হিরন সেন ও জলপাইগুড়ি সেনপাড়া


লেখক পঙ্কজ সেন

আজকের জলপাইগুড়ি শহরের নব প্রজন্মের কাছে হিরন সেন একটি বিস্মৃতপ্রায় নাম। অকুতোভয়- ডাকাবুকো ও তারুণ্যের তেজে দীপ্ত হিরন সেন ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই এক পুরুষসিংহ। তার অকাল প্রয়াণের ৪২ বছর অতিক্রান্ত, কিন্তু আজও তার অনুপস্থিতি শহরের সেনপাড়ার সকল নাগরিককে আবেগমথিত করে তোলে।

তার সান্নিধ্য পাওয়া সত্তরোর্ধ্ব ব্যক্তিত্বরা, আজও এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, হিরন সেন এর মতন বর্ণময়- আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব তারা দেখেন নি। মাত্র ৩৯ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে যে ক্যারিশমা তিনি রেখে গিয়েছেন তা আজও এই এলাকার মানুষের মুখে ঘোরে। তার অকালমৃত্যুতে শহরের সেনপাড়ায় সেন সম্প্রদায় এবং অন্যান্যদের মধ্যে যে শূন্যতা ও অভিভাবকহীনতার সৃষ্টি হয় তা আজও পূরণ হয়নি।


জলপাইগুড়ি পুরসভার কর আদায়ের কর্মী চিন্তাহরণ সেনের তৃতীয় সন্তান হিরনের জন্ম ১৯৪২ সালে শহরের সেনপাড়াতেই। অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী হিরন গ্রহণযোগ্য ছিলেন সমাজের সর্বস্তরেই। তার পৌরুষ, সাহসিকতা এবং পরোপকারী হৃদয়ের পরিচয় শহরবাসী পেয়েছিলেন ১৯৬৮ সালের তিস্তার মহাবন্যায় সাঁতরে অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচিয়ে। পরবর্তীতে তাঁর এই মহান মানবিক কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬৯ সালের ২৬শে জানুয়ারি পুলিশ লাইনে জেলাশাসকের দপ্তর থেকে রাষ্ট্রপতি পদক দিয়ে তাকে সম্মানিত করা হয়।

৬ ফুট উচ্চতা এবং ৪২ ইঞ্চি বুকের অসাধারণ দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী- সুদর্শন হিরন সেন স্থানীয় জনগণের কাছে “দেউনিয়া” নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। প্রগতি ব্যায়ামাগারে ব্যায়াম শিখে পরবর্তীতে তিনি নিজ বাড়িতেই ব্যায়ামাগার গড়ে তোলেন। হিরন সেন এবং অন্যান্যদের উদ্যোগে সেনপাড়ায় “সন্দীপন ব্যায়ামাগার ও সমাজ সেবা কেন্দ্র” গড়ে উঠলে এই ব্যায়ামাগার পরবর্তীতে সেখানেই স্থানান্তরিত হয়। এলাকার তরুণ -যুব সমাজকে সাঁতার ও শরীরচর্চাকে তাদের জীবনের মূল অঙ্গ করে তুলতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি এমন এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যার এক ডাকে যে কোন সময় শতাধিক তরুণ জমায়েত হয়ে যেত। তার পিছনে সর্বদা ছেলেছোকরার দল লেগেই থাকত। হিরন ভালোবাসতেন সাঁতার কাটতে, গান শুনতে, মাছ ধরতে, জিলা স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলতে এবং দুর্গাপূজার সময় মণ্ডপে ঢাক বাজাতে। হাই স্কুলের নাইট বিভাগের ছাত্র হিরন শহরের পূর্ত বিভাগের কর্মী ছিলেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। গোপাল নামক এক বন্ধুর সাথে সাইকেলে চেপে জলপাইগুড়ি থেকে কাশ্মীর ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বার হয়ে হিমাচল প্রদেশ পর্যন্ত গিয়েছিলেন। জীবনের শেষ প্রান্তে যকৃতের দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে সদর হাসপাতালে ডক্টর কিরণময় মৈত্রের অধীনে ২০ দিন ভর্তি থেকে ১৯৮১ সালের ৩১শে অক্টোবর ভোর চারটার সময় মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মারা যান। তার মৃত্যুর খবর শহরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে তাকে শেষ দেখার আশায় মাসকলাইবাড়ি শ্মশানের শেষ যাত্রায় অসংখ্য লোকের জনসমাগম হয়েছিল। তার অকাল মৃত্যুতে সেনপাড়ার সেন সম্প্রদায়ের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের করুন পরিসমাপ্তি ঘটে। মৃত্যুর সময় তার একমাত্র কন্যা অজন্তা মাত্র তিন বছরের ছিল।

ছবি লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *