জলপাইগুড়ির বটেশ্বর মন্দিরের ইতিকথা

লেখক পঙ্কজ সেন

ঐতিহাসিক বটেশ্বর মন্দির জলপাইগুড়ি জেলার পবিত্র শৈব তীর্থক্ষেত্র ময়নাগুড়ি ব্লকের ইন্দিরা মোড় থেকে জল্পেশ মন্দির যাওয়ার পথে রাস্তার মাঝখানে বাঁদিকে পড়বে। ঐতিহাসিক এই বটেশ্বর মন্দির আদতে বৌদ্ধস্তূপ না শিব মন্দির না কোন লৌকিক দেব-দেবীর মন্দির তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট কৌতুহল রয়েছে। আবার ঐতিহ্যমন্ডিত এই মন্দির ঠিক কতদিন আগের এবং কার দ্বারা নির্মিত তা নিয়েও মতপার্থক্য রয়েছে। কারণ এর কোন নির্মাণকালীন লিপি পাওয়া যায়নি। বর্তমানে জীর্ণ ভগ্নদশাপ্রাপ্ত এই মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ সংস্কার ও সংরক্ষণ নিয়ে সেই রকম কোনো সরকারি উদ্যোগ দেখা যায়নি। মন্দিরের ভেতরে কোন রকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকার ফলে এবং দীর্ঘদিন যাবৎ মন্দিরের ভেতরের অপূর্ব কারুকার্যমন্ডিত চারকোনা বেলে পাথরের গায়ের উপর খোদাই করা মূর্তিগুলো চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার ফলে সেগুলি প্রাকৃতিক কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আবার কিছু চুরিও হয়ে যাচ্ছে। ১০-১২ বছর আগে জলপাইগুড়ি জিলা পরিষদ মন্দিরের চারপাশে ইটের সীমান প্রাচীর তুলে দিয়েছে, কিন্তু কোন পাহারাদার নিয়োগ না করার ফলে দিনে ও রাতে জায়গাটি সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এখানে অনেকের বাড়িতেই বটেশ্বর মন্দিরের মূল্যবান পাথর রয়েছে। মন্দিরটির সঠিক ইতিহাস জানতে হলে উল্লেখিত স্থানে আরোও গভীর অনুসন্ধানের প্রয়োজন। আর প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা। বর্তমানে এই মন্দির চত্বরে কালীপুজো ও দুর্গা পুজো হয়।

পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অনগ্রসর কল্যাণ মন্ত্রী উপেন বিশ্বাস এক দীর্ঘ সময় এই ধ্বংস স্তূপের উপর কাজ করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, বটেশ্বর মন্দিরের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের স্তুপের গঠনশৈলীর অনেকটা সাদৃশ্য রয়েছে। বেলে পাথরের কারুকার্যময় স্তুপে পাওয়া গেছে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর দুটি চিত্র। বেলে পাথরে খোদাই করে পদ্ম এবং হাতির ছবি আঁকা রয়েছে। এছাড়াও বৌদ্ধস্তূপে ব্যবহৃত মঙ্গল ঘটের সন্ধানও এখানে মিলেছে। বটেশ্বর মন্দির ছাড়া উত্তরবঙ্গের আর কোন মন্দিরে বেলে পাথরের এমন অপূর্ব কারুকার্যময় নিদর্শন দেখা যায় না। বটেশ্বর মন্দিরের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এই মন্দিরে পোড়ামাটির ইটের কোন রকম ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়নি। সবই বেলে পাথরের উপর নির্মাণ শৈলী।

আবার যোগাসনে উপবিষ্ট মূর্তির ছবিটি দেখে মনে করা হয় যে, তিনি কোন লৌকিক ধর্মগুরু ছিলেন। এছাড়া এই মন্দির সংলগ্ন এলাকা থেকে যে অপূর্ব সুন্দর দ্বার শাখাটি মিলেছে, তার মধ্যভাগে একটি মূর্তি অস্পষ্টভাবে খোদিত রয়েছে। তবে সেটি কোন সময়ের তা বোঝা দুষ্কর। এই এলাকায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেবদেবীর পুজো হওয়ায় জন্য সেই ভাবেই মূর্তিগুলো তৈরি করা হয়েছিল এবং মন্দিরটির সংস্কার করা হয়েছিল। শোনা যায় যে বটেশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহে জল ঢাললে তা সরাসরি জল্পেশ দেবের মাথায় পতিত হয়।

মন্দির সংলগ্ন ভগ্নস্তুপ থেকে যে অন্ডমঞ্জুরীটি উদ্ধার করা হয়েছে,সেটি দেখে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে এই অন্ডমঞ্জুরী আসামের কামাক্ষা মন্দিরের স্থাপত্য শৈলীর অনুরুপ। মন্দিরের সামনের অংশ বাদ দিয়ে বাকিটা জঙ্গলাকীর্ণ। মন্দিরের সামনেই একটা কালচে সবুজ পাথরের মঙ্গল ঘট। মন্দিরের মূল প্রবেশপথে দুটি অপূর্ব বেলে পাথরের কারুকার্য মন্ডিত খিলান রয়েছে। অন্ধকার সুরঙ্গের মতো পথ দিয়ে মাথা নিচু করে ৫-৬ টি সিঁড়ি পেরিয়ে মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে হয়। ঠিক মাঝখানে রয়েছে শিবলিঙ্গ, সেই সাথে একটি শিব মূর্তিও রয়েছে। যদিও তার অবস্থা অনেকটা করুন। এক দীর্ঘকালীন অযত্ন, অবহেলা আর উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে এই অতি মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি আজ প্রায় ধ্বংসের মুখে এসে উপস্থিত। করুন দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে আমাদের দিকে।

অবশ্য বটেশ্বর মন্দিরের গঠনশৈলীর এই করুণ পরিস্থিতির জন্য বেনিয়া ইংরেজরাও অনেকাংশে দায়ী। ১৮৬৪ সালে ইঙ্গ-ভুটান যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভুটানিদের ডুয়ার্স ছাড়া করার জন্য ইংরেজরা উঠে পড়ে লাগে। অবশেষে ভুটানিরা এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পিছু হঠলে কিছু লোভী ইংরেজ সেনাদের মধ্যে এক ধারনার জন্ম হয় যে ভুটানিরা এই অঞ্চল ছাড়ার আগে তাদের সকল মূল্যবান অলংকার সামগ্রী বটেশ্বর মন্দিরের এলাকায় মাটির তলে লুকিয়ে রেখেছে। তাই সেই স্বর্ণালংকার লাভের আশায় ইংরেজ সেনা সমগ্র বটেশ্বর মন্দির চত্বরের মাটি খুঁড়ে, মন্দিরের পিলার উপরে চারিদিকে তন্ন তন্ন করে খোঁজে। কিন্তু কোন কিছুই তাদের হাতে আসেনি। কিন্তু তাদের এই হঠকারী কর্মকাণ্ডে মন্দিরটির সর্বনাশ হয়ে যায়। স্থানীয় জনরোষ ঠেকাতে বৈকুণ্ঠপুর রাজাদের তৈরি বটেশ্বর শিব মন্দিরে ইংরেজ সেনাদের করা এই অপকীর্তি চাপা দিতে চেয়েছিলেন তৎকালীন চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা ইংরেজ সার্জেন শল্য চিকিৎসক রেনী। তিনি লজ্জিত হয়েছিলেন এই ঘটনায়। পরবর্তীতে তিনি বটেশ্বর মন্দির এলাকায় এসে তদন্ত করেন এবং সৈন্যদের দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা মাটি চাপা দেওয়ার ব্যবস্থা করে।

প্রতিবছর স্থানীয় ও বাইরের অনেক পর্যটক বটেশ্বর মন্দিরে দেবদর্শনে আসেন, কিন্তু মন্দিরটির করুন অবস্থা ও তার চারপাশের জঙ্গলময় পরিবেশ দেখে তারা হতাশ চিত্তে ভক্তি ভরে মন্দির দর্শন করে চলে যান। ভাঙ্গা শিব মন্দিরের গায়ে বিরাট বটগাছ ডানা মেলে চারপাশ ছেয়ে ফেলেছে আর তার ডালে ডালে বাধা আছে রঙিন কাপড়। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে এই মন্দির সেই অতীতের মত পুনরায় জনগণের কল-কাকলিতে, পুরোহিতের মন্ত্র উচ্চারণে, মেয়েদের শাঁখ ও উলু ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠবে মহাদেবের এই পবিত্র এলাকা। সেই দিনের আশায় রইলাম…

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : গুগল।

ছবি সৌজন্যে ইন্টারনেট।
(বিবরণীতে সামান্য ভুল ত্রুটি হতে পারে,তাই পাঠকদের কাছে বিনীত অনুরোধ,আপনাদের মূল্যবান সঠিক মন্তব্য কমেন্ট বক্সে তুলে ধরলে খুবই বাধিত হব)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *