সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার মঞ্চ থেকে লেফটেন্যান্ট : গরিমা যাদবের অনন্য পথচলার অনুপ্রেরণামূলক কাহিনী শোনাচ্ছেন পিনাকী রঞ্জন পাল।
সৌন্দর্যের মোহময়ী দুনিয়া, গ্ল্যামার আর খ্যাতির হাতছানি উপেক্ষা করে দেশের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন একজন নারী—গরিমা যাদব। শুধুমাত্র রূপের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, সৌন্দর্য শুধু বাহ্যিক নয়, আত্মবিশ্বাস, লড়াই ও আদর্শের মিশেলেই প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।
ভারতের সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট গরিমা যাদবের জীবনের গল্প কোনো সাধারণ গল্প নয়, এটি এক অনুপ্রেরণার অধ্যায়। যেখানে এক মেধাবী, আত্মপ্রত্যয়ী তরুণী কঠোর পরিশ্রম, অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং দেশপ্রেমের মাধ্যমে নিজের জীবনকে এক নতুন দিশা দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, সৌন্দর্য শুধুমাত্র ক্যামেরার সামনে নয়, দায়িত্ব, শৃঙ্খলা এবং আত্মত্যাগের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে।
গরিমা যাদবের জীবন শুরু হয়েছিল হিমাচল প্রদেশের সিমলায়। বাবা ছিলেন না, মা-ই ছিলেন তাঁর সবকিছু। আর্মি পাবলিক স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করে দিল্লির স্বনামধন্য সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে ভর্তি হন অর্থনীতি বিষয়ে। তখনই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরতে শুরু করে।
বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করার সময় আকস্মিকভাবেই সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার মঞ্চে ওঠেন গরিমা। ২০১৭ সালে ‘মিস চার্মিং ফেস ইন্ডিয়া’ পুরস্কার জেতেন তিনি, এবং ইতালিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পান। একদিকে রঙিন দুনিয়ার হাতছানি, অন্যদিকে নিজের স্বপ্নের পথ—এই দুইয়ের মধ্যে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল গরিমাকে। তিনি বেছে নিয়েছিলেন দেশের সেবা করার পথ।
প্রথমে লক্ষ্য ছিল সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়া, কিন্তু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারায় গরিমা ভেঙে পড়েননি। বরং, নতুনভাবে নিজের জীবন গড়ে নেওয়ার সংকল্প করেন। কম্বাইন্ড ডিফেন্স সার্ভিস (CDS) পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন এবং সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি যোগ দেন চেন্নাইয়ের অফিসার্স ট্রেনিং একাডেমিতে (OTA)।
সেনাবাহিনীর কঠোর প্রশিক্ষণ নারী-পুরুষ কারও জন্যই সহজ নয়। গরিমার ক্ষেত্রেও ছিল অজস্র শারীরিক ও মানসিক বাধা। কিন্তু তিনি লড়াই ছাড়েননি। ধাপে ধাপে সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সারা দেশের মধ্যে সেরা মহিলা অফিসারদের একজন হিসেবে উঠে আসেন। তাঁর মনের জোরই তাঁকে আজ লেফটেন্যান্টের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।
গরিমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা তাঁর মা। মা একা হাতে তাঁকে মানুষ করেছেন, কখনও কোনো ইচ্ছার কমতি রাখেননি। মা যেমন একা লড়াই করেছেন, তেমনই মেয়েও সেই সংগ্রামের উত্তরসূরি হয়েছেন। এই শক্তিই গরিমাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে।
তিনি প্রমাণ করেছেন, একজন নারী শুধু রূপের মোহে আবদ্ধ নয়, বরং তার মধ্যে থাকা মেধা, দৃঢ়তা এবং আত্মবিশ্বাসই তাকে সত্যিকারের সুন্দর করে তোলে। বলিউডের রঙিন পর্দার প্রলোভনকে উপেক্ষা করে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় যোগদান করা তাঁর আত্মপ্রত্যয়েরই নিদর্শন।
গরিমা যাদব আজকের যুবসমাজের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি দেখিয়েছেন, সুন্দরী প্রতিযোগিতা জেতা মানেই সিনেমায় যাওয়া নয়, আইএএস পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়া মানেই স্বপ্ন শেষ হয়ে যাওয়া নয়, এবং একজন নারী শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়েই চিহ্নিত হন না।
তাঁর কথায়, “নিজের স্বপ্নকে অনুসরণ করো, আত্মবিশ্বাসী হও, আর সৎপথে থেকো। সাফল্য তোমার পেছনে দৌড়াবে।”
প্রজাতন্ত্র দিবসে যখন তিনি ভারতের প্রলয় ক্ষেপণাস্ত্র ও টি-৯০ ট্যাংক বাহিনী-এর নেতৃত্ব দিলেন, তখন গোটা দেশ দেখলো এক সত্যিকারের অনুপ্রেরণার প্রতিমূর্তি। কেউ তাঁকে মিস ইন্ডিয়া ভেবেছিলেন, কেউ সিনেমার নায়িকা। কিন্তু তিনি শুধু একজন সুন্দরী নন, তিনি এক লড়াকু সেনানী।
গরিমা যাদব শুধুমাত্র নিজের জন্য নয়, সমস্ত নারীর জন্য প্রমাণ করে দিয়েছেন—স্বপ্নের পেছনে দৌড়ানোর জন্য সাহস দরকার, আর নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকলে সাফল্য আসবেই।
গরিমা যাদবের জীবন আমাদের শেখায়, কোনও বাধাই চূড়ান্ত নয়, যদি মনের জোর থাকে। প্রত্যেকেরই নিজের জীবনের গল্প লিখতে হয়, আর গরিমা সেটাই করেছেন সাহস, অধ্যবসায় ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। তিনি শুধু ভারতীয় সেনার গর্ব নন, তিনি সমগ্র দেশের নারীদের জন্য এক জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা।
আজকের তরুণ-তরুণীদের জন্য তাঁর জীবন এক বার্তা বহন করে—”নিজের পথে অবিচল থাকো, স্বপ্নকে অনুসরণ করো, এবং জীবনের কঠিন পথেও অগ্রসর হতে শেখো।”