গোয়েন্দা গল্প : রাতের আড়ালে (ভিডিও সহ)

পিনাকী রঞ্জন পাল

কলকাতা—একটা রহস্যময় শহর, যেখানে রাত গভীর হলেই ছায়ারা দীর্ঘ হয়, আর বাতাসে মিশে থাকে ইতিহাসের চাপা দীর্ঘশ্বাস। রাত তখন সাড়ে দশটা। দিনের ব্যস্ততা মিলিয়ে গেছে, শুধু ফেলে গেছে কিছু অন্ধকার গলি আর ফিসফিস করা বাতাসের শব্দ।

শহরের প্রাণকেন্দ্রে এখনো কিছু জায়গায় চায়ের দোকান খোলা, সেখানে ক্লান্ত কিছু মানুষ শেষ রাতের কাপে চুমুক দিচ্ছে। ট্যাক্সিগুলো অলস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, যেন তারাও বিশ্রামের অপেক্ষায়। কিন্তু গলি নম্বর সাতের চিত্রটা একেবারে আলাদা।

আরো পড়ুন : গোয়েন্দা গল্প : অপহৃত জাদুকর ও ইধিকার রহস্যভেদ

আমি, গৌতম মিত্র, একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ, দাঁড়িয়ে আছি সেই গলির মোড়ে। অভ্যাসবশত চারপাশটা গভীরভাবে খেয়াল করলাম। জায়গাটা বেশ পুরনো, যেন কলকাতার বহু বছরের ইতিহাস নিজের গায়ে মেখে রেখেছে।

আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটা রহস্যময়—ধূলিধূসরিত দেয়াল, জানালার ফাঁকে জড়ানো মাকড়সার জাল, আর দরজায় ঠেকে থাকা সময়ের ক্লান্তি। মনে হচ্ছে, বহুদিন কেউ এখানে পা রাখেনি, অথচ হালকা বাতাসের সাথে যেন এক অদ্ভুত গোপন কাহিনি ফিসফিস করে আমার কানে ভেসে আসছে।

বাড়িটার দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। এটা শুধুই পুরনো বাড়ি নয়—এখানে কিছু একটা লুকিয়ে আছে। হয়তো সময়ের অতলে হারিয়ে যাওয়া কোনো রহস্য, বা এমন কিছু যা রাতের আঁধারেই বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে।

আমার মনের কোণে তখনো উঁকি দিচ্ছিল আজ সকালবেলা আমার অফিসে আসা এক মহিলার মুখ।

আরো পড়ুন : গোয়েন্দা গল্প : ব্যাঙ্কের নথি চুরির রহস্যের সমাধান

একটি আতঙ্কিত মুখ
——–——————–

আমার অফিস, শহরের এক কোণায় ছোট্ট কিন্তু পরিপাটি। সকাল তখন সবে ফুরোচ্ছে। কলকাতার আকাশ মেঘলা, যেন দিনের শুরুতেই রহস্যের ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে। আমি আমার অফিসে বসে নোটবুকের পাতায় পুরনো কেসগুলোর খসড়া মিলিয়ে দেখছিলাম, এমন সময় দরজায় তিনবার টোকা পড়ল।

“মিস্টার মিত্র, আমি কি ভেতরে আসতে পারি?”

স্বরটা ছিল চাপা, কিন্তু স্পষ্ট। আমি দরজা খুলতেই দেখলাম এক মধ্যবয়সী অভিজাত মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। পরিপাটি শাড়ি, উজ্জ্বল চোখ, কিন্তু সেই চোখে লুকিয়ে থাকা আতঙ্ক সহজেই ধরা পড়ে।

“আসুন,” আমি বললাম, এবং তাকে বসার ইঙ্গিত দিলাম।

তিনি চেয়ারটায় বসলেন, কিন্তু তার আঙুলের টানটান ভঙ্গি বুঝিয়ে দিচ্ছিল, তিনি প্রবল মানসিক চাপের মধ্যে আছেন।

“আমি অনুরাধা সেন। আমার স্বামী, অনিরুদ্ধ সেন, তিন দিন ধরে নিখোঁজ।”

আমি নোটবুক বের করে লিখতে শুরু করলাম।

“নিখোঁজ মানে? তিনি কোথায় গিয়েছিলেন?”

মিসেস সেন একটু ইতস্তত করলেন, তারপর বললেন, “তিনি একজন ব্যবসায়ী। বেশ ব্যস্ত থাকেন, প্রায়ই কাজে বাইরে যান, কিন্তু কখনো এভাবে কোনো খবর না দিয়ে উধাও হননি।”

“তিনি শেষ কোথায় গিয়েছিলেন, আপনি জানেন?”

তিনি ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, “তিন দিন আগে, সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে বেরোনোর সময় আমায় ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আজ একটু দেরি হবে, তুমি খাবার খেয়ে নিও।’ এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ নেই।”

আমি একটু ভেবে বললাম, “আপনি পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ, কিন্তু পুলিশ বলল, হয়তো কাজের কারণে কোথাও গেছেন, ফিরে আসবেন। তবে গতকাল রাতে আমি একটা ফোন পাই…”

এই প্রথমবার তার গলায় সত্যিকারের আতঙ্ক ফুটে উঠল।

“ফোনে কে ছিল?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

তিনি এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন, যেন স্মৃতিগুলোকে ঠিকভাবে সাজিয়ে নিতে চাইছেন। তারপর বললেন, “সেই কণ্ঠ… আমি কোনোদিনও এমন কণ্ঠ শুনিনি। একেবারে ঠান্ডা, অনুভূতিহীন। যেন একটা যন্ত্র কথা বলছে।”

“কী বলল?”

“বলল— ‘তিনি আমাদের সাথে আছেন। যদি তাকে ফিরে পেতে চান, তবে কাল রাত এগারোটায় গলি নম্বর সাতের বাড়িতে আসুন।’”

তার কণ্ঠ কাঁপছিল, হাত দুটো আঁকড়ে ধরে বসে ছিলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম, এটা শুধুই ভয় নয়, এর পেছনে আরও কিছু আছে।

“ফোন নম্বরটা কী ছিল?”

“অজানা নম্বর। কল ব্যাক করতে গিয়েও পারিনি।”

আমি একটু চুপ করে থাকলাম। অভিজ্ঞতা বলে, সাধারণ অপহরণকারীরা কখনো এতটা নির্লিপ্তভাবে কথা বলে না। টাকা দাবি করে, ভয় দেখায়। কিন্তু এখানে তেমন কিছু নেই। শুধু একটা নির্দেশ—রাত এগারোটায় সেই বাড়িতে যেতে হবে।

“আপনার স্বামীর কি কোন শত্রু ছিল? বা ব্যবসায় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী?”

তিনি মাথা নাড়লেন, “শত্রু তো থাকবেই, ব্যবসা মানেই প্রতিযোগিতা। কিন্তু এমন কিছু নয় যাতে কেউ তাকে অপহরণ করবে।”

আমি কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললাম, “মিসেস সেন, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি এই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখব।”

তিনি কৃতজ্ঞ চোখে তাকালেন, কিন্তু সেই চোখের গভীরে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম—একটা ভয়, একটা অজানা আশঙ্কা, যেন তিনি নিজেও জানেন না, এই রহস্যের শেষ কোথায় যাবে।

আমি জানতাম, এটা শুধুই একটা নিখোঁজ হওয়া মানুষের কেস নয়। এর পেছনে কিছু অদ্ভুত, কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা জড়িত।

গলি নম্বর সাতের সেই পুরনো বাড়ির কথা মাথায় রেখে, আমি ঠিক করলাম, আজ রাত এগারোটায় আমি ওখানে যাব।

কিন্তু আমার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—ফোনের অপর প্রান্তে থাকা সেই ঠান্ডা কণ্ঠ কি সত্যিই কোনো মানুষ ছিল, নাকি কিছু এমন, যা সাধারণ যুক্তির বাইরে?

অন্ধকারের ভিতরে প্রবেশ

রাত ঠিক এগারোটা। কলকাতার বাকি অংশে হয়তো রাত ঘনিয়ে এসেছে, কিন্তু গলি নম্বর সাত যেন এক অন্য জগৎ। আশপাশের বাড়িগুলো নীরব, গলিটা জনমানবশূন্য। একটা গা ছমছমে পরিবেশ চারপাশে ছড়িয়ে আছে।

আর এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি সেই ঠিকানায়, গলি নম্বর সাতের সেই পুরনো বাড়ির সামনে। রাত গভীর হচ্ছে, বাতাসে কেমন একটা অস্বস্তিকর শীতলতা।

আমি ধীরে ধীরে সামনে এগোলাম। রহস্যময় সেই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই যেন সময়ের গতি শ্লথ হয়ে গেল। বাড়িটা এতটাই পুরনো যে দেয়ালে ফাটল ধরে গেছে, জানালাগুলো ভেতর থেকে বন্ধ, কিন্তু তাতে জমে থাকা ধুলোর স্তর বলে দিচ্ছে, বহুদিন তাতে কেউ হাত দেয়নি।

কাঠের দরজাটা সামান্য ফাঁকা, যেন আমাকে স্বাগত জানাচ্ছে অথবা সতর্ক করে দিচ্ছে। ভিতর থেকে একটা হালকা ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে আসছে, যা এই ঋতুর জন্য স্বাভাবিক নয়। বাতাসের সাথে যেন এক অদৃশ্য আতঙ্ক মিশে আছে।

আমি একটা গভীর শ্বাস নিলাম, তারপর আস্তে আস্তে দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।

অজানা অন্ধকারের ভিতরে

ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। পুরনো কাঠের মেঝে, দেয়ালে ছোপ ছোপ দাগ, এবং আবছা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। মনে হচ্ছে, বহু বছর ধরে এখানে কেউ থাকেনি, অথচ এই মুহূর্তে এটা শূন্য নয়।

আমি চারপাশটা খেয়াল করলাম। সামনের ঘরের এক কোণায় একটা মোমবাতি জ্বলছে, মোমবাতির শিখা স্থির, কিন্তু তার আলো যেন পুরো পরিবেশকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। আলো-আঁধারির খেলা চারপাশে ছায়া সৃষ্টি করছে, যা বাস্তবের থেকেও বেশি অস্বস্তিকর লাগছে।

হঠাৎ মোমবাতির মৃদু আলোয় চোখ পড়ল ঘরের মাঝখানে। সেখানে একটা কাঠের চেয়ার।

চেয়ারে বাঁধা একজন মানুষ।

আমি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। শরীরটা কাঠ হয়ে আছে, হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছে। সেই মুহূর্তে বাতাস আরও ভারী মনে হতে লাগল, যেন চারপাশের অন্ধকার আমাকে গিলে নিতে চায়।

চেয়ারটায় বাঁধা মানুষটির মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। হাত দুটো পেছনে বাঁধা, মাথাটা কিছুটা নিচু, কিন্তু তার শরীরের কাঁপন বলে দিচ্ছে, সে জীবিত।

আমি নিচু হয়ে আস্তে আস্তে বললাম, “আপনি কি মিস্টার অনিরুদ্ধ সেন?”

তিনি শ্বাস নিতে থাকলেন দ্রুতগতিতে, তারপর সামান্য মাথা নাড়লেন।

আমি পকেট থেকে ছুরি বের করে ধীরে ধীরে তার মুখের কাপড় খুলে দিলাম।

তার মুখ সাদা হয়ে গেছে, চোখে আতঙ্ক। তার কপালে ঘাম জমেছে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে।

তিনি ফিসফিস করে বললেন, “তারা… তারা এখানেই আছে!”

হঠাৎ পেছনে এক অদ্ভুত শব্দ

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই, পিছন থেকে একটা শব্দ শুনলাম।

একটা চাপা পদশব্দ।

আমি দ্রুত ঘুরে তাকালাম।

আলো-আঁধারির খেলা তখনও চলছে, কিন্তু এবার বুঝতে পারলাম—আমি একা নই। ঘরের ছায়ার ভেতরে কয়েকটা অন্ধকার অবয়ব নড়ছে।

তিনজন লোক ধীরে ধীরে ছায়া থেকে বেরিয়ে এল।

তাদের মুখ ঢাকা, হাতে চকচকে পিস্তল।

ঘরের বাতাসে এক অদ্ভুত চাপা উত্তেজনা।

তাদের মধ্যে একজন ঠান্ডা গলায় বলল, “মিস্টার মিত্র, আপনি ভুল জায়গায় ভুল সময়ে চলে এসেছেন।”

আমি চারপাশে দ্রুত একবার তাকালাম। আমি জানতাম, এখন প্রতিটি সেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ।

এই রহস্য শুধু অপহরণ নয়, এর পিছনে আরও কিছু আছে। আর সেই “কিছু” আমার চোখের সামনে, রাতের অন্ধকারের ভিতরে অপেক্ষা করছে…

রহস্য উন্মোচনের দ্বারপ্রান্তে

ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সময় যেন থমকে গেছে।

মোমবাতির ম্লান আলোয় তিনজন মুখোশধারীর অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠল। তারা ধীরে ধীরে ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল, যেন অন্ধকার তাদের জন্ম দিয়েছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে চকচকে পিস্তল, যা মোমবাতির আলোয় ঠাণ্ডা একটা ঝলক দিচ্ছে।

আমার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক থাকলেও, মস্তিষ্ক দ্রুতগতিতে কাজ করছিল। আমার সামনে শুধু তিনজন অস্ত্রধারী ব্যক্তি নেই—এখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শেষ অধ্যায়।

তাদের মধ্যে একজন সামনে এগিয়ে এল। তার কণ্ঠ ছিল চাপা, কিন্তু প্রত্যয়ী।

“মিস্টার মিত্র, আপনার এখানে আসাটা উচিত হয়নি।”

আমি তাকে স্থির দৃষ্টিতে দেখলাম।

সে আরও এগিয়ে এসে বলল, “আপনি জানেন, যারা বেশি জানতে চায়, তাদের পরিণতি কী হয়?”

তার কথায় কোনো তাড়াহুড়া নেই, কোনো আবেগও নেই। যেন আমি একজন খেলোয়াড়, যে ভুল চাল দিয়েছে, আর সে এখন বিজয়ী হিসেবে নিজের অবস্থান ঘোষণা করতে এসেছে।

আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, “পরিণতি? তোমাদের জন্যই কিন্তু একটা বিশেষ পরিণতি অপেক্ষা করছে।”

এক মুহূর্তের নীরবতা—তারপর বিস্ফোরণ

ঠিক তখনই বাইরে পুলিশের সাইরেন বাজতে শুরু করল।

মুখোশধারীরা চমকে উঠল। তারা একে অপরের দিকে তাকাল, মুহূর্তের মধ্যে তাদের শরীরের ভাষা বদলে গেল। আমি দেখলাম, তারা দ্রুত পালানোর উপায় খুঁজছে।

আমি ধীরে ধীরে বললাম, “আমি আগেই ইনস্পেক্টর মুখার্জিকে সতর্ক করে রেখেছিলাম। তোমাদের খেলার এখানেই ইতি টানা হবে।”

হঠাৎ করেই দরজার বাইরে ভারী বুটের শব্দ শোনা গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পুলিশের দল বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলল। ইনস্পেক্টর মুখার্জির কণ্ঠ ধ্বনিত হল, “অস্ত্র ফেলে দাও! বাড়ি ঘিরে ফেলা হয়েছে!”

মুখোশধারীদের মধ্যে একজন মরিয়া হয়ে পিস্তল তুলে নিল, কিন্তু আমি আগেই প্রস্তুত ছিলাম। দ্রুত একটা চেয়ার ঠেলে তার দিকে ছুড়ে দিলাম, আর সেই মুহূর্তে দরজা ভেঙে পুলিশের দল প্রবেশ করল।

“হাত তুলে দাঁড়াও!” ইনস্পেক্টর গর্জে উঠলেন।

মুখোশধারীরা বুঝতে পারল, পালানোর আর কোনো উপায় নেই। তারা ধীরে ধীরে অস্ত্র ফেলে দিল। পুলিশ দ্রুত তাদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।

মুখোশের আড়ালের চেনা মুখ

আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। পুলিশের নির্দেশে তারা মুখোশ খুলতে বাধ্য হল।

আমি প্রথম মুখোশধারীর দিকে তাকালাম, অপরিচিত। দ্বিতীয়জনও অচেনা। কিন্তু তৃতীয়জন…

আমি থমকে গেলাম।

সে আর কেউ নয়, মিস্টার অনিরুদ্ধ সেনের ব্যবসায়িক পার্টনার, রজত দত্ত।

মিসেস সেনের কথাগুলো মনে পড়ল—”শত্রু তো থাকবেই, ব্যবসা মানেই প্রতিযোগিতা। কিন্তু এমন কিছু নয় যাতে কেউ তাকে অপহরণ করবে।”

কিন্তু সত্যিটা তার ভাবনার থেকেও ভয়ানক।

রজত দত্ত, অনিরুদ্ধ সেনের সবচেয়ে কাছের সহযোগী, এই পুরো ষড়যন্ত্রের মূল কারিগর।

ইনস্পেক্টর মুখার্জি কঠিন গলায় বললেন, “মিস্টার দত্ত, এটা কীসের প্রতিশোধ? ব্যবসায়িক শত্রুতা?”

রজত কিছু না বলে আমার দিকে তাকাল। তার চোখে কোনো অনুতাপ নেই, শুধু একটা গভীর অভিমান।

আমি বললাম, “তুমি ভাবতেই পারনি যে আমি বুঝে ফেলব, তাই না?”

সে একটা শুকনো হাসি হাসল, “আমি জানতাম তুমি আসবে, মিত্র। কিন্তু ভাবিনি এত দ্রুত সব ফাঁস হয়ে যাবে।”

আমি শান্ত গলায় বললাম, “তুমি ভুলে গিয়েছিলে, রহস্য যত জটিলই হোক, সত্যিটা সবসময় তার ছায়ার মতো পেছনে থাকে। আর আমি সেই ছায়ার দিকেই তাকাই।”

রজতের মুখটা কঠিন হয়ে গেল। পুলিশ তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল।

মিস্টার সেন তখনো হতবিহ্বল। তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, তার চোখে বিস্ময়।

“আমি কখনো ভাবতেও পারিনি…”

আমি মৃদু হেসে বললাম, “অনেক সময় সবচেয়ে কাছের মানুষটিই সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে ওঠে।”

ইনস্পেক্টর মুখার্জি বললেন, “মিস্টার মিত্র, আপনি না থাকলে আমরা হয়তো অনেক দেরি করে ফেলতাম।”

আমি মাথা নাড়লাম, “এটাই আমার কাজ, ইনস্পেক্টর।”

রজত দত্তের মুখে তিক্ত হাসি খেলে গেল।

“মিত্রবাবু, আপনি ঠিক সময়ে এসে সব মাটি করলেন!”

তার চোখে ছিল এক ধরনের হতাশা, কিন্তু আত্মসমর্পণের কোনো লক্ষণ নেই। বরং তার হাসির আড়ালে যেন কোনো লুকানো অভিমান।

আমি ধীর অথচ কঠিন স্বরে বললাম, “তুমি ভেবেছিলে, লোভ আর প্রতারণার খেলাটা চিরকাল চালিয়ে যেতে পারবে? তোমার ষড়যন্ত্র শেষ, রজত।”

রজত হালকা হেসে মাথা ঝাঁকাল। “তুমি ঠিক বলেছ, শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু জানো, মিত্র? আমি তো শুধু আমার ন্যায্য পাওনাটাই নিতে চেয়েছিলাম।”

আমি ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকালাম। “ন্যায্য পাওনা? অপহরণ, ষড়যন্ত্র, প্রতারণা—এসব কি ন্যায্য পাওনার মধ্যে পড়ে?”

রজত এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “অনিরুদ্ধের সাথে আমি ব্যবসা শুরু করেছিলাম সমান অংশীদার হিসেবে। কিন্তু সে ধীরে ধীরে আমাকে ছেঁটে ফেলল। সমস্ত লাভ, সমস্ত ক্ষমতা একাই দখল করে নিল। আমি শুধু আমার ভাগ ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলাম।”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “যদি সত্যিই ন্যায়বিচার চাইতে, তাহলে আইনিভাবে লড়তে পারতে। কিন্তু তুমি যা করলে, তা শুধু তোমার লোভের পরিচয়।”

রজত এবার আর কিছু বলল না। তার চোখের দৃষ্টি নিস্তেজ হয়ে এল।

চক্রান্তের সমাপ্তি

রজতের পরিকল্পনা ছিল সুক্ষ্ম। মিস্টার অনিরুদ্ধ সেনকে অপহরণ করে ভয় দেখিয়ে তার সমস্ত সম্পত্তির মালিকানা নিজের নামে লিখিয়ে নেওয়া। পরিকল্পনার মূল চাল ছিল—তাকে নিখোঁজ রেখে ধীরে ধীরে ব্যবসার দখল নেওয়া, তারপর একসময় হয়তো তাকে “দুর্ঘটনা” বলে চালিয়ে দেওয়া।

কিন্তু তার আগেই আমি পুরো চক্রটা ধরে ফেললাম।

পুলিশ মুখোশধারীদের হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেল। রজতকে যখন বের করা হচ্ছিল, তখন সে একবার অনিরুদ্ধ সেনের দিকে তাকাল।

“তুমি হয়তো আজ বেঁচে গেলে, কিন্তু মনে রেখো, এই শহরে কেউ কারও জন্য নিরাপদ নয়!”

ইনস্পেক্টর মুখার্জি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “চলুন, রজত দত্ত। আপনার জন্য আদালতে বিচার অপেক্ষা করছে!”

একটি পরিবারের পুনর্মিলন

মিস্টার সেন তখনও কিছুটা হতভম্ব। কিন্তু মিসেস সেন ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এলেন, তার চোখে ছিল আনন্দ আর কৃতজ্ঞতার অশ্রু।

তিনি স্বামীর হাত ধরে বললেন, “তুমি ঠিক আছো?”

অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে মাথা নেড়েই শুধু বলতে পারলেন, “আমি ভাবতেও পারিনি… শেষে রজত!”

আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, এই পুনর্মিলনের মুহূর্ত।

মিসেস সেন আমার দিকে ফিরে এসে বললেন, “মিস্টার মিত্র, আপনি না থাকলে কী যে হতো!”

আমি মৃদু হাসলাম। “এটাই তো আমার কাজ, মিসেস সেন।”

একটি নতুন রাত, একটি নতুন রহস্য

বাইরে রাতের বাতাস বয়ে যাচ্ছে। কলকাতার রাস্তাগুলো ধীরে ধীরে আবারও শান্ত হয়ে আসছে। পুলিশের গাড়ির আলো ক্রমশ ম্লান হয়ে যাচ্ছে।

আমি গভীর শ্বাস নিলাম।

একটি কেস শেষ হলো।

কিন্তু আমি জানি, এই শহরের অন্ধকারের মধ্যে আরও অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে—

অপেক্ষায়, আমার অনুসন্ধানের।

© পিনাকী রঞ্জন পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *