মজার গল্প : ইঁদুর

মূল লেখক : জে. বি. এস. হল্ডেন,

অনুবাদ : পিনাকী রঞ্জন পাল

একবার লন্ডনের বন্দরগুলিতে ইঁদুরের অত্যাচার ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। ইঁদুরগুলি ছিল ভীষণ ভয়ঙ্কর প্রজাতির। তারা কানাডার গম আর হল্যান্ডের পনীর খেত। আর্জেন্টিনার টাটকা বীফ খেত। তারা ইরান থেকে আসা সুন্দর সুন্দর কার্পেটগুলি কেটে কেটে সেগুলি দিয়ে নিজেদের বিছানা বানাতো। ইঁদুররা খাদ্যদ্রব্য হজম করার পরে চীন থেকে আসা রেশমী রুমাল দিয়ে নিজেদের হাত-পা পরিষ্কার করতো।

“অনেকদিন আগেকার কথা। ইংল্যান্ডে স্মিথ নামের এক ব্যক্তি বসবাস করতো। তার ছিল তরিতরকারির দোকান। স্মিথের চারজন ছেলে ছিল। সবচেয়ে বড় ছেলের নাম ছিল জর্জ। বড় হয়ে জর্জ পিতার দোকান দেখাশোনা করবে বলেই ঠিক ছিল। এইজন্য স্কুলে সে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অ্যাডভান্স কোর্স করেছিল। বাঁধাকপির একশো সাতান্ন রকম প্রজাতির এবং পালং শাকের চুয়াল্লিশ রকম প্রজাতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছিল। সে বাঁধাকপিতে বাস করা সত্তর রকম প্রজাতির শুঁয়োপোকাদের চিনতে শেষে এবং তাতে বিভিন্ন দেশীয় কাঁট-নাশক ওষুধ ছিটিয়ে আশ্চর্যজনক সাফল্য পায়।

সাবানগোলা জল ছিটানোয় বাঁধাকপি থেকে সবুজ রংয়ের, তামাকের রস ছিটানোয় বিচিত্র রংয়ের এবং লবণগোলা জল ছিটানোয় মোটামুটি প্রচুর শুঁয়োপোকা বার হয়। বড় হয়ে জর্জ দোকানের দায়িত্ব নেওয়ার পর তার তরিতরকারির দোকান লন্ডন শহরের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ দোকানে পরিণত হল। কারণ তার দোকানের বাঁধাকপিতে কোনো দিনও কেউ একটা শুঁয়োপোকার সন্ধান পায়নি।

কিন্তু মিস্টার স্মিথের একটিই মাত্র দোকান ছিল। সেইজন্য তার বাকি ছেলেরা অন্য পেশায় নিজের ভাগ্য যাচাই করছিল। স্মিথের মেজো ছেলেকে সবাই জিম বলে ডাকতো। যদিও তার নাম ছিল ‘জেমস্’। তবে সকলের মতো আমরাও তাকে জিম বলেই ডাকবো। জিম ইংরাজিতে দক্ষ ছিল এবং স্কুলে রচনা লেখার প্রতিযোগিতায় তার পুরস্কার বাঁধা ছিল। সে ছিল স্কুলের ফুটবল দলের অধিনায়ক। এসবের পাশাপাশি জিম ভালো হাত সাফাইয়ের খেলা দেখাতেও পারতো। দুষ্টুমিতেও সে ছিল সকলের সেরা। স্কুলের শিক্ষকরাও অনেকবার তার দুষ্টুমির শিকার হয়েছিলেন। একবার সে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখার চকের মাঝে ফুটো ফুটো করে তাতে একটি দেশলাই কাঠি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। শিক্ষক মশাই সেই চক দিয়ে লেখা শুরু করতেই ভেতরের দেশলাই কাঠি জ্বলে ওঠে। আর একদিন সে সমস্ত কালির দোয়াতে মিথিলেটেড স্পিরিট মিশিয়ে দেয়। ফলে সমস্ত দোয়াতের কালি পাল্টাতে হয়েছিল। এইজন্য সেদিন ফ্রেঞ্চ ভাষার ক্লাসে পড়ানো সম্ভব হয়নি। তবে এ কথ ছোটখাটো দুষ্টুমি করতো না। যেমন, সে কখনো তালার ফুটোয় আটার দলা ঢোকায়নি কিংবা সে শিক্ষক মশাইয়ের ড্রয়ারে কখনো মরা ইঁদুর লুকিয়ে রাখতো না।

সেজো ছেলের নাম ছিল চার্লস। অঙ্ক আর ইতিহাসের সাথে রসায়নে ছিল তাঁর আশ্চর্যরকম দখল। গোটা স্কুলে সেই একমাত্র ছাত্র যে ‘প্যারাডাই মিথাইল অ্যামিনো বেঞ্জলদীহাইড’ তৈরি করেছিল। এই রসায়ন তৈরি করা ভীষণ কষ্টসাধ্য। ব্যাপার। সে দুর্গন্ধের চেয়েও পচা-গলা দুর্গন্ধ তৈরি করতে পারতো। কেননা চার্লস তাদের রাসায়নিক বিক্রিয়া জানতো। তবুও সে দারুণ ভালো ছেলে ছিল, কারণ এমনটা সে কখনো করেনি।

স্মিথের ছোটো ছেলের নাম ছিল জ্যাক। পড়াশোনা অথবা খেলাধুলো কোনোটিতেই সে বিশেষ দক্ষ ছিল না। জ্যাক খেলতে গিয়ে ফিল্ডিং করতে করতে মাঠেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তবে ওয়ারলেস সেট নির্মাণে সে পারদর্শী ছিল। জ্যাক বিদ্যুতের সব ধরনের সংযোগ করতে জানতো। বাড়ির মিটারে একটি নতুন তার লাগিয়ে সে বৈদ্যুতিক পাখা চালাতো আর বাল্ব জ্বালাতো, কিন্তু মিটার উঠতো না। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে তার রিডিং এক জায়গাতেই থেমে থাকতো। একথা তার পিতা জানতে পেরে ভীষণ রেগে যান এবং বলেন, ‘এ ধরনের অন্যায় কাজ আমাদের করা উচিত নয়। এটা তো এক ধরনের বিদ্যুৎ চুরি হল’। জ্যাক জবাব দেয়, ‘আমার মতে এটা কোনো চুরি নয়। কারণ বিদ্যুৎ আমাদের বাল্ব প্রভৃতির মধ্য দিয়ে। প্রবাহিত হয়ে পুনরায় মেইন লাইন দ্বারা ফেরত চলে যায়। আমরা কি বিদ্যুৎকে নিজেদের কাছে ধরে রাখি। আমরা তো তাকে কিছুক্ষণের জন্য শুধুমাত্র ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু তার পিতা তবুও তাকে মিটার থেকে অবৈধ তার সরিয়ে ফেলতে বলে। কেননা মিস্টার স্মিথ ছিলেন একজন সৎ ব্যক্তি। এইজন্য তিনি বিদ্যুৎ কোম্পানির সমস্ত ক্ষতিপূরণও মিটিয়ে দেন।

মিস্টার স্মিথের একজন মেয়েও ছিল। তার নাম ছিল লুসেন, কিন্তু সবাই তাকে পাজী বলে ডাকতো। তবে এই গল্পে তার বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই। এইজন্য তার কথা আবার গল্পের শেষে বলা হবে।

একবার লন্ডনের বন্দরগুলিতে ইঁদুরের অত্যাচার ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। ইঁদুরগুলি ছিল ভীষণ ভয়ঙ্কর প্রজাতির। তাদের ঠাকুরদা-পিতামহরা চা, আদা, আর চালের ব্যাগে লুকিয়ে জাহাজে করে হংকং থেকে এসেছিল। কেননা ইংল্যান্ডে পর্যাপ্ত পরিমাণে শস্য উৎপন্ন হতো না, এইজন্য সেখানকার প্রয়োজন মেটানোর জন্য অন্য দেশ থেকে শস্য আমদানি করা হতো। বিদেশ থেকে আনা প্রায় সমস্ত শস্য ও খাদ্যদ্রব্য ইঁদুররা হজম করে ফেলতো। তারা কানাডার গম আর হল্যান্ডের পনীর খেত। আর্জেন্টিনার টাটকা বীফ খেত। তারা ইরান থেকে আসা সুন্দর সুন্দর কার্পেটগুলি কেটে কেটে সেগুলি দিয়ে নিজেদের বিছানা বানাতো। ইঁদুররা খাদ্যদ্রব্য হজম করার পরে চীন থেকে আসা রেশমী রুমাল দিয়ে নিজেদের হাত-পা পরিষ্কার করতো

ইঁদুরদের অত্যাচারে লন্ডন পোর্ট অথরিটির চেয়ারম্যান নাজেহাল হয়ে পড়েছিলেন। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সমস্ত মাল প্রথমে বন্দরে নামতো। যতক্ষণে না এই মাল ট্রেন, ট্রাক আর ঠেলায় করে নিয়ে যাওয়া হতো ততক্ষণ এর সমস্ত দায়-দায়িত্ব ছিল চেয়ারম্যানের। এইজন্য ইঁদুররা যা খেত তার ক্ষতিপুরণ দিতে হতো চেয়ারম্যানকেই। সে সময় চেয়ারম্যানের পদ ছিল দারুণ সম্মানজনক এবং তার অফিসের খ্যাতি ইংল্যান্ডের মহারানীর মহল ‘বাকিংহ্যাম প্যালেসে’র চেয়েও কোনো অংশে কম ছিল না। ইঁদুর মারার জন্য চেয়ারম্যান লন্ডনের সব থেকে বিখ্যাত ইঁদুর শিকারীকে ডেকে আনেন। কিন্তু সে মাত্র দুইশো ইঁদুরই মারতে পেরেছিল। এর কারণ হল বন্দরের ইঁদুররা ছিল ভীষণ চালাক। এই ইঁদুরদের একজন রাজাও ছিল যে মাটির নিচে একটি গভীর গর্তে বাস করতো। বাকি ইঁদুররা তার খাবার জন্য ‘এক সে বড়কর এক সুস্বাদু খাবার নিয়ে আসতো। তার জন্য সুইজারল্যান্ডের ক্রীম-চকলেট, ফ্রান্সের কিমা আর মালজিয়ার্স থেকে পাকা খেজুর আনা হতো। সমস্ত ইঁদুর তাদের রাজার আদেশ মেনে চলতো আর নির্দেশমতো কাজ করতো। যদি কখনো কোনো ইঁদুর খাঁচা বা ইঁদুরমারা কলে ধরা পড়তো তবে রাজার বিশেষ দূত বাকি ইঁদুরদের এই বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দিত। রাজার দশ হাজার বাহাদুর আর দুঃসাহসী ইঁদুরদের একটি বাহিনী ছিল। এই সেনাবাহিনী যে কোনো পশুর সাথে মোকাবিলা করার অদম্য সাহস রাখতো। একটি কুকুর আরামে একটি বা দুটি ইঁদুরকে মারতে পারে। কিন্তু যদি তার ওপরে একসাথে একশো ইঁদুর হামলা করে, তবে সম্ভবত ও তিন-চারজনকেই মারতে পারবে। কিন্তু শেষে ও নিজেই শহীদ হয়ে যাবে। যে সমস্ত ইঁদুরদের সবচেয়ে ছুঁচোলো দাঁত ছিল তাদের বিশেষভাবে ট্রেনিং দেওয়া হতো। এই ইঁদুররা তাদের দাঁতের সাহায্যে যে কোনো ইঁদুরমারা কল অথবা খাঁচার তারকে কেটে বন্দি ইঁদুরদের মুক্ত করাতো। মাত্র এক মাসের মধ্যে এই ইঁদুররা একশো একাশিটি বেড়াল আর ঊনপঞ্চাশটি কুকুরকে মেরে ফেলে। প্রচুর কুকুর আর বেড়াল ওদের আক্রমণে এমন ক্ষত-বিক্ষত হয় যে যদি দূর থেকে তাদের নাকে ইঁদুরের গন্ধ আসতো তবে তারা লেজ গুটিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতো। সাতশো বেয়াল্লিশটি ইঁদুরকে তারা ছয়শো আঠারোটা ইঁদুর মারা কল থেকে মুক্ত করেছিল। এর ফলে ইঁদুর শিকারীরা তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। খাবারের সাথে ইঁদুর মারা বিষ মিশিয়ে বন্দরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। রাজা ইঁদুর তৎক্ষণাৎ আদেশ জারি করে, ‘ইঁদুররা শুধুমাত্র সেই খাবারই খাবে যেগুলো সরাসরি বস্তা, কৌটা কিংবা ড্রাম থেকে বার হয়েছে’। এই আদেশ জারির পরে দেখা গেল কেবল সেই সব ইঁদুরই অকালে মারা গেছে যারা রাজার আদেশ অমান্য করেছিল। কুকুর, বিড়াল আর ইঁদুরমারা কলের মত বিষও ইঁদুরদের বিনাশ করতে ব্যর্থ হয়। এসবের ব্যর্থতার পরে চিন্তিত লন্ডন পোর্ট অথরিটির চেয়ারম্যান ইঁদুর বিনাশের জন্য ভাইস চেয়ারম্যানের পরামর্শে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেন। ইংল্যান্ডের সব সংবাদপত্রে পুরো পাতা জুড়ে বড় বড় হরফে সেই বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল যাতে সকলেই সেটা পড়তে পারে। এই বিজ্ঞাপনের পাশে সংবাদ পত্রে প্রকাশিত বাকি প্রতিযোগিতাগুলি একদম ফালতু মনে হচ্ছিল। লন্ডন পোর্ট অথরিটির চেয়ারম্যান বন্দরগুলিকে ইঁদুরদের হাত থেকে যে মুক্ত করাবে তাকে এক লাখ পাউন্ড পুরস্কার দেওয়ার পাশাপাশি তার সাথে চেয়ারম্যানের একমাত্র সুন্দরী কন্যার বিবাহ (যদি ব্যক্তিটি পূর্বেই বিবাহ করে। থাকে তবে বিবাহের অনুমতি পাওয়া যাবে না। তখন তার স্ত্রীকে একটি হীরের বালা উপহার দেওয়া হবে) দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। বিজ্ঞাপনে এক লাখ পাউন্ডের ছবির পাশাপাশি চেয়ারম্যানের মেয়ের ছবিও ছাপা হয়েছিল।

এই প্রতিযোগিতায় যোগদানের ক্ষেত্রে একটি অসুবিধা ছিল, সেটা হল। প্রতিযোগীকেই ইঁদুরমারার সমস্ত যন্ত্রপাতি আনতে হবে। এই কারণেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া এক বিরাট ব্যয় সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতসব সত্ত্বেও হাজার হাজার লোক তাদের ভাগ্য যাচাই করার জন্য এতে অংশ নিয়েছিল। বিজ্ঞাপন প্রকাশের দু’দিন পরে চেয়ারম্যানের নামে এতো চিঠি আসে যে সেগুলি বইবার জন্য তিনজন ডাকবাহকের প্রয়োজন দেখা দেয়। চেয়ারম্যানকে এতো লোক টেলিফোন করে যে শেষে গরম হয়ে টেলিফোনের তারই গলে যায়। পরবর্তী কয়েক মাসে ভাগ্য যাচাই করতে এসেছিলেন কেমিষ্ট, জাদুগর, বিজ্ঞানী, জীব বিজ্ঞানী, সাধু-সন্ন্যাসী থেকে শুরু করে বাঘ শিকারী পর্যন্ত। কিন্তু কোনো মহারথীই সামান্য কিছু ইঁদুরকে মারা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি। বরং এদের হস্তক্ষেপের দরুন জাহাজ থেকে মাল নামানোতে বাধা পড়েছিল।

এই ভাগ্য পরীক্ষার খেলায় মিস্টার স্মিথের চার ছেলেও অংশ নিয়েছিল। বড় ইঁদুরমারা কল বানাবার কথা চিন্তা করে। সে যেভাবে স্কুলে শিক্ষকদের ফাঁসাতো, সেভাবেই ইঁদুরদের ফাঁসাবার প্রতিজ্ঞা করে। সে বন্দরের চারপাশে পুরনো চিনের অনেক কৌটা পড়ে থাকতে দেখে সেগুলি দিয়ে এক বিশেষ ধরনের ইঁদুরমারা কল তৈরি করে। ইঁদুররা কৌটার ভেতরের সুগন্ধ শুঁকে তার মধ্যে প্রবেশ করলে কোঁটার ওপরের ঢাকনা বন্ধ হয়ে যাবে। জিম এই বিশেষ কল তৈরির জন্য পিতার কাছ থেকে দশ পাউন্ড ধার নেয়। টিনের কৌটা প্রস্তুতকারী এক বেকার মিস্ত্রীকে সে এই কল বানাবার জন্য ঠিক করে। দুজনে মিলে রাতদিন পরিশ্রম করে এক হাজার তিনশো চুরানব্বইটি ইঁদুরমারা কল তৈরি করে। অবশ্য এদের মধ্যে সতেরোটিতে কিছু খুঁত থাকায় সেগুলিকে বাতিল করতে হয়।

জিম সমস্ত ইঁদুরমারা কলগুলিকে তার পিতার তরকারির ঠেলায় চাপিয়ে ভাইস চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করতে রওনা হয়। ভাইস চেয়ারম্যান স্বয়ং এই ইঁদুর নির্মূল অভিযানের দেখাশোনা করছিলেন। তিনি বললেন, ‘এই কলগুলি সব বন্দরের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এইজন্য প্রথমে আমরা এগুলোকে কেবলমাত্র একটি বন্দরেই ট্রাই আউট করে দেখবো। এর জন্য ‘ওয়েস্ট ইন্ডিয়া’ নামের একটি বন্দরকে বাছা হয়। এখানে জামাইকা এবং তার আশেপাশের দ্বীপ থেকে জাহাজ আসে। সঙ্গে করে আনে। চিনি, মদ, মধু আর কলা। এখানকার ইঁদুররা ছিল ভীষণ চালাক এবং সাবধানী। জিম অর্ধেক কলে পনীর আর বাকিটাতে মাংসের টুকরো রেখে বন্দরে ছড়িয়ে দেয়। প্রথম রাতে নয়শো আঠারোটি ইঁদুর ধরা পড়ে। প্রথম রাতের সাফল্য দেখে জিম মনে করে যে অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা সেই পাবে। কিন্তু দ্বিতীয় রাতে মাত্র তিনটি ইঁদুর জিমের পাতা ফাঁদে পা দেয়, আর তৃতীয় রাতে মোটে দুটি। ইঁদুরদের রাজা সমস্ত ইঁদুরদের টিনের কৌটো থেকে দশ হাত দূরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছিল। এরপরে শুধুমাত্র নির্দেশ অমান্যকারী এবং বোকা ইঁদুররাই জিমের কলে ধরা পড়েছিল। চতুর্থ রাতে কলগুলিকে ভিক্টোরিয়া বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও কেবলমাত্র চারটি ইঁদুর ধরা পড়ে। ইঁদুরদের রাজার নির্দেশ দূর-দূর পর্যন্ত। পৌঁছে গিয়েছিল। তাই বিশেষ সাফল্য না পেয়ে জিম মুখ ব্যাজার করে ফিরে আসে। স্কুলের দুষ্টু ছেলেরা এরপর থেকে জিমকে ‘টিনের কৌটোর ইঁদুর’ বলে ডাকতো।

মেজো ছেলে চার্লস স্মিথের পরিকল্পনা ছিল কিছুটা ভিন্ন। সে এমন এক বিষ আবিষ্কার করলো যাতে না ছিল কোনো স্বাদ, আর না কোনো গন্ধ। আমি তোমাদের সেটা বানাবার কৌশল অবশ্য জানাবো না। কেননা এমনও তো হতে পাবে যে কোনো অপরাধী এই গল্প পড়ে, সেই বিষ তৈরি করে লোকদের মেরে ফেলতে পারে। এরপর চার্লস এমন এক পদার্থ প্রস্তুত করে যেটা থেকে রাকফোর্ট পনীরের সুগন্ধ আসতো। রাকফোর্ট পনীর হলো ফ্রান্সের সবচেয়ে বিখ্যাত পনীর। বন্দরের ইঁদুরের এই পনীর খেতে ভীষণ ভালোবাসতো। চার্লস তার পিতার কাছ থেকে কুড়ি পাউন্ড যার নেয় আর তা দিয়ে প্রচুর পরিমাণে সস্তা এবং নিম্নমানের পনীর কিনে আনে। প্রথমে সে পনীরের ছোট ছোট টুকরো করে। তারপর সেগুলোকে সেই বিষের মধ্যে ডুবিয়ে দেয় এবং সবশেষে ওপরে রাকফোর্ট পনীরের গন্ধ ছিটিয়ে দেয়। তারপর টুকরোগুলিকে দশ হাজার পিচ বোর্ডের বাক্সে রাখা হয়। চার্লস ভাবে যদি টুকরোগুলিকে এমনিই সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয় তবে ইঁদুরদের সন্দেহ হতে পারে। কিন্তু বাক্সবন্দি পনীরে বিষ মাখা রয়েছে এটা ইঁদুররা সন্দেহ করতে পারবে না। বাক্সগুলি ছিল পাতলা পিচবোর্ডের তৈরি যাতে ইঁদুররা সহজেই ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।

দু’জন লোক ঠেলা ভরে সেই বাক্সগুলিকে বন্দরের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে দিল। চার্লস তাদের পিছে পিছে গিয়ে সেই বাক্সগুলির ওপরে পনীরের গন্ধযুক্ত পদার্থটি ছিটাতো। লন্ডনের পূর্বভাগ সেদিন পনীরের গন্ধে ম-ম করছিল। সূর্য অস্ত যাবার পরে ইঁদুররা নিজেদের গর্ত থেকে বার হয়ে আসে আর তারা একে অপরকে বলে, ‘এটা তো কোনো ভালো পনীরের গন্ধ বলে মনে হচ্ছে। এর একটি ছোট বাক্সের গন্ধ, এক পেটি সাধারণ পনীরের চেয়েও বেশি।’ ইঁদুররা পনীর পেট ভরে খেল, আর কিছুটা পনীর রাজার জন্য নিয়ে গেল। রাজার ভাগ্য ভালো ছিল, এখনি সে ভরপেট বাদাম খেয়েছিল। তাই ‘পরে খাব’ বলে ইঁদুরদের রাজা সেই পনীর রেখে দেয়। কিছু সময় পরেই বিষ তার খেল দেখাতে শুরু করে। ভোর তিনটে থেকে ইঁদুরদের গণ মরণের পালা শুরু হয়। রাজা ইঁদুরের সন্দেহ সরাসরি সেই সুগন্ধিত পনীরের ওপর পড়ে। সে তার বিশেষ দূতদের দ্বারা এই পনির না খাবার বার্তা সমস্ত ইঁদুরদের কাছে পৌঁছে দেয়।

রাজকারাগারে এক নির্দয় ইঁদুর বন্দি ছিল, সে নিজের সন্তানকে খাবার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড ভোগ করছিল। রাজার আদেশে তাকে রাজসভায় এনে সেই পনীর খেতে বলা হয়। পরীর খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ইঁদুরটি ছটফট করতে করতে মারা যায়। এ থেকে গনীর যে বিষাক্ত সেটা প্রমাণ হয়ে যায়। পরদিন সকালে চার হাজার পাঁচশো চৌদ্দটি মৃত ইঁদুরকে পাওয়া যায়। অধিকাংশ ইঁদুররা গর্তের মুখেই মৃত পড়েছিল। চেয়ারম্যান এসব দেখে ভীষণ খুশি হয় এবং চার্লসকে আরো পনীর কেনার পয়সা দেন। কিন্তু দু’দিন পরে আট হাজার বাক্সের মধ্যে মাত্র দুটি বাক্সকে খোলা অবস্থায় পাওয়া যায়। বিষয়টা পরিষ্কার, রাজা ইঁদুরের নির্দেশে ইঁদুররা সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। চার্লস একেবারে ভেঙে পড়ে। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সে প্রতিযোগিতাতে জিতবেই। এই আশায় সে বিয়ের আংটির অর্ডার দিয়েছিল আর চার্চের পাদরীকে বিয়ে করাবার জন্য পত্র লিখেছিল। চার্লস স্বর্ণকার আর পাদরীকে পুনরায় পত্র লিখে জানায় যে সে বর্তমানে বিয়ে করার মত পরিবর্তন করেছে। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হল, রাকফোর্ড পনীরের গন্ধ তার চামড়ায় মাসখানেক লেগে ছিল। তাই তাকে স্কুল কর্তৃপক্ষ স্কুলে ঢুকতে দিত না এবং বাড়িতেও তাকে কয়লা রাখার ঘরে শুতে হতো।

বড় তিনভাই ব্যর্থ হবার পরে ছোটভাই জ্যাক স্মিথ ইঁদুর নির্মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। সে পিতার কাছ থেকে তিরিশ পাউন্ড ধার নেয়, কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিল না। বাকি খরচ মেটাবার জন্য সে নিজের তৈরি ওয়ারলেস সেটগুলি আমার কাছে বিক্রি করে এবং কিছু টাকা আমার থেকেও যার নেয়। কারণ জ্যাকের পরিকল্পনাটি ছিল বেশ ব্যয়বহুল। জ্যাক প্রচুর পরিমাণে মিহি লোহার গুড়ো কিনে সেগুলিকে আটা এবং চিনির সাথে মিশিয়ে বিস্কুট তৈরি করে। বিস্কুটগুলিকে বন্দরের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রথমে ইঁদুররা তো সেগুলোকে ছোঁয়নি পর্যন্ত। কিন্তু পরে যখন তারা দেখলো যে বিস্কুট থেকে কোনো ক্ষতি হচ্ছে না তখন পেটভরে বিস্কুট খেল। ইতিমধ্যে জ্যাক সাতটি বিশাল আকারের বিদ্যুৎ চুম্বকের ব্যবস্থা করে। এগুলিকে বিভিন্ন বন্দরে রাখা হয়। প্রতিটা বিদ্যুতের চুম্বককে এক একটি গভীর গর্ভের মধ্যে রাখা হয়। এরপর বিদ্যুতের তার লাগানো হয়, যাতে জেলার রেল আর লন্ডন রেলের বিদ্যুৎ দ্বারা চুম্বকগুলিকে সক্রিয় করা যায়।

যখন ইঁদুররা প্রচুর লোহার গুঁড়ো দিয়ে তৈরি বিস্কুট খেয়ে ফেলে তখন চুম্বকের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহ দিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য তার আগে লোহা, স্টীল আর নিকেলের সমস্ত বস্তুকে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছিল। সমস্ত জাহাজ লোহা দিয়ে তৈরি হয় তাই ওগুলোকেও মোটা দড়ি দিয়ে ঘাটের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল। সেই রাত্রে বন্দরের সমস্ত কর্মচারীদের বিশেষ ধরনের পেরেক ছাড়া জুতো পড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ভাইস চেয়ারম্যানের কথা ভিন্ন, কেননা তিনি ডিউক ছিলেন। তাই তার জুতোয় সোনার পেরেক লাগানো থাকতো।

মধ্যরাতের পরে জ্যাকের চুম্বকগুলিতে বিদ্যুৎ প্রবাহ দেওয়া হলে প্রথমে কিছু জং পড়া পেরেক আর টিনের কৌটাই চুম্বকগুলির প্রতি আকর্ষিত হয়। এরপর কিছু ইঁদুর এসে তাতে আটকায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই চুম্বক রাখা গর্তগুলি ইঁদুর দিয়ে কানায় কানায় ভর্তি হয়ে যায়। প্রথমে সেসব ইঁদুররাই আটকে ছিল যারা গর্তের বাইরে ছিল। তবে গর্তের ভেতরের ইঁদুররা বাইরে বার হওয়া মাত্র শক্তিশালী চুম্বক তাদেরকে টেনে নিচ্ছিল। ধীরে ধীরে প্রচুর সংখ্যক ইঁদুর ধরা পড়ে।

ইঁদুরদের রাজা এই গন্ডগোলের ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগে অনুভব করছিল যে কোনো অদৃশ্য শক্তির টান গর্তের একটি দেওয়ালের দিকে আসছিল। সে তার দূতদের এই গন্ডগোলের খবর জানার জন্য বাইরে পাঠায়। কিন্তু তারা আর ফিরে আসে না। শেষে পরিস্থিতি জানার জন্য সে নিজেই বাইরে বেরিয়ে এলে শক্তিশালী চুম্বক তাকেও নিজের কাছে টেনে নেয়। এরপর গর্তগুলি জল দিয়ে ভরে দেওয়া হয়, যাতে বেঁচে থাকা ইঁদুররা জলে ডুবে মারা যায়। মৃত ইঁদুরদের যখন ওজন করা হলো তখন তাদের ওজন দাঁড়ালো প্রায় একশো পঞ্চাশ টন। মৃত ইঁদুরদের গোনাতো সম্ভব ছিল না, তবে অনুমান করা হয় প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ ইঁদুর সে রাত্রে মারা গিয়েছিল।

পরের রাত্রে আবার চুম্বকগুলিতে বিদ্যুৎ প্রবাহ দেওয়া হয়। এদিন প্রায় একশো টন ইঁদুর ধরা পড়ে। ইঁদুরদের রাজা গত রাতেই মারা গিয়েছিল, এজন্য তাদের সঠিক রাস্তা দেখাবার কোনো নেতা ছিল না। তৃতীয় রাত্রেও প্রচুর সংখ্যক ইঁদুর ধরা পড়ে। তারপরেও সে সমস্ত ইঁদুর প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল তারা ভয় পেয়ে বন্দর অঞ্চল ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যায়। অর্থাৎ বন্দরগুলি ইঁদুরবিহীন হয়ে যায়। অনেক চেষ্টার পরেও চতুর্থ রাত্রে একটিও ইঁদুর ধরা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী কিছুদিন কুকুর আর বিড়ালের সাহায্যে ইঁদুর ধরার চেষ্টা হলেও সে কাজ সফল হয়নি।

প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে জ্যাক স্মিথ এক লাখ পাউন্ড পায় এবং তার বিয়ে চেয়ারম্যানের সুন্দরী মেয়ের সাথে সম্পন্ন হয়। চার্চে গিয়ে বিয়ে তার পছন্দ ছিল না। জ্যাকের বোনের বিয়ে হয় ডিউকের সাথে। এই কারণে সে ডাচেজ হয়ে যায়। পরবর্তীতে জ্যাক বি বি সি’র ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে চাকরি পায় এবং তিন ভাইকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করে।

picture credit uttarbanga sambad.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *