ফুটবলার থেকে টোটো চালক : কালীমণি মাণ্ডির জীবন সংগ্রামের গল্প

পিনাকী রঞ্জন পাল : খেলাধুলা শুধুই শখ বা বিনোদনের বিষয় নয়; এটি জীবনের সঙ্গে যুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিভা, প্রচেষ্টা, এবং ইচ্ছাশক্তি থাকা সত্ত্বেও অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় জীবনের কঠোর বাস্তবতার কাছে হার মানেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের গোয়ালতোড়ের কালীমণি মাণ্ডির গল্প তেমনই এক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।

প্রতিভার উন্মেষ
কালীমণি মাণ্ডি ছোট নাকদনা গ্রামের এক সম্ভাবনাময়ী মহিলা ফুটবলার ছিলেন। ব্লক স্তরের দলে তিনি ছিলেন মধ্যমাঠের অপরিহার্য খেলোয়াড়। নিজের প্রতিভা এবং দক্ষতার জোরে তিনি পুরস্কারও পেয়েছেন এবং মেয়েদের একটি দল তৈরি করে তাদের অনুশীলনে উৎসাহ দিয়েছেন। এইসব অর্জন একজন সাধারণ গ্রামীণ মহিলার জন্য বড় সাফল্য। ফুটবল ছিল তাঁর জীবনের ভালোবাসা, তাঁর স্বপ্নের একমাত্র আশ্রয়।

অভাবের অমানিশা
তবে, প্রতিভা থাকলেই জীবনযুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব নয়। কঠিন আর্থিক পরিস্থিতি এবং ১৩ জনের বড় সংসারের দায়িত্ব কালীমণির পায়ের শিকল হয়ে দাঁড়ায়। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই সংসারের অভাব বাড়তে থাকে। চাষের জমি এক ফসলি হওয়ায় পরিবারের চাহিদা মেটাতে তা পর্যাপ্ত ছিল না। একশো দিনের কাজ থেকেও নিয়মিত রোজগার হচ্ছিল না। সংসারের এই অচলাবস্থা কালীমণিকে বাধ্য করে ফুটবল ছাড়তে এবং নতুন রোজগারের পথ খুঁজতে।

টোটো চালানোর পথে নতুন লড়াই
কালীমণি ২০২২ সালে কিস্তিতে একটি টোটো কেনেন। গোয়ালতোড় থেকে জিরাপাড়া পর্যন্ত টোটো চালিয়ে তিনি সংসার চালাতে শুরু করেন। জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্তগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। ফুটবল মাঠ থেকে টোটোচালক হয়ে ওঠার এই যাত্রাপথ সহজ ছিল না। তবে, এই কাজে তিনি তাঁর পরিবারের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের সমর্থন পেয়েছেন। কালীমণি শুধুমাত্র টোটো চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেননি, বরং গ্রামে টোটো পরিষেবার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন।

সংকল্প এবং সমাজের পরিবর্তন
কালীমণি মাণ্ডি একজন পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মহিলাদের মধ্যে তিনিই প্রথম, যিনি টোটো চালানোর মতো পেশায় প্রবেশ করেছেন। সমাজের প্রচলিত নিয়ম-নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রয়োজনের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে কখনো লজ্জা পাওয়া উচিত নয়। তিনি নিজের পেশার পাশাপাশি ফুটবলের সঙ্গেও সংযোগ রেখেছেন। নিজের তৈরি মেয়েদের দলকে তিনি এখনও অনুশীলনে সাহায্য করেন এবং পরামর্শ দেন।

সমস্যার মধ্যেও উদ্যমী মনোভাব
কালীমণির জীবনে প্রতিকূলতা কখনো তাঁকে দমিয়ে দিতে পারেনি। ভোর বা গভীর রাতে যেকোনো ডাকে সাড়া দিয়ে টোটো নিয়ে হাজির হওয়া তাঁর এক অদম্য মানসিকতার পরিচায়ক। তাঁর এই উদ্যম এবং পরিশ্রম গ্রামের মানুষের কাছে তাঁকে অনুপ্রেরণা হিসেবে তুলে ধরেছে।

কালীমণি মাণ্ডি: এক জীবন্ত উদাহরণ
কালীমণি মাণ্ডি একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড় থেকে একজন সফল টোটোচালক হয়ে উঠেছেন। এই রূপান্তরের গল্প শুধু একটি ব্যক্তিগত সংগ্রামের নয়, বরং এটি বর্তমান সমাজের বাস্তবতা ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক। কালীমণি যেমন মেয়েদের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ তৈরি করেছেন, তেমনই তিনি কাজের মর্যাদার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিয়েছেন।

কালীমণি মাণ্ডির জীবন আমাদের শিখিয়ে দেয় যে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে এগিয়ে চলাই জীবনের প্রকৃত অর্থ। তিনি একদিকে যেমন সম্ভাবনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, অন্যদিকে তেমনি দায়িত্বশীলতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণাও। তাঁর গল্প আজকের যুব সমাজকে শিখিয়ে দেয়, প্রতিভা থাকলেও কঠোর পরিশ্রম ছাড়া জীবনে স্থায়িত্ব অর্জন সম্ভব নয়।

শেষ কথা
কালীমণি মাণ্ডির জীবনসংগ্রাম আমাদের শেখায় যে জীবন প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়। কিন্তু সেই পরিবর্তনকে মেনে নিয়ে এগিয়ে চলার মধ্যে লুকিয়ে থাকে জীবনের আসল জয়। টোটোচালক হয়ে ওঠা কালীমণি আজও একজন খেলোয়াড়, একজন যোদ্ধা, এবং একজন সমাজের পথপ্রদর্শক। তাঁর এই গল্প আমাদের জীবনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি জোগায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *