দীপাবলী-ভারতের প্রধান উৎসবগুলির অন্যতম। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে এই উৎসব দেশজুড়ে পালিত হয়। ঐদিন সন্ধ্যায় ঘরে ঘরে, বাজারে সর্বত্র আলো জ্বালিয়ে এই উৎসব পালন করা হয়। আলোর উৎসব দীপাবলী হল এক সার্বজনীন উৎসব দেশ-কাল ভেদে এর কোনও সীমা নেই। এই উৎসব নিয়েই আজ লিখেছেন পিনাকী রঞ্জন পাল।
এদেশের দীপাবলী উৎসব বহু পুরানো। সম্ভবত হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা বর্ষায় চাষ করা ফসল ঘরে তোলার পর যে আনন্দ উৎসব পালন করতো, সেটাই বর্তমানের দীপাবলী উৎসবের পরিবর্তিত রূপ। যখন ভারতে মুঘল বাদশাহরা রাজত্ব করেছেন তখনো সারা দেশে মহাসমারোহে পালিত হত দীপাবলী। মূলত আলোর উৎসব হলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই উৎসবকে ঘিরে রয়েছে নানা সংস্কার।
পঞ্জাবে দীপাবলী পালিত হয় শুরু গোবিন্দ সিংহের মুক্তির দিনটিকে স্মরণ করে। এক সময় মুঘল বাহশাহ আওরঙ্গজেবের কারাগারে বন্দি ছিলেন শিখদের গুরু গোবিন্দ সিংহ। যেদিন তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান, সেদিন রাজ্যের জনগণ প্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসব পালন করেন। সেই থেকে পঞ্জাবে গুরু গোবিন্দ সিংহের মুক্তির দিনে জাঁকজমক সহকারে দীপাবলী পালিত হয়ে আসছে।
জৈন ধর্মাম্বলম্বীরা মনে করেন, মহাবীরের মৃত্যুতে জ্ঞানের যে উজ্জ্বল শিখা নিভে গেছে তার অভাব মেটাতেই প্রদীপ জ্বালিয়ে একদিন উৎসব করা দরকার। তাই জৈনরা মহাবীরের মৃত্যুর দিনটিকে স্মরণ করে দীপাপলী উৎসব পালন করেন।
উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দীপাবলী থেকে শুরু হয় নতুন বছর। কারণ এই দিনটি ছিল রাজা বিক্রমাদিত্যের জন্মদিন এবং বিক্রমাব্দের শুরু। এইভাবে এই অঞ্চলে নববর্ষের সাথে জড়িয়ে আছে আলোর উৎসব দীপাবলী।
উত্তরপ্রদেশের প্রচুর মানুষ শ্রীরামচন্দ্রের জন্মদিন উপলক্ষ্যে দীপাবলী পালন করেন। কোথাও কোথাও রাম রাবণের যুদ্ধে রামের জয়ের কথা মনে রেখে দীপাবলী পালিত হয়। আবার কোথাও চোদ্দো বছর বনবাসের পরে শ্রীরামচন্দ্রের দেশে ফেরার ঘটনাকে স্মরণ করে দীপাবলী উৎসব উদযাপন করা হয়।
দক্ষিণ ভারতে, বিশেষ করে কেরল আর তামিলনাড়ুতে মানা হয়-এই দিন বিষ্ণুর হাতে নরকাসুর মারা গিয়েছিল। সেই আনন্দেই গোটা রাজ্যে এক সময় আলোর উৎসব শুরু হয়েছিল। সেই প্রাচীন উৎসব আজও এখানে সমানভাবে চালু রয়েছে। এইভাবে দক্ষিণ ভারতে দীপাবলীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নরকাসুর বধের গল্প।
ভারতের বহু স্থানে দীপাবলীর দিন লক্ষ্মী পূজা করা হয়। রাজস্থানে এই দিন গেরস্থের বিড়ালদের খুব যত্ন-আত্তি করা হয়। কারণ তাঁদের বিশ্বাস, বিড়াল হল লক্ষ্মীর অঙ্গ। দীপাবলীর দিন গুজরাতে দাবা খেলার জোর আসর বসে। তাদের বিশ্বাস, এইদিন দাবায় জিতে পারলে সারা বছর লক্ষ্মী প্রসন্ন থাকবেন।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালেও দীপাবলী উৎসব পালন করা হয়। সেখানে দীপাবলী হল বন্ধুত্বের অনুষ্ঠান। বন্ধুত্ব শুধু মানুষের সঙ্গেই নয়, বন্ধুত্ব প্রাণীদের সাথেও এদেশে এই উৎসব চলে পাঁচদিন ধরে। প্রথম দিন এরা পুজো করে কাকের। দ্বিতীয় আর তৃতীয়দিন যথাক্রমে কুকুর আর গরুর পুজো করা হয়। সঙ্গে চতুর্থ দিন হয় বাকি সব প্রাণীর সাথে বন্ধুত্ব। আর শেষ দিনে সেখানকার মানুষেরা একে-অপরের হাতে রাখী পরিয়ে মৈত্রীর বন্ধনে আরও দৃঢ় করেন।
আমাদের দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে চীন আর জাপানেও দীপাবলী পালিত হয়। চীনে দীপাবলীর প্রস্তুতি চলে কয়েক সপ্তাহ ধরে। সে দেশের মানুষ ওইদিন তাঁদের পূর্বপুরুষ ও দেবতাদের উদ্দেশ্যে পূজা দেন। অশুভ আত্মারা যাতে বাড়িতে প্রবেশ করতে না পারে এজন্য তাঁরা ওইদিন লাল রঙের মানুষ বানিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে দেন।
জাপানে এই উৎসব চলে তিনদিন। এই তিনদিন তাঁরা ঘর-বাড়ি ঝাঁট দেন না। তাঁদের বিশ্বাস, এই দিনগুলোয় ঘর ঝাঁট দিলে লক্ষী বিদায় নেবেন। একই সঙ্গে তারা মানেন যে, এই তিনদিন পূর্বপুরুষদের আত্মা বাড়িতে অতিথি হয়ে আসে।