হয়তো এমন কিছু দেখতে পাবে, যা আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে।”

ইধিকার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। এত বড় একটা রহস্য! মনের মধ্যে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও তার চোখেমুখে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাব ফুটে উঠল। সে বলল, “আমি চেষ্টা করব, বাবা। তবে আমি পায়েল আর অনুরাগকে নিয়েই যাব। ওরা আমার দলে থাকলে কাজটা সহজ হবে।”

দেবাশিসবাবু মুচকি হেসে বললেন, “ঠিক আছে, ওদেরও নিয়ে নাও। কিন্তু সাবধান! কোনো ভুল কোরো না। আমরা তোমাদের সবসময় সহায়তা করব।”

পায়েল আর অনুরাগকে ফোন করে সব জানিয়ে, ইধিকা তার বাবার সঙ্গে মেঘনার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। মেঘনার বাবা-মা খুবই চিন্তিত ছিলেন। মেঘনার মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমাদের মেঘনা খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে। কোথাও একা যায় না। স্কুল থেকে ফিরে সারাদিন বাড়িতেই থাকে। কীভাবে এমনটা হল, কিছুই বুঝতে পারছি না।”

ইধিকা চারপাশটা ভালো করে খেয়াল করল। বাড়ির সবক’টি দরজা, জানালা সুরক্ষিত, চারদিকে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। কিন্তু রহস্য হল, মেঘনার নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন থেকে নাকি ক্যামেরাগুলো কাজ করছে না। এটা কি নিতান্তই কাকতালীয়, নাকি পরিকল্পিতভাবে এমনটা করা হয়েছে? ইধিকা মনে মনে ভাবল, “এই ক্যামেরাগুলো কাজ না করার পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। মেঘনাকে কেউ খুব ভালো করেই চিনত।”

মেঘনার ঘরে ঢুকে ইধিকা তার জিনিসপত্র দেখতে লাগল। পড়ার টেবিলের ওপর কিছু বই, ডায়েরি আর মোবাইল ফোন। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ইধিকা স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে দেখল, মেঘনার শেষ কথোপকথন হয়েছে একটা অচেনা নম্বরের সঙ্গে। মেসেজে শুধু লেখা ছিল: “বাগানের পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে এসো। আমি অপেক্ষা করছি।”

ইধিকার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বাবার দিকে ফিরে বলল, “বাগানের পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়েছিল ও, সিসিটিভির ক্যামেরাগুলো কাজ না করার সুযোগ নিয়ে। কিন্তু কার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল?”

দেবাশিসবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “এই প্রশ্নের উত্তরই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।”

এরপর, ইধিকা, পায়েল আর অনুরাগ মিলে মেঘনার স্কুলে গেল। সেখানে মেঘনার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে তারা জানতে পারল, মেঘনার একটা নতুন বন্ধু হয়েছে, যে স্কুলে পড়ে না। মেঘনা তাকে নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিল, তবে কখনো তার নাম বলেনি। শুধু বলত, “সে খুবই ভালো একজন, আমার জন্য সবকিছু করতে পারে।”

পায়েল বলল, “কিন্তু সেই ভালো মানুষটা কি সত্যিই ভালো?”

ইধিকার মনে একাধিক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। এরপর তারা মেঘনার বাড়ির পাশের বাগানে গিয়ে দেখল। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় বাগানের মাটি নরম। সেখানে তারা কিছু অদ্ভুত চিহ্ন দেখতে পেল, যেমন — পায়ের ছাপ, একটা ছেঁড়া রুমাল, আর মাটিতে কিছু টায়ারের দাগ। নরম মাটিতে দাগগুলো ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। ইধিকা মনোযোগ দিয়ে চিহ্নগুলো পর্যবেক্ষণ করল। “এটা নিশ্চিত, মেঘনাকে জোর করে গাড়িতে তোলা হয়েছে। টায়ারের দাগ দেখে মনে হচ্ছে, সেটি একটা ভ্যান ছিল।”

অনুরাগ বলল, “আমাদের কি সেই ভ্যান খুঁজতে হবে?”

ইধিকা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, তবে আগে আমাদের বুঝতে হবে, মেঘনাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।”

তারা টায়ারের ছাপ অনুসরণ করে করলা নদীর পাশের একটা পুরোনো, ভাঙাচোরা বাড়ির কাছে গিয়ে উপস্থিত হল। একসময় বাড়িটা শহরের ধনী পরিবারের বাসভবন ছিল, কিন্তু এখন সেটা ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। পায়েল ভয়ে বলল, “তুমি কি নিশ্চিত, ইধি? এখানে তো অনেক ভুতুড়ে গল্প শোনা যায়।”

ইধিকা হেসে বলল, “ভুতুড়ে গল্পগুলো হয়তো মানুষকেই ভয় দেখায়, কিন্তু আমরা যদি সাহসের সঙ্গে এগোই, তবে কোনো রহস্যই সমাধান করা অসম্ভব নয়।”

তারা আস্তে আস্তে বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। ইধিকার চোখে পড়ল, বাড়ির জানালার পাশে একটা ছোটো আলো জ্বলছে। ভেতরে ঢুকতে গিয়ে তারা শুনতে পেল, কোনো একটা ঘর থেকে কারও কান্নার আওয়াজ আসছে। ইধিকা দ্রুত জানালার কাছে গিয়ে দেখল, মেঘনাকে একটা ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। মেঘনার মুখ বেঁধে রাখা, চোখে আতঙ্ক।

ইধিকা ফোন বের করে বাবাকে কল করল। “বাবা, আমরা মেঘনাকে খুঁজে পেয়েছি। সে একটা পুরানো বাড়ির ভেতর আটকানো আছে। কিন্তু তোমাদের আসতে হবে, কারণ বাড়ির ভেতরে আরও কয়েকজন লোক আছে।”

দেবাশিসবাবু তৎক্ষণাৎ পুলিশের একটা দল নিয়ে সেখানে পৌঁছালেন। বাড়িটা ঘিরে ফেলা হল, এবং ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে ঢুকল পুলিশ দল। ইধিকা আর তার বন্ধুরা বাড়ির পেছনে গিয়ে দেখল, একজন লোক চুপিচুপি পালানোর চেষ্টা করছে। ইধিকা দ্রুত তার পিছু নিল।

পায়েল চিৎকার করে বলল, “ইধি, সাবধান!”

