গোয়েন্দা গল্প : নায়েক ভিলার রহস্য

লেখক : পিনাকী রঞ্জন পাল

জলপাইগুড়ি শহরটা দিনের বেলায় কেমন হইচই আর লোকজনের ভিড়ে মুখরিত থাকে, কিন্তু রাতের বেলায় সবকিছু যেন চুপ করে যায়। বিশেষ করে এক কোণে থাকা পুরনো নায়েক ভিলার কথা উঠলেই শহরের লোকেরা ভয়ে একটু কেঁপে ওঠে। কেউ বলে ওটা ভুতুড়ে বাড়ি, আবার কেউ বলে ওখানে অমাবস্যার রাতে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে।

কিন্তু ইধিকা এসব কথায় বিশ্বাস করত না। ইধিকার সাথে নিশ্চয় এতদিনে তোমাদেরবপরিচয় হয়ে গেছে। ইধিকা সেন, জলপাইগুড়ির এক সাহসী মেয়ে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়লেও ওর বুদ্ধি আর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। ওর আর একটি পরিচয় হল ও হল জলপাইগুড়ির প্রথম মহিলা গোয়েন্দা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি রহস্যের সমাধান করেছে ইধিকা। পায়েল আর অনুরাগ—ওর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ইধিকার সঙ্গে সব রহস্য উদঘাটনের সঙ্গী।

আরো পড়ুন : গোয়েন্দা গল্প : অষ্টধাতুর মূর্তি চুরি

একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে পায়েল বলল, “ইধিকা, তুই শুনেছিস তো? কাল রাতে নায়েক ভিলায় আবার কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। শহরের লোকজন এখন আরো বেশি ভয় পাচ্ছে।”

ইধিকা হেসে বলল, “ভয় পেয়ে লাভ নেই পায়েল, রহস্যের সমাধান তো আমরাই বের করব!”

অনুরাগ যোগ করল, “হ্যাঁ, আমরা এতদিনে অনেক ছোট-বড় রহস্য সমাধান করেছি। এবার নায়েক ভিলার পালা।”

সিদ্ধান্ত হলো, তারা তিনজন ওই রাতেই নায়েক ভিলায় যাবে। বিকেলের আলো একটু ম্লান হতে শুরু করতেই তারা একত্রিত হলো। পায়েল সবসময় একটু চিন্তিত থাকলেও ইধিকার দৃঢ় বিশ্বাস দেখে সাহস ফিরে পায়। অনুরাগ, সবসময়ই ইধিকার প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করত।

সন্ধ্যা একটু ঘনিয়ে এলে তারা তিনজন মশাল আর একটি বড় টর্চ নিয়ে রওনা দিল নায়েক ভিলার দিকে। বাড়িটা বেশ পুরনো আর পরিত্যক্ত ছিল। চারদিকে কাঁটাঝোপ আর শিলিখায় ঢাকা দেয়াল। সামনের দরজা ছিল সাদা রংয়ের, তবে তার অনেকটা অংশ ক্ষয়ে গিয়েছিল। বাড়িটির ভেতরে ঢুকতেই তাদের চারপাশে অদ্ভুত এক নীরবতা ঘিরে ধরল। ঘরের দেয়ালগুলোতে ধুলো জমে ছিল, মাকড়সার জাল ছড়িয়ে পড়েছিল কোণায় কোণায়। মেঝেতে পা রাখতেই মৃদু কটকট শব্দ হচ্ছিল, যেন অনেক বছর ধরে কেউ এই বাড়িতে পা রাখেনি।

তারা সাবধানে হাঁটতে শুরু করল। ইধিকা সামনে, পায়েল আর অনুরাগ পেছনে। পায়েলের কাঁধে একটা ছোট্ট ব্যাগ ছিল, যেখানে ছিল টর্চলাইট, কয়েকটা খাবারের প্যাকেট আর জলের বোতল।

তারা একটি বড় ঘরের সামনে পৌঁছল। ইধিকা বলল, “এই ঘরটা বেশ অদ্ভুত। দারোয়ান কাকা বলেছিল এখানে কিছু লুকানো থাকতে পারে। সাবধানে থাকো।”

তারা ঘরটি তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করল। হঠাৎ পায়েল একটি পুরনো বইয়ের আলমারির পেছনে একটি ছোট্ট দরজা দেখতে পেল। “ইধিকা! দেখ, এখানে একটা গোপন দরজা আছে!” পায়েল চিৎকার করে উঠল।

ইধিকা দ্রুত সেখানে গেল। দরজাটি ছোট হলেও যথেষ্ট মজবুত ছিল। অনেক কষ্টে দরজাটি খুলে তারা তিনজন ঢুকে পড়ল। দরজার পেছনে ছিল একটি সরু করিডোর, যার শেষে দেখা যাচ্ছিল একটি অন্ধকার সিঁড়ি।

“এতদিনে আমরা হয়তো রহস্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি,” অনুরাগ উত্তেজিত হয়ে বলল।

তারা ধীরে ধীরে সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। সিঁড়ির শেষে একটি বড় ঘর, যেখানে বেশ কয়েকটি পুরনো বাক্স সারিবদ্ধভাবে রাখা ছিল। বাক্সগুলোতে তালা লাগানো ছিল, কিন্তু সেগুলো খুব দুর্বল ছিল। ইধিকা বলল, “এগুলোতে কিছু মূল্যবান জিনিস লুকানো থাকতে পারে। একবার দেখি।”

তারা বাক্সগুলো খুলে ভেতরে দেখতে পেল অনেক টাকা, গয়না আর অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী। অনুরাগ বিস্মিত হয়ে বলল, “তাহলে এই ভিলা ভুতুড়ে নয়! চোরদের আস্তানা।”

ইধিকা মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক বলেছিস অনুরাগ। এই চোরের দলই হয়তো ভিলার ভুতুড়ে গল্প ছড়িয়ে এখানে লুকিয়ে রেখেছে চুরি করা জিনিসগুলো।”

তারা বুঝতে পারল যে, এই চোরেরা দীর্ঘদিন ধরে আশেপাশের এলাকা থেকে জিনিস চুরি করে এখানে এনে লুকাত। লোকজনকে ভয় দেখানোর জন্যই তারা ভুতুড়ে গল্প ছড়িয়েছিল।

ইধিকা সিদ্ধান্ত নিল, “আমাদের দ্রুত পুলিশকে খবর দিতে হবে।” পায়েল মোবাইল বের করে পুলিশকে ফোন করল। পুলিশ আসতে কিছুটা সময় লাগবে, তাই তারা বাক্সগুলো নিয়ে পালানোর আগেই চোরদের আটকানোর একটা উপায় ভাবতে লাগল।

তারা তখনো বাড়িটির ভেতরে, যখন হঠাৎ করে বাইরে থেকে পদশব্দ শোনা গেল। ইধিকা দ্রুত বাক্সগুলোর আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। “পায়েল, অনুরাগ, চুপচাপ থাকো। ওরা বুঝতে পারলে আমাদের বিপদে ফেলবে,” ইধিকা সাবধান করল।

দেখা গেল তিনজন লোক ভিতরে ঢুকেছে। তাদের মুখে মুখোশ, হাতে টর্চলাইট। তারা বাক্সগুলো চেক করতে আসছিল, ঠিক তখনই ইধিকার ফোনে পুলিশের ফোন আসল। ফোনের রিংটোন শুনে চোরেরা চমকে উঠল। একজন বলল, “কেউ আছে এখানে!”

ইধিকা এক সেকেন্ডের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়লেও দ্রুত সাহস জুগিয়ে, পায়েলকে নির্দেশ দিল, “চুপচাপ লুকিয়ে থাকো। আমি বাইরে যাচ্ছি ওদের বিভ্রান্ত করতে।”

ইধিকা দ্রুত একটা পুরনো পর্দা ধরে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। চোরেরা তাকে তাড়াতে শুরু করল। এই সুযোগে পায়েল আর অনুরাগ অন্যদিক দিয়ে পালিয়ে গিয়ে দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল।

পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ শোনা যাচ্ছিল এবং মুহূর্তের মধ্যেই পুলিশ এসে পৌঁছল। ইধিকা পুলিশকে পুরো ঘটনা জানাল। পুলিশ বাড়িতে ঢুকে চোরদের ধরে ফেলল। পুরো শহরজুড়ে ইধিকা, পায়েল আর অনুরাগের বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা হলো।

এইভাবে, নায়েক ভিলার রহস্য উদঘাটিত হলো। ভুতুড়ে গল্পগুলো নিছক চোরদের তৈরি করা ছিল, আর ইধিকা ও তার বন্ধুরা শুধু রহস্য সমাধান করল না, তারা জলপাইগুড়িকে চোরদের হাত থেকে রক্ষা করল।

শহরের মানুষ তাদেরকে হিরো বলে সম্বোধন করল এবং ইধিকার দল আবারও প্রমাণ করল যে সাহস আর বুদ্ধিমত্তা থাকলে কোনো রহস্যই অত বড় নয় যা সমাধান করা যায় না।

© পিনাকী রঞ্জন পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *