শহর জলপাইগুড়ি কি চোর, ছিনতাইবাজদের আখড়া হয়ে উঠেছে? জলপাইগুড়ি শহর কি কার্যত দুষ্কৃতীদের দখলে। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া একের পর ঘটনাগুলো এই প্রশ্ন কে উস্কে দিচ্ছে। এনিয়েই এই বিশেষ প্রতিবেদন।
জলপাইগুড়ি শহরে অপরাধমূলক কাজকর্মের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন কোন না কোন অপরাধমূলক কাজের সাক্ষী থাকছে শহরবাসী। শুক্রবার দুপুরে শহরের বেগুনটারী এলাকার এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে বার হতেই ছিনতাইবাজদের কবলে পড়ে সেই টাকা খোয়ান এক কৃষক। এরপর রবিবার শহরের শক্তি নগরে বিকেলে এক গৃহবধূকে বাড়িতে ঢুকে দুষ্কৃতীরা ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে সোনার হার ছিনতাই করে পালিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। রবিবার রাতে জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশনে কিষান রেলের দুটি বগির মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগের তামার তার কেটে নেয় দুষ্কৃতীরা। সোমবার রাতে জলপাইগুড়ি জেলা শাসকের অফিসে কর্মরত এক কর্মচারীকে মারধোর করে প্রায় লক্ষাধিক টাকার সোনার গয়না ছিনিয়ে নেয় দুষ্কৃতীরা। মঙ্গলবার ভোর রাতে শহরের ডিবিসি রোডের একটি ব্যাঙ্কের এটিএম ভেঙে টাকা চুরির চেষ্টা করে দুষ্কৃতীরা। মঙ্গলবার দুপুরে শহরের উকিল পাড়া মোড়ে এক মহিলাকে পুলিশের লোক পরিচয় দিয়ে সোনার গয়না নিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীদের দল।
দৃশ্য নং এক

শুক্রবার দুপুরে জলপাইগুড়ি শহরের বেগুনটারি এলাকার এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে এসে ষাট হাজার টাকা তোলেন এবং পিঠে থাকা ব্যাগে রাখেন দশরথ দাস। দশরথ বাবু দাস পাড়া ফার্মারস ক্লাবের সম্পাদক তথা কৃষক। তিনি ফার্মারস ক্লাবের বিভিন্ন কাজে খরচের জন্য ওই টাকা তুলেছিলেন। এরপর ব্যাংক থেকে বেরিয়ে রাস্তার অপরদিকে রাখা নিজের বাইক নিতে গেলে একজন যুবক ডেকে দশরথ বাবুকে বলেন একটু দাঁড়ান রুমাল পরে গেছে। এরপর ওই যুবক একটি রুমাল রাস্তা থেকে তোলার পর বলে, আপনার গায়ে এত নোংরা লেগে আছে কেন? যুবকের কথায় দশরথ বাবু লক্ষ করেন তার জামায় জলে ভেজানো মুড়ি বা বিস্কুটের গুঁড়োর মতো কোনো কিছু লেগে আছে। মনে হয় কেউ পেছন থেকে ঢেলে দিয়েছে। তিনি এই নোংরা কোথা থেকে তার জামায় লাগলো চারিপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু বুঝতে পারেন না কোথা থেকে লাগলো। তিনি ব্যাংকের টয়লেটে গিয়ে নিজেকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করেন। জলপাইগুড়ি শহরে তার আরো কিছু কাজ বাকি ছিল, যা এই নোংরা শার্ট পরে করা সম্ভব নয়। তাই তিনি নতুন জামা কেনার জন্য ব্যাগ থেকে টাকা বার করতে গিয়ে দেখেন পিঠের ব্যাগে রাখা ষাট হাজার টাকা নেই। তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি ছিনতাইবাজদের খপ্পরে পড়েছিলেন এবং তারাই তার এই সর্বনাশটি করেছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে দশরথ বাবুর। তিনি এরপর ব্যাংকে গিয়ে বিষয়টি জানান এবং ব্যাংক ও ওই এলাকার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখেন। তিনি বলেন, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে একজন যুবক তার পিঠের ব্যাগ থেকে টাকা বার করে নিজের পকেটে রাখছে। তিনি বুঝতে পারেন রুমাল তোলা যুবক আর ওই টাকা বার করা যুবক দুইজন মিলেই এই কাজ করেছে। সিসি ক্যামেরায় ওই ছিনতাইবাজদের মুখ পরিষ্কার দেখা গেছে বলে দাবি দশরথ বাবুর। এরপরেই ষাট হাজার টাকা ছিনতাইবাজদের হাতে খোয়ানো দশরথ বাবু শনিবার জলপাইগুড়ি কোতয়ালী থানার দ্বারস্থ হন। তিনি নিজের খোয়ানো টাকা ফেরতের পাশাপাশি এই ধরনের দুষ্কৃতীদের গ্রেপ্তার করে কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
দৃশ্য নং দুই

গলায় ছুরি ঠেকিয়ে এক মহিলার গলার সোনার চেন ছিনতাই এর অভিযোগ উঠল জলপাইগুড়ি শহরে। রবিবার বিকেলে ঘটনাটি ঘটে জলপাইগুড়ি শহরের ২১নম্বর ওয়ার্ডের শক্তিনগরে ভাওয়াল বাড়িতে। জানা গেছে, দুই দুষ্কৃতী বাইক নিয়ে এসেছিল। এরপর ওই বাড়ির দরজা খোলা থাকায় দুজই ঘরে ঢুকে পরে দুই দুষ্কৃতী। এরপর ভাওয়ার বাড়ির গৃহবধূ দুর্গা ভাওয়ালের গলায় ধারালো অস্ত্র তথা ছুরি ঠেকায় হয়। এরপর গলার চেন ছিনতাই করে দুই দুষ্কৃতী। আরও সোনা ও টাকা ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে দুজন। কিন্তু চিৎকার দিতেই দুই দুষ্কৃতী দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়ে বাইক নিয়ে চম্পট দেয়। ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন কোতোয়ালি থানার পুলিশ। দিনের বেলায় এই ঘটনায় পুলিশের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাড়ির মালিক পরিতোষ ভাওয়াল বলেন, আমার স্ত্রীর গলায় ছুরি ঠেকিয়ে গলার চেন ছিনতাই করে চম্পট দেয় দুই দুষ্কৃতী। পুলিশকে জানানো হয়েছে।
দৃশ্য নং তিন

কৃষকদের জন্য বিশেষ ট্রেনের দামি যন্ত্রাংশ চুরি জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশন থেকে। এরফলে অনিশ্চিত কিষান রেলের যাত্রা। সম্প্রতি জলপাইগুড়ি, কুচবিহার জেলার বিস্তীর্ন এলাকার চাষীদের জন্য ভিনরাজ্যে স্বল্প ভাড়ায় আলু সহ অন্যান্য কৃষিজাত সামগ্রী পৌঁছে দেবার লক্ষে কিষান রেল নামে একটি বিশেষ ট্রেনের সূচনা করেছে রেল দপ্তর। ইতিমধ্যে এই বিশেষ কিষান রেলের মাধ্যমে এই অঞ্চলের আলু সুদূর ত্রিপুরা রাজ্যে পাঠানো সম্ভব হয়েছিল কৃষকদের। তবে রবিবার রাতের ঘটনার পর এক প্রকার অনিশ্চিত হয়ে পড়লো মঙ্গলবার যাত্রা করার অপেক্ষায় থাকা কিষান রেলের। চুরির ঘটনাটি রেল দপ্তরের নজরে আসতেই জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পরে, সূত্রের খবর ,রেলের একটি কামরার সঙ্গে অপরটিকে যুক্ত করে রাখার যে ভ্যাকুয়াম সিস্টেন থাকে তারই যন্ত্রাংশ দুষ্কৃতীরা কেটে নিয়ে গিয়েছে। যার ফলে এই মুহূর্তে এই কিষান রেলের যাত্রা এক প্রকার অনিশ্চিত হয়ে পরেছে। এলাকাবাসীদের একাংশের বক্তব্য অনুযায়ী এই ঘটনার সঙ্গে স্টেশন লাগোয়া বস্তির কিছু দুষ্কৃতীরাই এমন কাজ করে থাকতে পারে। ইতিমধ্যে চুরি যাওয়া রেলের যন্ত্রাংশের কিছু অবশিষ্ঠ উদ্ধার ও হয়েছে স্থানীয় এক বাসিন্দার বাড়ি থেকে। রেল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রেলের বিভাগীয় ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দল খুব শীঘ্রই জলপাইগুড়ি পৌঁছে ক্ষতিগ্রস্ত কামরাগুলোকে মেরামত করার কাজ শুরু করবেন। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, কয়েকজন দুষ্কৃতীর জন্য গোটা এলাকার বদনাম হচ্ছে। এমন চলতে থাকলে এখান থেকে এই বিশেষ রেল কিভাবে আগামীতে চালাবে রেল দপ্তর।
দৃশ্য নং চার

জলপাইগুড়ি জেলা শাসকের অফিসে কর্মরত অমিত দাস নামের এক কর্মচারীকে মারধোর করে প্রায় লক্ষাধিক টাকার সোনার গয়না ছিনিয়ে নেয় দুষ্কৃতীরা। ঘটনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অমিত বাবু জানান, সোমবার রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ একটি নিমন্ত্রণ বাড়ি থেকে দেশবন্ধু পাড়া সংলগ্ন গৌড়ীয় মঠের পাশের রাস্তা দিয়ে মোটর সাইকেল করে এক হাসপাতাল পাড়ার বাড়িতে ফিরছিলেন। হটাৎ বিশ্ব বাংলা ক্রিয়াঙ্গনের কাছে করলা নদীর সেতুর ওপর কিছু যুবক পথ আটকায় তার। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই যুবকেরা তাকে মারতে শুরু করে। প্রথমে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও পরে আরো কয়েকজন যুবক ধারালো অস্ত্র নিয়ে তার ওপর চড়াও হয়। তখন প্রাণ বাঁচাতে হাতের চারটি সোনার আংটি, মানিব্যাগ, গলার সোনার চেন খুলে ওই যুবকদের হাতে তুলে দেন। জলপাইগুড়ির মতো শহরে এমন ঘটনায় কার্যত স্তম্ভিত জেলা শাসকের দপ্তরের এই কর্মী। তিনি বলেন, বিষয়টি অফিসকে জানিয়েছেন। এরপর পুলিশ কেও জানাবেন।
দৃশ্য নং পাঁচ

জলপাইগুড়ি শহরের অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা ডিবিসিরোড। এখানেই অবস্থিত সিপিএমের জলপাইগুড়ি জেলা কার্যালয় সুবোধ সেন ভবন। পাশেই রয়েছে একটি স্টেট ব্যাঙ্কের এটিএম কাউন্টার। মঙ্গলবার ভোররাতে দুষ্কৃতিরা এই এটিএম কাউন্টারে হানা দিয়ে ভেঙে দেয় সিসিটিভি ক্যামেরা। এরপর শাবল দিয়ে এটিএম এর লকার ভাঙার চেষ্টা করে। কিন্তু সফল হতে না পাড়ায় তারা পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে আসে কোতয়ালী থানার পুলিশ। তারা খবর দেয় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে। তারা এসে দেখেন কিছু জিনিস ভাঙা থাকলেও টাকা সুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।
দৃশ্য নং ছয়

মঙ্গলবার দুপুরে শহরের বাস্ততম উকিল পাড়া মোড়ে এক মহিলাকে পুলিশের লোক বলে পরিচয় দিয়ে আই কার্ড দেখিয়ে রাস্তার পাশে ডেকে নিয়ে শহরের মহামায়া পাড়ার বাসিন্দা শুক্লা দেবীকে বলে, সামনে চেকিং আছে আপনার গয়নাগুলো খুলে দিন না হলে দু হাজার টাকা ফাইন হবে। এরপর সোনার গয়না খুলে ব্যাগে রাখতে বলে দুষ্কৃতীদের দল। সোনার গয়না খুলতেই মহিলার সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করে সোনার গয়না ছিনিয়ে চম্পট দিল চার দুষ্কৃতী। শহরের উকিলপাড়ার মত ব্যস্ততম রাস্তায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় রীতিমতো শহর জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সিসি ক্যামেরায় দুষ্কৃতীদের ছবি উঠে এসেছে। এক দুটি ঘটনা নয়, শহরের কয়েকদিনের মধ্যে একের পর এক চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনায় রীতিমতো পুলিশও ধন্দে। চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনায় আতঙ্কে শহরবাসী। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে আতঙ্কিত শুক্লা চন্দ্র জানান আমাকে পুলিশের একটা ফটো দেখিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে চেকিং হচ্ছে গয়নাগুলো খুলে ফেলুন। এরপর গয়নাগুলো খুলে তিনি ব্যাগে ঢোকাতে যাচ্ছিলেন সেইসময় হাত থেকে গয়নাগুলো কেড়ে নিয়ে বাইকে করে পালিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। ঘটনার পরেই থানায় দারস্থ হলেন ওই মহিলা। জলপাইগুড়ি কোতোয়ালি থানার পুলিশ ঘটনায় তদন্তে।
পরিশেষে বলতে হয়, উপরের ঘটনাগুলো এটাই বোঝাচ্ছে যে শান্ত শহর জলপাইগুড়ি পাল্টে যাচ্ছে। এই শহরের মানুষরা গর্ব করে একসময় বলতো যে রাতেও এখানে নিরাপদ সবাই। কিন্তু বিগত দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর পর বোধহয় আর সেই কথা বলা যাবে না গর্ব করে। এখন তো দিনের আলোতেও নিরাপত্তা নেই শহরবাসীর। শহরের সাধারণ মানুষ এই ঘটনাগুলোর জন্য পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতাকেও দায়ী করছেন। শহরে একের পর এক অপরাধমূলক ঘটনা ঘটায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন শহরবাসী। এরই মধ্যে পুলিশের পাঁচ কর্মীকে একসাথে সাসপেন্ড করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে শহরে ঘটে যাওয়া ঘটনার জেরেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে শুধু সাসপেন্ড করলেই হবে না। পুলিশ প্রশাসনকে এই অপরাধীদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। সেইসাথে শহরে বাড়াতে হবে তহলদারি। শহরের অকেজো সিসি ক্যামেরাগুলো ঠিক করে সেগুলো যাতে নিয়মিত কাজ করে সেটা দেখতে হবে। শহরে যাতে গভীর রাত পর্যন্ত দোকানপাট খোলা না থাকে সেটাও দেখতে হবে। শহরের যত্রতত্র নেশার দ্রব্য বিক্রি বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।