স্বাধীনতা সংগ্রামী লক্ষণ মৌলিক ও জলপাইগুড়ি

লেখক পঙ্কজ সেন

জলপাইগুড়ি শহরের শিয়াল পাড়ার বাসিন্দা লক্ষণ মৌলিকের জন্ম ১৯১০ সালে। ১২ বছরের লক্ষণ মৌলিক তার বাল্য বেলায় পরিহিত হাফপ্যান্টের দুইদিকে পকেট থাকলেও প্যান্টের ভিতরে থাকতো একটি গুপ্ত পকেট, যেখানে বিপ্লবীদের গোপন চিঠি রাখা থাকতো। বিপ্লবীদের চিঠি আদান-প্রদানের দায়িত্ব ছিল সেই ১২ বছর বয়সেই। ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে কখন কি পদক্ষেপ নেওয়া হবে এই চিঠিতে তার উল্লেখ থাকতো। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সঠিক প্রাপকের কাছে চিঠি পৌঁছে দিতে এই কিশোরের দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতিত। শহরের ফনিন্দ্রদেব বিদ্যালয়ের ছাত্র লক্ষণবাবু তার শ্রেণীর সহপাঠীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতেন। পান্ডাপাড়া এলাকায় একটি ব্যায়ামাগারে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে তার আলোচনা হতো। তিস্তা নদীর পাড়ে রঙধামালি সংলগ্ন বৈকুন্ঠপুর বনাঞ্চলে বন্দুক চালানো অনুশীলন করতেন ১৯২৫ সালে। তখন এই গভীর বনাঞ্চলে চিতাবাঘ এবং বুনো হাতির পাল প্রকাশ্যে চলাফেরা করত। সেই বিপদজনক পরিবেশেই চলতো লক্ষণবাবু এবং তার সহযোগীদের বন্দুক চালানোর অনুশীলন।একবার ছাত্রাবস্থায় ইংরেশ পুলিশের হাতে ধরাও পড়ে যান, ইংরেজ শাসকরা তাকে বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠায়। পরে বিপজ্জনক মনে করে সেখান থেকে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়। কিছুদিন রংপুর জেলেও বন্দী ছিলেন লক্ষণবাবু। বন্দী অবস্থাতেও তিনি নিজের পড়াশুনা চালিয়ে গিয়েছেন। পরে শহরের শিয়ালপাড়ার বাড়িতে ইংরেজরা তাকে গৃহবন্দি করে রেখেছিল। মহান এই বিপ্লবীর সম্মানে জলপাইগুড়ি পুরসভা শিয়ালপাড়ার একটি রাস্তার নামকরণ করেছেন “লক্ষণ মৌলিক সরণী”।

১৯৫৫-৫৬ সালে জলপাইগুড়ি শহরের বিখ্যাত “আলোছায়া” সিনেমা হলের মালিকানা হস্তান্তর হলে শহরের বিশিষ্ট মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী চম্পালাল সারোগী নতুন মালিক নিযুক্ত হন। পূর্বের “আলোছায়া” নাম পরিবর্তন করে “রূপমায়া” নাম দিয়ে তিনি লক্ষণ বাবুকে হলের ম্যানেজার নিযুক্ত করেন। একটা দীর্ঘ সময় তিনি এই হলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে তৎকালীন ভারতের ইন্দিরা গান্ধী সরকার লক্ষণ বাবুকে “তাম্যপত্র সম্মানে” সম্মানিত করে। লক্ষণবাবু ভারত সেবাশ্রম সংঘ এবং আদর্শ ব্যায়ামাগারে যোগব্যায়াম শেখাতেন। প্রণবানন্দ ব্যায়ামাগারের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। লক্ষণ বাবু ও মলয় মুখার্জি একসঙ্গে কদমতলার কাছে আদর্শ ব্যায়ামাগার পরিচালনা করতেন। শহরের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের যোগব্যায়াম শেখানোর পাশাপাশি তাদের রাজবাড়ী দিঘিতে সাঁতার শেখানোর প্রশিক্ষণও তিনি দিতেন। ওনার ৮৫ বছর বয়সের জন্মদিন শহরে খুবই জাঁকজমক সহকারে পালিত হয় এবং এই উপলক্ষে একটি শোভাযাত্রা বের করা হয়। পায়ে কেডস, সাদা ধুতি এবং হাতা গোটানো জামা ছিল ওনার অত্যন্ত পছন্দের পোশাক। নেতাজিকে তিনি সামনে থেকে দেখেছিলেন। জলপাইগুড়ি শহরের গর্ব এই মহান মানুষ ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে ১০১ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *