লেখক : পিনাকী রঞ্জন পাল
প্রথম পর্ব : মাধবীর শৈশব
জলপাইগুড়ির সবুজ চা বাগান, বিশাল প্রকৃতির মাঝখানে কাজ করে মাধবীর বাবা-মা। তাদের সারাদিন কেটে যায় পাতার ভাঁজে, সূর্যের তলায় ঘাম ঝরিয়ে। মাধবীর ছোটবেলা কেটেছে এই চা বাগানের মধ্যেই। বাবার কাঁধে চড়ে চা পাতার সুবাস নিয়ে ঘোরা, মায়ের হাত ধরে মাঠের ধারে ছুটোছুটি করা—এটাই ছিল তার নিত্যদিনের জীবন। কিন্তু মাধবী আলাদা ছিল। তার ছেলেবেলা থেকেই ছিল একটা অদ্ভুত তেজ, অদম্য প্রাণশক্তি। সে কখনোই অন্য মেয়েদের মতো ঘরে বসে পুতুল খেলায় মনোযোগী ছিল না। বরং সে ছেলেদের সাথেই মেতে থাকত ফুটবল খেলায়, গাছে চড়া আর দৌড়াদৌড়িতে।
ছোট থেকেই মাধবী চা বাগানের মাঠে ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলতে শুরু করে। বড়দের চোখে সেটা হয়তো একটু অদ্ভুত লাগত, কিন্তু মাধবীর এতে কিছু আসত যেত না। তার পায়ে ছিল অদ্ভুত দক্ষতা। তার শরীরের প্রতিটা অংশ যেন বলের সাথে সঙ্গতি রেখে নাচত। সে চা বাগানের বড় মাঠে ছেলেদের সাথে খেলার সময় ফুটবলকে যেন নিজের মতো করে নিয়েছিল।
দ্বিতীয় পর্ব : মাধবীর ফুটবল জগতে প্রবেশ
একদিন চা বাগানের মাঠে মাধবী ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলছিল। সেই সময় একজন প্রবীণ ব্যক্তি, প্রাক্তন ফুটবলার মিস্টার সেনগুপ্ত, মাধবীর খেলা দেখে মুগ্ধ হন। তার খেলার ভঙ্গি, পায়ের স্কিল এবং ফুটবল নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দেখে মিস্টার সেনগুপ্ত বুঝতে পারেন, মাধবীর মধ্যে বড় ফুটবলার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি মাধবীর সাথে কথা বলেন এবং তাকে তার কোচিং সেন্টারে আসার প্রস্তাব দেন।
তখন মাধবী ক্লাস ফাইভে পড়ে। মাধবীর বাবা-মা প্রথমে চিন্তায় পড়ে যান, কারণ তাদের পক্ষে মেয়ের খেলার প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বাড়তি খরচ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু মিস্টার সেনগুপ্ত যখন মাধবীর প্রতিভার গুরুত্ব বোঝান, তখন তার বাবা-মা মাধবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে শুরু করেন। অবশেষে মাধবীর বাবার কঠিন পরিশ্রম আর মায়ের অসীম ত্যাগের ফলে মাধবী শুরু করে তার ফুটবল প্রশিক্ষণ।
মিস্টার সেনগুপ্ত মাধবীকে প্রতিদিন নতুন নতুন কৌশল শিখতে সাহায্য করেন। তিনি দেখেন, মাধবীর দৃষ্টিশক্তি, বল নিয়ন্ত্রণ, আর লক্ষ্য স্থির করার ক্ষমতা অসাধারণ। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মাধবী ফুটবল খেলায় এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছায়।
তৃতীয় পর্ব: জুনিয়র টিমে স্থান লাভ
মাধবীর এই দীর্ঘ পরিশ্রমের ফলস্বরূপ, একদিন সে দেশের জুনিয়র ফুটবল টিমে জায়গা পায়। তার বাবা-মা এই খবরে খুশিতে কেঁদে ফেলেন। মাধবীর জন্য তারা কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা কেবল তারাই জানেন। কিন্তু মাধবীর আনন্দে তাদের কষ্ট ধুয়ে যায়।
মাধবী দেশের বিভিন্ন জায়গায় খেলা শুরু করে। তার প্রতিটা ম্যাচেই সে দুর্দান্ত পারফর্ম করে এবং তার দক্ষতা আরও বেশি প্রশংসিত হতে থাকে। ফুটবল দুনিয়ায় মাধবীর নাম ছড়িয়ে পড়ে। ছোট্ট মেয়েটি এখন বড় মঞ্চে নিজের প্রতিভা দেখাতে শুরু করেছে।
চতুর্থ পর্ব: ফাইনালে জয়
একদিন বড় খেলা—ফাইনাল ম্যাচ। দেশের হয়ে খেলছে মাধবী। তার সামনে প্রতিপক্ষের শক্তিশালী টিম, কিন্তু মাধবী দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মাঠে নামে। এই ম্যাচে দেশ জিতবে কিনা, তা অনেকটা নির্ভর করছে তার উপরে। প্রথমার্ধে দুটো গোল করে প্রতিপক্ষ টিম এগিয়ে যায়। মাধবীর টিমের খেলোয়াড়রা হতাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু মাধবী তাদের মানসিকভাবে উদ্বুদ্ধ করে। সে বলে, “আমরা এই মাঠে জেতার জন্য এসেছি, হার মানার জন্য নয়।”
খেলা শুরু হয়, মাধবী দারুণ গতিতে বল নিয়ে এগিয়ে যায়। তার চমকপ্রদ পাস এবং গোল লক্ষ্য করে কিক করে। অবশেষে ফাইনালের শেষ মুহূর্তে মাধবী একটি দুর্দান্ত গোল করে দেশকে জয় এনে দেয়। তার গোলে দেশের বিজয় হয়, আর গোটা দেশ মাধবীকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।
পঞ্চম পর্ব: নতুন স্বপ্নের পথে
মাধবীর এই সাফল্যে তার বাবা-মা ভীষণ গর্বিত। কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক সমস্যা এখনও কাটেনি। মাধবীর খেলা চালিয়ে যেতে প্রচুর খরচ হয় এবং পুষ্টির অভাবে তার শরীরেও সমস্যা দেখা দেয়। তার বাবা-মা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন তাকে ভালো খাবার ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য, কিন্তু তাদের সামর্থ্য সীমিত। আর এই দেশে ফুটবলে তেমন স্পন্সর পাওয়া যায় না, এই দেশে টাকা উড়ছে শুধু ক্রিকেটে। আর সেখানে মাধবীর মতো একজন মহিলা ফুটবলার কে স্পনসর করবে!
তবুও মাধবী হাল ছাড়ে না। তার স্বপ্ন দেশের হয়ে সিনিয়র দলে খেলার। সে জানে, তার সামনে অনেক কঠিন বাধা আছে, কিন্তু সে সেই বাধা পেরিয়ে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার বাবা-মাও তার পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই চালিয়ে যান। মাধবী জানে, তাদের কঠিন পরিশ্রম, ত্যাগ এবং সাহসের কারণেই সে আজ এখানে পৌঁছেছে।
মাধবীর লড়াই শেষ হয়নি বরং তার স্বপ্নের পথে নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়েছে।
© পিনাকী রঞ্জন পাল