পিনাকী রঞ্জন পাল
শীতের শিমুলপুরের রবিবারের সাপ্তাহিক হাটে রোদ ঝলমলে দিনে এমন ঘটনা ঘটবে, তা কে জানত! হাটের এক কোণে মধ্যবয়সী রোগা পাতলা চেহারার কেশব ঘোষ তাঁর দুধের ব্যবসার জন্য লোকজনের সঙ্গে দরাদরি করছিলেন। মাথায় সাদা গামছা, সাদা ধুতি আর চোখে সামান্য অবসাদ। প্রায় ১৪ বছর ধরে একলা সংসার চালিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু আজকের দিনটি যে তাঁর জীবনের সবকিছুকে ছাপিয়ে যাওয়া এক অভিজ্ঞতার দিন হতে চলেছে এটা ভাবনাতেও ছিল না।
হঠাৎ, কেশবের পিঠে কারও জোরালো হাতের চাপ। “কেশু! আমাকে চিনতে পারছো না?” কেশব প্রথমে ঘাবড়ে গেলেন। পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলেন মীনা! বেশ ভারিক্কী চেহারা, গায়ে পুরনো কিন্তু ঝকঝকে একটা শাড়ি, মাথায় তেল দেওয়া চুল। হাতে একটা লাল গামছা। সেই মীনা, যাঁর সঙ্গে বছর কুড়ি আগে বিয়ে হয়েছিল এবং যে ১৪ বছর আগে তার প্রেমিকের হাত ধরে সংসার ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কেশব তো চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে আছেন, তার মধ্যেই মীনা গমগমে গলায় বলে উঠল, “তোমার সঙ্গে সংসার করতে এসেছি। চলো!”
কেশব ভাবলেন, ভুল শুনেছেন। তিনি মাথা নেড়ে মিনমিন গলায় বললেন, “তুমি এখানে কেন? কী বলছো এসব?”
“কী বলছি মানে? রাতে স্বপ্নে প্রেম করবে, দিনের বেলায় অস্বীকার করবে? চলো, তোমাকে আবার আমার সঙ্গে সংসার করতে হবে!”
কথা শেষ হতে না হতেই মীনা এক লাফে কেশবের সামনে চলে এলেন। হাটের ভিড়ে অনেকেই মজার গন্ধ পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কেশব অস্বস্তিতে পড়লেন। “শোনো, মীনা, যা বলছো, তা অসম্ভব। আমি তো কোনও স্বপ্ন দেখিনি! আর তুমি আমার জীবনে আবার ফিরলে কেন?”
মীনা তখন ক্ষেপে গেছেন, “অপরাধীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকবে না! চলো! নইলে মজা দেখাচ্ছি।”
এরপর যা হলো তা কেউ কল্পনাও করেনি। মীনা ধপাধপ কেশবের পিঠে হাত চালালেন। হাটের লোকেরা এই দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিল। গলায় গামছা দিয়ে কেশবকে টানতে টানতে মীনা সোজা শিমুলপুর থানায় হাজির করলেন।
থানার পুলিশ থেকে উপস্থিত জনতা—সবাই হতবাক। মীনা থানার ভিতরে ঢুকে চিৎকার শুরু করলেন, “স্বপ্নে প্রেম করার ফল এই! পুলিশকে জানিয়ে দেব, ও আমাকে বিয়ে না করলে ছাড়ব না।”
কেশব এতক্ষণে গামছার বাঁধন থেকে মুক্তি পেলেন। কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “আমি দুধের ব্যবসা করি। স্বপ্নে প্রেমের কথা বলছেন উনি! এত বছর তো তাঁর মুখ দেখিনি। এখন কেন ফিরলেন?”
পুলিশ আধিকারিক রঘু সিং চায়ের গ্লাস হাতে বিষয়টি বুঝে ওঠার চেষ্টা করছে। এদিকে, মীনা তাঁর গল্প শোনাতে শুরু করলেন, “আমার দ্বিতীয় স্বামী মারা গেছেন। গত এক বছর ধরে স্বপ্নে কেশবের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। কেশব হাত ধরে বলছে, ‘তুমি ফিরে এসো।’ তাই এবার বাস্তবেও ফিরে এসেছি।”
রঘু সিং নিজের হাসি আর চেপে রাখতে পারলেন না। বললেন, “ঠিক আছে, আপনার স্বপ্নের ব্যাপারটা আমরা বুঝলাম। কিন্তু কেশববাবুর তো এখন আর কোনো দোষ নেই।”
এদিকে থানার অন্য পুলিশ কর্মীরা হাসি চাপার চেষ্টা করছেন। কেশব হঠাৎ করেই বললেন, “আমায় মাফ করে দিন। স্বপ্নে যদি সত্যিই কিছু বলে থাকি, তা আমার মনে নেই। আমি দুধের ব্যবসা করেই ভালো আছি।”
মীনা তখন আবার চেঁচিয়ে উঠলেন, “তুমি মেনে নাও। এইবার থেকে স্বপ্নেও তুমি কারও সঙ্গে প্রেম করতে পারবে না। আমি থানার সামনে ধর্নায় বসব।”
শেষে পুলিশ দু’জনকেই শান্ত করে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করল। কেশব বেঁচে যাওয়ার আনন্দে হাঁপ ছাড়লেন, আর মীনা থানা থেকে বেরিয়ে গেলেন একরাশ রাগ নিয়ে।
শিমুলপুরের লোকজন কিন্তু এই ঘটনাকে নিয়ে মজার একটা রসদ পেয়ে গেল। কেউ বলল, ” এবার স্বপ্নেও সাবধান হতে হবে,” আবার কেউ বলল, “এমন দুঃসাহসিক প্রেম সত্যিই বিরল।” তবে কেশববাবুর মনে একটাই ভাবনা, “স্বপ্নেও এতো ঝামেলা! দিনকাল কোথায় যাচ্ছে?”
© পিনাকী রঞ্জন পাল