হাজি আর ব্যবসায়ী
(তুরস্কের লোককথা)

পিনাকী রঞ্জন পাল : এক ছিলেন হাজি। তিনি প্রতিদিন সকালে উচ্চস্বরে আল্লার কাছে প্রার্থনা করতেন—”হে আল্লাহ্, তুমি আমাকে দয়া করে ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা দাও।”‘ আর সঙ্গে এটা বলতেন, ‘”যদি তুমি আমাকে ৯৯৯টি স্বর্ণমুদ্রাও দাও তবে কিন্তু আমি তা গ্রহণ করব না।”

হাজির পাশের বাড়িটি ছিল এক ধনবান ব্যবসায়ীর। তিনি প্রতিদিন হাজির প্রার্থনা শুনতেন। একদিন সেই ব্যবসায়ীর মনে হাজিকে যাচাই করে দেখার ইচ্ছে হল। যদি হাজি ৯৯৯টি স্বর্ণমুদ্রা পান তবে তা তিনি গ্রহণ করেন কি না তাই যাচাই করতে চান ব্যবসায়ী।

একটি থলিতে ১৯৯টি স্বর্ণমুদ্রা রেখে পরদিন হাজি প্রার্থনায় বসলে ব্যবসায়ী চুপচাপ নিজের বাড়ির ছাদ থেকে তার সামনে থলিটি ছুঁড়ে দেন এবং লুকিয়ে হাজির কার্যকলাপ লক্ষ্য করতে থাকেন।

হাজি থলিটি টেনে সেটা খুলে ভেতরে স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি দেখে আনন্দে নেচে ওঠেন। গুণে দেখেন তাতে ৯৯৯টি স্বর্ণমুদ্রা আছে। তিনি বললেন, ‘”হে প্রভু তুমি সত্যিই দয়াবান। যখন তুমি আমার একথা শুনেছ, তখন পরবর্তীতেও শুনবে আশা করি। আর ৯৯৯টি স্বর্ণমুদ্রা যখন দিয়েছ, তখন আরও একটি তাড়াতাড়িই পাঠিয়ে দেবে। কেননা, তোমার ভাণ্ডারে তো ধনসম্পদের অভাব নেই।”‘ এবার অবশ্য এটা বললেন না যে, “৯৯৯টি স্বর্ণমুদ্রা তিনি গ্রহণ করবেন না।”

ব্যবসায়ী যখন দেখলেন হাজি স্বর্ণমুদ্রাগুলি নিজের কাছেই রেখে দিলেন, তখন তিনি ভীষণ সমস্যায় পড়ে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পরে হাজির দরজায় করাঘাত করলেন। দরজা খুলে হাজিকে দেখে ব্যবসায়ী সেলাম করে বললেন, ‘”আমি আপনার সঙ্গে তামাশা করেছিলাম। আপনার কাছে স্বর্ণমুদ্রার যে থলি আছে সেটা অনুগ্রহ করে ফিরিয়ে দিন। ওটা আমার।”

“আমি আপনার থেকে কোনদিনও কোন স্বর্ণমুদ্রার থলি নিইনি’” – হাজি উত্তর দেন।

এ কথা শুনে ব্যবসায়ী রেগে গিয়ে বলেন, “‘মহাশয়, কথা ঘোরাবেন না। আপনি প্রত্যেকদিন আল্লার কাছে প্রার্থনা করতেন, যেন তিনি আপনাকে ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা দেন। আর যদি ৯৯৯টি দেন তবে আপনি সেগুলি গ্রহণ করবেন না। আপনি রোজ উচ্চস্বরে প্রার্থনা করতেন আর প্রতিবেশী হওয়ার জন্য আমি তা শুনতাম। আপনার পরীক্ষা নেওয়ার জন্য আমিই ৯৯৯টি স্বর্ণমুদ্রা থলিতে ভরে নিজের ছাদ থেকে আপনার সামনে ছুঁড়ে ফেলি। আমি দেখতে চেয়েছিলাম যে আপনি সেটা গ্রহণ করেন কি না।”

“আমার মত প্রভু-বিশ্বাসীর পরীক্ষা নেওয়ার জন্য আপনি ৯৯৯টি স্বর্ণমুদ্রা আমার ঘরে ছুঁড়ে ফেলেছেন এটা মেনে নিতে আমি প্রস্তুত নই। আমার প্রতিদিনের প্রার্থনায় খুশি হয়ে প্রভু স্বয়ং আমাকে এই উপহার দিয়েছেন। স্বর্ণমুদ্রা ভরা থলি এখন আমার। আপনি তো আমার কাছ থেকে নিতে পারবেন না’” – হাজি বললেন।

ব্যবসায়ী তাঁর কথায় অসম্মতি জানিয়ে বলেন, ‘”আপনার এই বেইমানির জন্য আমি আপনাকে কাজির কাছে নিয়ে যাব। তিনি এর উচিত বিচার করে বলবেন স্বর্ণমুদ্রাগুলি কার।”

প্রথমে হাজি রাজী না হলেও পরে বলেন, “ঠিক আছে, আমি কাজির কাছে যেতেও রাজি আছি। কিন্তু আপনি তো দেখতেই পাচ্ছেন আমি বুড়ো হয়েছি। অতদূরে যাব কেমন করে ?”

এ কথা শুনে ব্যবসায়ী দৌড়ে গিয়ে দুটো শক্তসমর্থ গাধা নিয়ে আসেন। একটা নিজের জন্য আর অন্যটা হাজির জন্য। এবার হাজিকে যাবার জন্য তৈরি হতে বললে হাজি বলেন, ‘”আপনি তো দেখতেই পাচ্ছেন যে আমি কত নোংরা আর পুরনো পোশাক পরে আছি। এগুলো পরে আমি কাজির বিচারালয়ে কিভাবে যাব?”

ব্যবসায়ী হাজিকে যে – কোন মূল্যে কাজির কাছে নিয়ে যেতে চান। তাই তিনি নিজের ঘরে গিয়ে রেশমের দামী পাজামা – কুর্তা আর একটা কোট নিয়ে আসেন। হাজি সেগুলি গায়ে দিয়ে গাধার পিঠে চড়ে ব্যবসায়ীর সঙ্গে কাজির বিচারালয়ের পথে রওনা দেন।

‘”কিসের মামলা ?” কাজি জানতে চান। ব্যবসায়ী সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন।

এরপর হাজির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘”কাজি সাহেব, এই ব্যবসায়ী আমার প্রতিবেশী। এটা হওয়া অসম্ভব নয় যে, আমার প্রার্থনায় খুশি হয়ে আল্লা আমাকে ৯৯৯টি স্বর্ণমুদ্রা দেন। আর আমি সেগুলি উচ্চস্বরে গুনছিলাম। তখন ইনি তা শুনেছেন এবং দেখেছেন। স্বর্ণমুদ্রার ওপরে মিথ্যা দাবি করে ইনি আমার প্রাপ্ত বস্তু হরণের চেষ্টা করছেন।”

হাজির কথা শুনে ব্যবসায়ী তেলে – বেগুনে জ্বলে ওঠেন। তিনি এর প্রতিবাদ জানিয়ে কাজিকে বলেন, ‘”কাজি সাহেব, আমি হাজি সাহেবের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ৯৯৯টি স্বর্ণমুদ্রার থলি তার ঘরে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম এটা যাচাই করতে যে, সেগুলি তিনি গ্রহণ করেন কি না। কেননা, হাজি সাহেব প্রতিদিন প্রার্থনায় বলতেন যে, ১০০০-এর স্থানে ৯৯৯টি হলেও তিনি তা গ্রহণ করবেন না।”

তখন হাজি কাজিকে বলেন, ‘”আমি আগেই বলে রাখছি যে এই ব্যক্তি ভীষণ ধূর্ত। এরপরেই হয়ত বলে বসবেন যে পোশাক আমি পরে আছি, সেটাও তাঁর।”

“কাজি সাহের বাস্তবে এগুলো আমারই পোশাক। আমি হাজি সাহেবকে পরার জন্য ধার দিয়েছি।” ব্যবসায়ী তৎক্ষণাৎ জবাব দেন।

হাজি পুনরায় বলেন, “‘দেখলেন তো, এবার তিনি বলবেন যে গাধায় চড়ে আমি এখানে এসেছি সেটাও তাঁর। কিন্তু সবাই জানে যে আমার নিজস্ব গাধা আছে।”

ব্যবসায়ী চিৎকার করে বলেন, ‘”হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই গাধাও আমার। আমি সত্যি সত্যিই বলছি।”

এসব কথাবার্তা শুনে কাজি ভীষণ ক্ষেপে যান। তিনি ব্যবসায়ীকে বলেন, “তুমি ভীষণ ধূর্ত ব্যক্তি। একজন সরল মানুষকে ফাঁসিয়ে তাঁর ধন আর সম্পত্তি কব্জা করতে চাও। তুমি এখান থেকে এক্ষুনি চলে যাও, নইলে আমি তোমাকে কঠোর শাস্তি দেব।”

কাজির বিচার শেষে হাজি আনন্দের সঙ্গে গাধায় চড়ে নিজের ঘরে ফিরে আসেন। বাড়ি এসে তিনি ব্যবসায়ীকে ডেকে পাঠান। ব্যবসায়ী এই ঘটনার পর ভীষণ উদাস আর দুঃখী ছিলেন। ব্যবসায়ী এলে হাজি তাকে ১৯৯টি স্বর্ণমুদ্রা, গাধা আর রেশমের নামী পোশাক সব ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, “এগুলো আপনি নিয়ে যান আর ভবিষ্যতে কখনও আল্লার নামে তার কোন ভক্তকে লোভ দিয়ে তার উক্তিকে ডিঙিয়ে যাবার চেষ্টা করবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *