পিনাকী রঞ্জন পাল
১৯২৮ সাল। সময় সকাল। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ডাঃ আলেকজান্ডার ফ্লেমিং নিজের পরীক্ষাগারে এসেছেন। রোজকার মত আগে কাচের প্লেটগুলো পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখলেন সেগুলোতে ছাতা (ছত্রাক) পড়ে রয়েছে। কিন্তু একি। ডাঃ ফ্লেমিংয়ের সারা দেহে বিদ্যুৎ খেলে গেল। প্লেটের যেখানে ছাতা পড়েছে তার আশপাশেতে কোন জীবাণুর নামগন্ধ নেই। তবে কি এই ছাতা জীবাণুনাশক? হলেও, হতে পারে? ঠিক আছে, পরীক্ষা করেই দেখা যাক না।
ডাঃ ফ্লেমিং একটি পরীক্ষা নলে কিছু ছাতা (ছত্রাক) নিয়ে তাতে জল ঢাললেন। এরপর জলটা হেঁকে আলাদা করলেন। এখন ওই জলে ছাতার দেহ থেকে উৎপন্ন রসগুলো রইল। তার পর তিনি দুটো সুস্থ গিনিপিগ এনে একটাকে ওই রসমিশ্রিত জল ইনজেকশন করলেন। অপরটিকে করলেন না। উদ্দেশ্য, দুটোর মধ্যে তুলনা করা। কিন্তু কি আশ্চর্য। দুটো গিনিপিগই সুস্থ রইল। ডাঃ ফ্লেমিং সিদ্ধান্তে এলেন যে, ওই ছাতার দেহ থেকে নিঃসৃত তরল পদার্থ বিষ নয়, তার রয়েছে জীবাণুনাশক গুণ যার দ্বারা জীবাণু ধ্বংস করে। ডাঃ ফ্লেমিং ভাবলেন, তবে মানুষের জীবাণু ঘাটতি রোগ তাড়াতে এটা প্রয়োগ করলে কেমন হয়। কিন্তু এর জন্য চাই উপযুক্ত রোগী, চিকিৎসক, হাসপাতাল। পরদিন ডাঃ ফ্লেমিং কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বললেন। কিন্তু কেউই ঝুঁকি নিতে রাজি হলেন না। ডাঃ ফ্লেমিং সহজে হারাবার পাত্র নন। তিনি তাঁর গবেষণার ফলাফল একটা ডাক্তারি পত্রিকায় প্রকাশ করলেন।
দেখতে দেখতে কেটে গেল ১০ বছর। এমন সময় তাঁর সঙ্গে দেখা হল জীবাণু গবেষক হাউয়ার্ড ফ্লোরের। ডাঃ হাউয়ার্ডকে ফ্লেমিং অতি আনন্দের সঙ্গে তাঁর আবিষ্কার তুলে দিলেন। ডাঃ হাউয়ার্ড এই আনকোরা জিনিসটি প্রথমেই মানুষের ওপর প্রয়োগ না করে ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ করেন। ইঁদুরদের ওপর পরীক্ষা করে তিনি একশ’ ভাগ নিশ্চিন্ত হলেন যে, ওই বিশেষ রসটির জীবাণুনাশক ক্ষমতা’ রয়েছে। এইবার তিনি মানুষের ওপর প্রয়োগ করতে চাইলেন। কিন্তু স্বেচ্ছায় কে এই নতুন ইনজেকশন নিজের দেহে প্রয়োগ করার অনুমতি দেবে।
লন্ডনের এক পুলিশ দাড়ি কামাতে গিয়ে গাল ভীষণভাবে কেটে মরণাপন্ন হলেন। চিকিৎসকরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। সবশুনে হাউয়ার্ড দৌড়ালেন। কেউ আপত্তি করল না। শুরু হল চিকিৎসা। ব্লেডে জন্মান জীবাণু সাঙ্ঘাতিকভাবে বিষিয়ে দিয়েছে সারা মুখমণ্ডল। তিন ঘন্টা পর পর ইনজেকশন দিতে লাগলেন ডাঃ হাউয়ার্ড। তৃতীয় দিন গাল, গলা ফোলা কমে সন্তোষজনক মনে হচ্ছে। কিন্তু সেদিনই ফুরিয়ে গেল ওষুধ। হাউয়ার্ড ছুটলেন ওষুধ তৈরি করতে। কিন্তু এর জন্য চাই সময়, কারণ ওই ছাতার বংশবৃদ্ধি হয় খুব ধীরে। এদিকে রোগীর অবস্থা খারাপ হতে হতে রোগী মারা গেল।
ডাঃ হাউয়ার্ড বুঝলেন যে, সেই ছাতা গজানর কোন দ্রুত পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হবে। ডাঃ হাউয়ার্ড চলে এলেন আমেরিকাতে। এখানে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সহ বিশাল গবেষণাগারে তিনি ওই ছাতাটির দ্রুত, অতি দ্রুত বংশবৃদ্ধি করার উদ্ভাবনের কাজে লেগে গেলেন। দিন-রাত পরিশ্রম করেই চলেছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। একদিন পাওয়া গেল সেই সুসংবাদ। ডাঃ হাউয়ার্ড ঘোষণা করলেন, ‘সেই ছাতা খুব তাড়াতাড়ি গজাবার মাধ্যম তিনি আবিষ্কার করেছেন। তিনি বলেন, ‘তাড়িতে যদি সেই ছাতা গজান যায়, তবে তা অতি দ্রুতগতিতে বংশবৃদ্ধি করে। আরও বললেন যে, ‘চলতি পদ্ধতিতে যে পরিমাণ ছাতা জন্মায় সেই একই সময়ে এই নতুন পদ্ধতিতে তার দুশ’ গুণ বেশি ছাতা জন্মায়’। ব্যস, হয়ে গেল এক বিরাট সমস্যার সহজ সমাধান।
তৈরি হতে লাগল প্রচুর পরিমাণে সেই ছাতা (ছত্রাক)। পাওয়া যেতে লাগল প্রচুর পরিমাণে ওষুধ। পৃথিবীর দিকে দিকে রোগীদের দেওয়া হতে লাগল এই ওষুধ। ডাঃ হাউয়ার্ডের চিকিৎসক স্ত্রী ইথেল এই ওষুধ দিয়ে মাত্র এক বছরেই মরণাপন্ন দুশ’ রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুললেন।
১৯৪৫ সালে এই জীবাণুনাশক রস আবিষ্কারের জন্য ডাঃ ফ্লেমিংকে দেওয়া হল নোবেল পুরস্কার। সেই ওষুধ রোগীর দেহে প্রয়োগ করার জন্য ডাঃ হাউয়ার্ডকেও নোবেল দিয়ে সম্মানিত করা হয়। ছত্রাকটি দেখতে একগুচ্ছ শিসকাটা পেন্সিলের মত, তাই এই ছাতার (ছত্রাক) নামকরণ হল ‘পেনেসিলিয়াম নোটেটাম’ এবং তার দেহ থেকে নিঃসৃত রসটির নাম হল ‘পেনেসিলিন’।