ইধিকা থামল না। লোকটা বুঝতে পারল, কেউ তাকে অনুসরণ করছে। সে দৌড়াতে শুরু করল। ইধিকা, পায়েল, আর অনুরাগ তার পিছু নিল। কিন্তু লোকটা খুবই চতুর, সে একটা ঝোপের ভেতর ঢুকে পড়ল।

“আমাদের এখনই লোকটাকে ধরতে হবে, না হলে হয়তো মেঘনাকে কেন অপহরণ করা হয়েছে, তার কারণটাই অজানাই থেকে যাবে,” ইধিকা ফিসফিস করে বলল।

অনুরাগ হঠাৎ একটা পাথর তুলে নিয়ে লোকটার দিকে ছুঁড়ে মারল। পাথরটা লোকটার পায়ে লেগে সে পড়ে গেল। ইধিকা দেরি না করে তার কাছে ছুটে গিয়ে তার হাতে ধরা মোবাইলটা কেড়ে নিল। লোকটা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে পালাতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু পুলিশ এসে তাকে ধরে ফেলল।

লোকটাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হল। ইধিকা মেঘনাকে ছাড়িয়ে আনতে তার বাবার কাছে গেল। মেঘনা খুব ভয়ে ছিল, তবে ইধিকাকে দেখে যেন একটু স্বস্তি পেল। সে বলল, “তুমি আমাকে বাঁচালে। আমি ভেবেছিলাম, কেউ আমাকে খুঁজেই পাবে না।”

ইধিকা মেঘনার দিকে মৃদু হেসে বলল, “আমি বলেছিলাম না, রহস্য যতই জটিল হোক, আমরা তার সমাধান করবই।”

পুলিশ যখন ধৃত লোকটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করল, সে প্রথমে কিছুই বলছিল না। তবে কিছুক্ষণ পর যখন দেবাশিসবাবু তাকে কড়া ভাষায় জেরা শুরু করলেন, তখন সে সবকিছু খুলে বলল। সে একজন পেশাদার অপহরণকারী। তাকে কেউ একজন ভাড়া করেছিল মেঘনাকে অপহরণ করার জন্য। মেঘনার বাবা ছিলেন জলপাইগুড়ির এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। তার কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ী চেয়েছিল, মেঘনার বাবাকে চাপ দিয়ে কিছু ব্যবসায়িক সুবিধা আদায় করতে। তাই তারা মেঘনাকে অপহরণ করানোর পরিকল্পনা করেছিল।

ইধিকা সেই অজানা নম্বর থেকে পাঠানো মেসেজ আর লোকটার মোবাইলের তথ্য খতিয়ে দেখে জানতে পারল, মেঘনার বাবার এক ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী বন্ধু, মিস্টার রায়, এর পেছনে ছিল। মেঘনার বাবার বিশ্বাস অর্জন করে সে ব্যবসায়িক তথ্য হাতিয়ে নিত, এবং তার অপহরণের পরিকল্পনা করেছিল।

পুলিশ মিস্টার রায়কে গ্রেফতার করল। ইধিকার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ আর বুদ্ধিমত্তার জন্যই এত বড় একটা রহস্যের সমাধান হল। মেঘনার পরিবার আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরল। মেঘনা ইধিকাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, “তুমি সত্যিই অসাধারণ। তোমার মতো বন্ধুর জন্য আমি কৃতজ্ঞ।”

ইধিকা মৃদু হাসল। সে বলল, “এটা তো আমার কাজের শুরু মাত্র। আমি দেশের সেরা মহিলা গোয়েন্দা হতে চাই। এটা আমার প্রথম রহস্য, কিন্তু শেষ নয়।”

পায়েল আর অনুরাগ তাকে ঘিরে ধরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল। পায়েল বলল, “তুমি অসাধারণ, ইধি! আমি জানতাম, তুমি পারবে।”

তাদের কিশোর গোয়েন্দা দলটাকে দেখে দেবাশিসবাবুও গর্বে মুচকি হাসলেন। তিনি বললেন, “এগিয়ে চলো, ইধিকা। তোমার সামনে অনেক রহস্য অপেক্ষা করছে। মনে রাখবে, সাহস আর সততার সঙ্গে যদি এগোও, তাহলে কোনো বাধাই তোমাকে থামাতে পারবে না।”

এভাবেই ইধিকার প্রথম রহস্য সমাধান হল, এবং তার কিশোর গোয়েন্দা জীবনের সূচনা ঘটল। শহরের মানুষজন তাকে নিয়ে গর্বিত, আর ইধিকা নিজেও আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। কারণ, সে জানে, প্রতিটি রহস্যের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সত্য। আর সত্যকে খুঁজে বের করাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।

ইধিকার প্রথম রহস্যের সমাপ্তি।

© পিনাকী রঞ্জন পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *