ভৌতিক গল্প : বুমসিরার বাটি

পিনাকী রঞ্জন পাল

অধ্যায় ১: অবাঞ্ছিত গ্রাম

অসমের উত্তপ্ত গ্রীষ্মে যখন বাতাসও যেন হাঁফিয়ে ওঠে, ডঃ মৃণালিনী দাসের মন তখন হিমশীতল এক নীরবতার গভীরে ডুবে ছিল। তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগপ্যাক, হাতে সরকারি কাগজপত্র, কিন্তু চোখের গভীরে এক গোপন ক্ষত – তার ছোটবোন রিনি। তিন বছর আগে উত্তর-পূর্বের এই দুর্গম অঞ্চলেই রিনি হারিয়ে গিয়েছিল এক অস্পষ্ট, অমীমাংসিত রহস্যে। সরকার বলেছিল, “দুর্গম পথ, দুর্ঘটনা,” কিন্তু মৃণালিনী জানত, রিনি অত সহজে হার মানার মেয়ে ছিল না। তার বোনের স্মৃতিই আজ তাকে টেনে এনেছে নাগাল্যান্ড ও অসমের সীমান্ত ঘেঁষা এক নাম-না-জানা জনপদে, যার নাম – বুমসিরা।

বুমসিরা, সরকারি ম্যাপে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। লোকমুখে প্রচলিত যে, এই গ্রামে একবার যে ঢোকে সে আর ফিরে আসে না। একটা ভৌতিক খ্যাতি আছে জায়গাটার। কিন্তু আজ সেই পরিত্যক্ত, অভিশপ্ত গ্রামে আবার প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। সরকারের নতুন হাইড্রো ড্যাম প্রজেক্টের জন্য এখানে লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়েছে, শ্রমিকের বস্তি গড়ে উঠেছে, জেসিবি আর ড্রিল মেশিনের কর্কশ শব্দ পাহাড়ের বুক চিরে এক নতুন উন্নয়নের গল্প লিখছে। মৃণালিনী এখানে এসেছে একজন সংরক্ষণবিদ হিসেবে, ড্যাম প্রজেক্টের পরিবেশগত প্রভাবের উপর রিপোর্ট তৈরি করতে। তার মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ তাকে বাস্তববাদী থাকতে শেখায়, কিন্তু রিনির অন্তর্ধানের অব্যক্ত ব্যথা তাকে অদৃশ্য এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে এই অঞ্চলের সঙ্গে।

গাড়ি যখন গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল, মৃণালিনী দেখল পাহাড়ের রুক্ষতা যেন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। চারদিকে কেবল সবুজ আর ধূসর পাথরের রুক্ষ বিস্তার, মাঝে মাঝে কিছু নড়বড়ে কুঁড়েঘর। লোকজনের মুখগুলো ফ্যাকাশে, চোখে এক চাপা ভয়। তারা যেন কোনো অদৃশ্য ছায়ার ভয়ে সর্বক্ষণ সন্ত্রস্ত হয়ে আছে। মৃণালিনী গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল, তার মনে হচ্ছিল গ্রামের বাতাসেই যেন এক অশুভ নিস্তব্ধতা মিশে আছে। ইঞ্জিনের একটানা শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই, পাখির ডাক নেই, এমনকি হাওয়ার শব্দও যেন ক্ষীণ।

তারা যখন ড্যাম প্রজেক্টের অস্থায়ী ক্যাম্পে পৌঁছাল, সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়েছে। ক্যাম্পটি বেশ বড়, তাঁবু আর অস্থায়ী ছাউনিতে ভরা। ক্যাম্প ইন-চার্জ, একজন বলিষ্ঠ চেহারার ইঞ্জিনিয়ার, মিঃ বর্মন, মৃণালিনীকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। কিন্তু তার চোখেও কেমন যেন এক অস্বস্তি। “ডঃ দাস, আপনাকে স্বাগত। এই জায়গাটা একটু… অন্যরকম,” বর্মন নিচু স্বরে বললেন। “তবে আশা করি, আপনার কাজে অসুবিধা হবে না।”

প্রথম দিনের কাজের পর মৃণালিনী সিদ্ধান্ত নিল, সে গ্রামের মূল অংশটা ঘুরে দেখবে। হাতে তার ম্যাপ, যদিও গ্রামের মূল নকশা তাতে নেই। সে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল গ্রামের গভীরে। পুরনো দিনের পাথর আর বাঁশের তৈরি বাড়িঘরগুলো জীর্ণ হয়ে আছে, অধিকাংশ পরিত্যক্ত। মনে হচ্ছে, এক সময় এই গ্রাম বেশ সমৃদ্ধ ছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সব কিছু থেমে গেছে। বাতাসে এক পুরনো গন্ধ, স্যাঁতসেঁতে মাটি আর পচনশীল পাতার গন্ধ।

গ্রামের মাঝখানে একটি ছোট, গোলাকার পাথরের বেদি। তার পাশেই একটি বিশাল আকারের শ্যাওলা ধরা পাথর। মৃণালিনী কৌতূহলবশত সেদিকে এগিয়ে গেল। তার চোখ আটকে গেল পাথরের গায়ে। পাথরের বুকে অস্পষ্ট কিছু প্রতীক খোদাই করা আছে। প্রথমে সে বুঝতে পারল না, কিন্তু ভালো করে দেখতেই তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত তালে ধুকপুক করতে শুরু করল। পাথরে আঁকা আছে প্রাচীন প্রতীক—এক বাটি আর তার পাশে উল্টো মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ! এই প্রতীকগুলো যেন এক অশুভ ইঙ্গিত বহন করছিল। বাটিটা ছিল নিখুঁত গোলাকৃতি, আর মানুষগুলো যেন বাটির দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে, এক অদৃশ্য শক্তির ভয়ে সন্ত্রস্ত। তাদের হাতগুলো অস্বাভাবিকভাবে লম্বা, আর চোখগুলো গভীর গর্তের মতো।

মৃণালিনীর মনে পড়ল লোককথা, “এই গ্রামে যে একবার ঢোকে সে আর ফিরে আসে না।” এই প্রতীক কি সেই অভিশাপের কোনো ইঙ্গিত? এই বাটি কীসের প্রতীক? কেন মানুষগুলো উল্টো মুখে দাঁড়িয়ে? তার মস্তিষ্ক যুক্তি খুঁজছিল, কিন্তু চোখের সামনে পাথরের এই প্রতীক তাকে এক অজানা ভয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। সূর্য তখন পুরোপুরি ডুবে গেছে, আর পাহাড়ের ওপর থেকে এক হিমশীতল বাতাস নেমে এল। অন্ধকার দ্রুত গ্রাস করছিল বুমসিরাকে, আর তার সাথে মিশে যাচ্ছিল এক অশুভ নীরবতা। মৃণালিনী অনুভব করল, সে এক এমন জায়গায় এসেছে, যেখানে বিজ্ঞান আর কুসংস্কারের সীমানা এক হয়ে যায়, আর অতীত যেন বর্তমানের উপর ছায়া ফেলে। সে জানত না, এই বাটির রহস্য তাকে কিসের গভীরে টেনে নিয়ে যাবে, আর রিনির হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে এই অভিশাপের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা। তার চারপাশে কেবল এক জমাট বাঁধা নিস্তব্ধতা, যা তাকে ক্রমশ গ্রাস করছিল।

অধ্যায় ২: বাঁশির ডাক

সন্ধ্যা নামতেই বুমসিরা যেন আরও গা ছমছমে হয়ে উঠল। পাহাড়ের কোলে সূর্য ডুবতেই তাপমাত্রা দ্রুত নেমে এল, আর বাতাস ভারী হয়ে উঠল এক অদ্ভুত গন্ধে – ভেজা মাটি আর পুরনো পাতা পচার গন্ধ, যা বুনো ফুলের তীব্র মিষ্টি সুবাসের সঙ্গে মিশে এক unsettling অনুভূতি তৈরি করছিল। ক্যাম্পের জেনারেটরের একঘেয়ে শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ ছিল না। শ্রমিকরা দলবদ্ধ হয়ে থাকত, তাদের চোখেও এক চাপা ভয় স্পষ্ট। তারা দিনের বেলা যত ব্যস্তই থাকুক না কেন, রাতের বুমসিরা যেন তাদের আত্মাকে গ্রাস করত।

মৃণালিনী তার তাঁবুর ভেতরে বসে ল্যাপটপে তার রিপোর্ট তৈরির কাজ করছিল। বাইরে তখন নিস্তব্ধতা এতটাই গভীর যে নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানিও শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎই, সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল এক অদ্ভুত, সুরময় আওয়াজে। বাঁশির শব্দ! বাঁশির সুরটা ছিল করুণ, একই সাথে মায়াবী এবং ভয়ের। যেন কেউ খুব কাছে থেকেই বাজাচ্ছে। মৃণালিনী ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে তাঁবুর বাইরে কান পাতল। বাঁশির সুরটা যেন তার মস্তিষ্কের ভেতরে প্রবেশ করছিল, তার প্রতিটি স্নায়ুকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল।

সে তাঁবুর জিপার খুলে বাইরে উঁকি দিল। রাত তখন গভীর। ক্যাম্পের আলো নিভে গেছে, কেবল জেনারেটরের পাশে একটা টিমটিমে বাল্ব জ্বলছে। বাঁশির শব্দটা ধীরে ধীরে আরও স্পষ্ট হচ্ছিল, যেন পাহাড়ের বুক চিরে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। প্রথমে সে ভাবল, কোনো শ্রমিক হয়তো বাজাচ্ছে। কিন্তু সুরটা এতটাই অপ্রাকৃত ছিল যে তার মনে ভয় দানা বাঁধল। সুরটা যেন প্রাণহীন, অথচ তার ভেতর এক গভীর আকর্ষণ ছিল, যা মানুষকে নিজের দিকে টেনে নিতে পারে। মৃণালিনীর মনে হলো, এই সুরটা যেন পরিচিত, বহু আগে সে কোথাও শুনেছে, কিন্তু কোথায় তা মনে করতে পারছিল না।

সে তাঁবুর জিপার আবার টেনে দিল, কিন্তু বাঁশির শব্দটা যেন তার মাথার ভেতরেই বাজছিল। সে ঘুমোতে পারল না। সারা রাত ধরে সেই অশুভ সুর তার কানের কাছে ভেসে আসছিল, কখনও দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিল, আবার কখনও কাছে আসছিল, যেন অদৃশ্য কেউ তার তাঁবুর আশেপাশে ঘুরছে। মৃণালিনী বালিশে মুখ গুঁজে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। তার মনে হলো, সে যেন এক অদৃশ্য শক্তির হাতে আটকা পড়েছে, যা তাকে গ্রাস করতে চাইছে।

পরদিন সকালে, ক্যাম্পের ভেতরে এক ভয়াবহ চিৎকার শোনা গেল। শ্রমিকদের মধ্যে একজন, যার নাম ছিল মনোজ, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। মৃণালিনী দ্রুত তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল। সবার মুখে আতঙ্ক। কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর এল, মনোজকে পাওয়া গেছে। ক্যাম্প থেকে কিছুটা দূরে, জঙ্গলের ধারে, তাকে পাওয়া গেছে।

মৃণালিনী বর্মন স্যারের সাথে ঘটনাস্থলে গেল। ঘটনাস্থলের দৃশ্য দেখে মৃণালিনীর পেটের ভেতরটা গুলিয়ে উঠল। মনোজের দেহটা বীভৎসভাবে বিকৃত হয়ে পড়ে আছে। তার শরীরের কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না, কিন্তু তার গলায় কাটা দাগ ছিল, গভীর, ধারালো কোনো কিছু দিয়ে কাটা। আর সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল তার চোখ! মনোজের চোখ দুটো উপড়ে ফেলা হয়েছিল! যেখানে চোখ ছিল, সেখানে কেবল দুটি গভীর, শূন্য গর্ত। রক্ত জমাট বেঁধে আছে, মাছি ভন ভন করছে। দৃশ্যটা এতটাই ভয়ানক ছিল যে বর্মন স্যারও মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

মৃণালিনী মনোজের মৃতদেহের দিকে তাকাল, তার মস্তিষ্কে তখনো সেই বাঁশির সুরটা বাজছিল। মনোজের বিকৃত মুখ, শূন্য চোখ – সবকিছুর পেছনে কি সেই বাঁশির সুর দায়ী? কিন্তু এই নৃশংসতার কারণ কী? কে করল এই কাজ? মৃণালিনীর মনে পড়ল লোককথা – ‘বুমসিরা’য় যে ঢোকে, সে আর ফেরে না। এই কি সেই অভিশাপের প্রমাণ?

মৃত্যুদেহের পাশে, মাটিতে, একটি বস্তু তার চোখ আকর্ষণ করল। সেটি ছিল একটি ছোট, হাতে গড়া, মাটির বাটি! বাটিটা ছিল নিখুঁত গোলাকৃতি, তার গায়ে কোনো নকশা নেই। মৃণালিনী সাবধানে বাটিটা হাতে তুলে নিল। বাটিটা ছিল ঠান্ডা, যেন বহুক্ষণ ধরে সেখানেই পড়েছিল। তার ভেতরের দিকে তাকিয়ে মৃণালিনীর শরীর দিয়ে এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল – বাটির ভেতরে জমাট বাঁধা রক্ত! টাটকা রক্ত নয়, শুকিয়ে গেছে, কিন্তু তার লাল রঙ তখনও স্পষ্ট।

মৃণালিনীর মনে পড়ল পাহাড়ের গায়ে আঁকা সেই প্রতীক—এক বাটি আর তার পাশে উল্টো মুখে দাঁড়ানো মানুষ। সেই প্রতীক, সেই বাঁশির শব্দ, আর এখন এই মাটির বাটি আর বিকৃত মৃতদেহ। সবকিছুর মধ্যে এক অশুভ যোগসূত্র ছিল। রিনি কি এই বাটির রহস্যের শিকার হয়েছিল? তার বোন কি এই গ্রামের অভিশাপে হারিয়ে গিয়েছিল? তার বাস্তববাদী মন এবার চরম চ্যালেঞ্জের মুখে।

অধ্যায় ৩: রিনির ছায়া

মনোজের বিকৃত মৃতদেহ আর তার পাশে পাওয়া রক্তমাখা মাটির বাটিটা মৃণালিনীর মনকে এক চরম অস্বস্তিতে ফেলেছিল। তার বৈজ্ঞানিক সত্তা এই ঘটনাগুলোর কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছিল না। ক্যাম্পের সবাই মনোজের মৃত্যু নিয়ে ফিসফিস করছিল, তাদের চোখে মুখে ছিল অদম্য ভয়। বর্মন স্যার ঘটনাটিকে ‘জঙ্গলি প্রাণীর আক্রমণ’ বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও, গলা কাটা আর চোখ উপড়ে ফেলার বিষয়টি কোনো সাধারণ প্রাণীর কাজ বলে মনে হচ্ছিল না। মৃণালিনীর মনে তখনো সেই অশুভ বাঁশির সুরটা বাজছিল, আর তার সাথে মিশে যাচ্ছিল রিনির হারিয়ে যাওয়ার রহস্য।

মৃণালিনী সেদিন আর কাজে মন দিতে পারল না। তার মাথায় শুধু ঘুরছিল সেই মাটির বাটি আর পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা প্রতীক। সে তাঁবুর ভেতরে বসে পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে লাগল। রিনি যখন হারিয়ে গিয়েছিল, তখন সে একটা এনজিও-র হয়ে কাজ করত, মূলত উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আদিবাসী জনজাতিদের জীবনযাত্রা নিয়ে গবেষণা। মৃণালিনীর কাছে রিনির সব রিপোর্ট আর নোটবুক ছিল। সে জানত, রিনির শেষ অবস্থান ছিল এই অঞ্চলেরই কোনো এক গ্রাম সংলগ্ন এলাকায়।

রিনির পুরনো নোটবুকগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে মৃণালিনীর হাত থেমে গেল একটি পৃষ্ঠায়। সেখানে অস্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে কিছু গ্রামের নাম আর তারিখ। তার মধ্যে একটি নাম স্পষ্ট – বুমসিরা! রিনি তিন বছর আগে এই গ্রাম সংলগ্ন এলাকায় এসেছিল একটি NGO-র কাজে! মৃণালিনীর শরীর দিয়ে এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তাহলে কি রিনি এই বুমসিরার অভিশাপের শিকার হয়েছিল? তার হারানোর সাথে এই গ্রামের কোনো যোগসূত্র আছে? নোটবুকের পরের পৃষ্ঠাগুলোতে রিনি বুমসিরার লোককথা নিয়ে কিছু সংক্ষিপ্ত টীকা লিখেছিল – একটি বাটি, একটি প্রাচীন আচার এবং গ্রামের মানুষের আতঙ্ক। তার শেষ লেখা ছিল, “আমি গ্রামের পুরনো স্কুলঘরে যাচ্ছি। ওখানে কিছু প্রাচীন নিদর্শন থাকতে পারে।”

মৃণালিনীর বুকে তখন এক তীব্র আলোড়ন। রিনি এই গ্রামেরই পুরনো স্কুলঘরে গিয়েছিল! আর তার পর থেকেই সে নিখোঁজ। মৃণালিনী দ্রুত তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল। তাকে সেই স্কুলঘর খুঁজে বের করতেই হবে।

গ্রামের প্রধান পথের শেষ প্রান্তে, যেখানে লোকালয় শেষ হয়েছে, সেখানে একটি জীর্ণ, পরিত্যক্ত স্কুলঘর দেখা যাচ্ছিল। তার ছাদ ভেঙে গেছে, জানালাগুলো নেই, আর চারপাশে জংলি লতাপাতা ঘিরে ধরেছে। দেখে মনে হলো, বহু বছর ধরে কেউ এই স্কুলঘরের ধারে কাছে আসেনি। সূর্যের আলোয় স্কুলঘরের ভাঙা দেয়ালগুলো কেমন যেন এক ভৌতিক রূপ ধারণ করেছে।

মৃণালিনী সাবধানে স্কুলঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। ধুলো আর বালির আস্তরণ, আর বাতাসে এক পুরনো গন্ধ। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ভাঙা স্লেট, পুরনো বইয়ের ছেঁড়া পাতা। কিন্তু তার চোখ আটকে গেল ঘরের এক কোণে। সেখানে একটি ছোট কাঠের টেবিল আর একটি নড়বড়ে চেয়ার উল্টে পড়ে আছে। তার পাশে, মাটিতে, একটি ছোট কাপড়ের ব্যাগ পড়ে আছে, তার উপর ধুলোর আস্তরণ। মৃণালিনী দ্রুত ব্যাগটি হাতে নিল। এটি রিনির ব্যাগ! তার চেনা ব্যাগ। ব্যাগটি খুলতেই তার ভেতরে রিনির কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র পাওয়া গেল – একটি ছোট ডায়েরি, একটি কলম, আর কিছু শুকনো ফুল।

মৃণালিনী দ্রুত রিনির ডায়েরিটি খুলল। তার প্রতিটি পৃষ্ঠায় রিনির হাতের লেখা, তার অভিজ্ঞতা, তার প্রশ্ন। রিনি বুমসিরার অদ্ভুত রীতিনীতি, সেখানকার মানুষের ভয়, আর সেই বাঁশির শব্দের কথা লিখেছিল। ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায়, তার হাতের লেখা আরও অস্পষ্ট হয়ে গেছে। সেখানে লেখা ছিল: “বাঁশির শব্দটা… কাছে আসছে… ওরা আসছে… আমাকে ডাকছে… সেই বাটি…!” তার শেষ লাইনটি ছিল অসম্পূর্ণ, যেন লেখার মাঝপথেই কোনো ঘটনা ঘটেছিল। মৃণালিনীর চোখ জলে ভরে উঠল। রিনি এই স্কুলঘরে বসেই এই ডায়েরিটা লিখছিল, আর তখনই সেই বাঁশির ডাক তাকে গ্রাস করেছিল। তার বোন কি তাহলে সেই অদৃশ্য শক্তির শিকার হয়েছিল?

মৃণালিনী যখন ডায়েরিটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন তার কানে এক অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে এল। প্রথমে সে ভাবল, এটা তার মনের ভুল। কিন্তু শব্দটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে তার কণ্ঠস্বর! ফিসফিস করে কিছু কথা, যা স্পষ্ট নয়, কিন্তু রিনির গলার স্বর সে চিনতে পারছিল। “দিদি… দিদি…” যেন কেউ তাকে ডাকছে।

মৃণালিনী ভয়ে কাঁপতে শুরু করল। সে চারপাশে তাকাল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। রিনির কণ্ঠস্বর যেন স্কুলঘরের প্রতিটি কোণা থেকে ভেসে আসছিল, দেয়ালের ফাটল থেকে, ছাদের ভাঙা অংশ থেকে। সে দৌড়ে স্কুলের বাইরে বেরিয়ে এল, কিন্তু কণ্ঠস্বরটা তাকে পিছু ছাড়ল না। “দিদি… আমাকে বাঁচাও… বাটি…”

মৃণালিনী শ্বাস নিতে পারছিল না। রিনি কি সত্যিই এখানে আছে? তার আত্মা কি এই স্কুলঘরে আটকা পড়েছে? তার মস্তিষ্ক যুক্তি খুঁজতে চাইল, কিন্তু রিনির পরিচিত কণ্ঠস্বর তাকে বাস্তবতা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিল। রিনির অন্তর্ধানের পেছনে তাহলে সেই বাঁশি, সেই বাটি, আর এই গ্রামের অভিশাপ দায়ী। মৃণালিনী এখন জানত, তার বোনের হারানোর রহস্য এই বুমসিরার গভীরে লুকিয়ে আছে, আর তাকে সেই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতেই হবে। সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে, আর স্কুলঘরের ভাঙা জানালা থেকে এক অশুভ ছায়া যেন তার দিকে এগিয়ে আসছিল। মৃণালিনীর মনে হলো, সে কেবল তার বোনকে খুঁজছে না, সে নিজেই যেন এক অদৃশ্য ফাঁদে আটকা পড়ছে, যা তাকে রিনির পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

অধ্যায় ৪: বাটির অভিশাপ

সেই রাতে মৃণালিনী আর ঘুমোতে পারল না। তার কানে শুধু রিনির কণ্ঠস্বর বাজছিল, “দিদি… আমাকে বাঁচাও…”। ভোরের আলো ফুটতেই সে সিদ্ধান্ত নিল, তাকে এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতেই হবে, রিনিকে যদি কোনোভাবে ফিরিয়ে আনা যায়।

সে সোজা গ্রামের সবচেয়ে পুরনো অংশে গেল। সেখানে এক জীর্ণ কুঁড়েঘরের সামনে এক বৃদ্ধা বসে ছিলেন, যার চোখজোড়ায় ছিল বুমসিরার শতবর্ষের ইতিহাস। তার মুখ কুঁচকে গেছে, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত দ্যুতি। গ্রামবাসীরা তাকে ‘আই’ বলে ডাকত, অর্থাৎ দিদিমা। আই-কে সবাই এড়িয়ে চলত, কারণ সে গ্রামের পুরনো দিনের সব গা ছমছমে কাহিনি মনে রাখত।

মৃণালিনী আই-এর কাছে গিয়ে মনোজের মৃত্যুর কথা বলল, সেই বাঁশির ডাকের কথা, আর তার পাশে পাওয়া মাটির বাটির কথা। আই মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তার মুখে কোনো বিস্ময় ছিল না, যেন তিনি এসবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। মৃণালিনী যখন রিনির হারিয়ে যাওয়ার কথা তুলল, আই-এর চোখে এক গভীর বিষাদ ফুটে উঠল।

আই নিচু স্বরে কথা বলতে শুরু করলেন, তার কণ্ঠস্বর ছিল ভাঙা ভাঙা, যেন বহু বছরের পুরনো পাথরের ঘষা। “এই বুমসিরা… এ এক অভিশপ্ত গ্রাম, মা। বহু বছর আগে, এখানে ‘অর্চা’ নামে এক ভয়ংকর রীতি ছিল।” মৃণালিনীর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আই বলে চললেন, “গ্রামের রক্ষাকর্ত্রী দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য, প্রতি বছর বলি দেওয়া হত। কেবল পশু নয়, মানুষও! আর সেই বলির রক্ত ভরে রাখা হত একটি মাটির বাটিতে। সেই বাটিই ছিল দেবীর শক্তি।”

মৃণালিনীর মনে পড়ল সেই পাথরের গায়ে আঁকা বাটির প্রতীক, আর মনোজের পাশে পাওয়া বাটির ভেতরের রক্ত। তাহলে সেই বাটিই ছিল এই অভিশাপের মূল উৎস! আই-এর কথা শুনে তার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছিল। “শেষবার, মা,” আই-এর কণ্ঠস্বর আরও নিচু হয়ে গেল, “এক কিশোরীকে বলি দেওয়ার জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল। সে ছিল বড় নিষ্পাপ, সুন্দর। কিন্তু তার আত্মাকে দেবীর নামে কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল। সে শেষবারের মতো সূর্য দেখেছিল, তারপর তাকে বাটির সামনে নিয়ে আসা হয়।” আই-এর চোখ বন্ধ হয়ে এল, যেন তিনি সেই দৃশ্যটা দেখছিলেন। “কিন্তু সেই কিশোরী মরার আগে অভিশাপ দিয়েছিল! তার চোখ দুটো তখন রক্তজবার মতো লাল হয়ে গিয়েছিল, তার মুখে এক বীভৎস হাসি। সে চিৎকার করে বলেছিল—‘এই গ্রামে যে ঢুকবে, সে আর ফিরে যাবে না। তাদের আত্মারাও এই বাটির দাস হয়ে থাকবে!’”

আই চোখ খুললেন, তার চোখে ছিল এক গভীর আতঙ্ক। “সেই দিন থেকেই বুমসিরা এক অবাঞ্ছিত গ্রামে পরিণত হয়। দেবীর অভিশাপ নয়, বরং সেই কিশোরীর অভিশাপ গ্রাস করে এই গ্রামকে। যারা এই গ্রামে ঢোকে, তাদের আত্মারা সেই বাটির দাস হয়ে যায়। রাতের বেলা সেই বাঁশির শব্দ, সে তো মৃত আত্মাদের ডাক, মা। তারা নতুন শিকারের জন্য আসে, যাদের আত্মাকে তারা বাটির মধ্যে বন্দী করবে।”

মৃণালিনীর কানে তখনো সেই বাঁশির সুরটা বাজছিল। তাহলে মনোজের চোখ উপড়ে ফেলার কারণ এটাই! আত্মাকে বাটিতে বন্দী করার আগে কি চোখ উপড়ে ফেলা হয়? আর সেই রক্ত? রিনির ডায়েরিতেও সেই বাঁশি আর বাটির কথা লেখা ছিল। তার বোন কি সেই অভিশপ্ত বাটির শিকার হয়েছিল?

“আমার বোন… রিনি,” মৃণালিনী ফিসফিস করে বলল, “সেও কি সেই বাটির শিকার?”

আই মৃণালিনীর দিকে করুণ চোখে তাকালেন। “আমি জানি না, মা। কিন্তু যদি সে এই গ্রামে এসেছিল, তবে তার আত্মা হয়তো এখনো মুক্তি পায়নি।”

মৃণালিনীর মনস্তাত্ত্বিক চাপ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তার ব্যক্তিগত ক্ষতি, রিনির হারানো স্মৃতি—সবকিছু যেন এই অভিশাপের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারছিল, এই বাটি কেবল রক্ত সংগ্রহের পাত্র নয়, এটি এক অদৃশ্য কারাগার, যেখানে শত শত আত্মা বন্দী এবং সেই আত্মারা বাঁশির টানে নতুন শিকারের সন্ধানে আসে। এই ভয়াল সত্য তার বাস্তববাদী মনকে চূর্ণ করে দিল। সে এখন আর শুধু একজন সংরক্ষণবিদ ছিল না, সে ছিল এক বোনের শেষ ভরসা, এক অন্ধকার অভিশাপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী, যার মনে ছিল এক প্রবল প্রশ্ন: সে কি রিনিকে খুঁজে বের করতে পারবে, নাকি নিজেই হবে বুমসিরার বাটির নতুন দাস? গ্রামের বাতাসে তখনো সেই বাঁশির অদৃশ্য রেশ ভেসে আসছিল, যা মৃত আত্মাদের ডেকে নিয়ে আসছিল, নতুন করে রক্ত আর অভিশাপের জন্য।

অধ্যায় ৫: নিষিদ্ধ গুহা

আই-এর বলা ‘অর্চা’ রীতির কথা, সেই কিশোরীর অভিশাপ, আর বাটির মধ্যে বন্দী আত্মাদের কাহিনি মৃণালিনীর মনে গভীর শিকড় গেড়ে বসেছিল। বুমসিরার অভিশাপ আর রিনির অন্তর্ধান—এই দুই রহস্যের সমাধান যেন সেই মাটির বাটির ভেতরেই লুকানো ছিল। রাতের বাঁশির সুর এখন আর কেবল একটা ভয়ের প্রতীক ছিল না, এটা ছিল শত শত বন্দি আত্মার আর্তনাদ, তাদের মুক্তির আকুতি। মৃণালিনী জানত, তাকে সেই বাটির উৎস খুঁজে বের করতে হবে।

আই তাকে একটি পুরনো গুহার কথা বলেছিলেন, গ্রামের প্রান্তে, ঘন জঙ্গলের ভেতরে। সেই গুহা নাকি ‘অর্চা’ রীতির মূল কেন্দ্র ছিল। বহু বছর আগে গ্রামের লোকেরা সেই গুহা ব্যবহার করত দেবীর উপাসনার জন্য। আই-এর নিষেধ সত্ত্বেও, মৃণালিনী পরের দিন সকালেই সেই গুহার সন্ধানে রওনা দিল।

পথ দুর্গম, জঙ্গলের গাছপালা ঘন হয়ে আকাশ ঢেকে ফেলেছে, সূর্যের আলোও মাটিতে পৌঁছাতে পারছিল না। পায়ের তলার মাটি স্যাঁতসেঁতে, পুরনো পাতার স্তূপে ঢাকা। চারদিকে এক অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা, কেবল পোকামাকড়ের একটানা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। মৃণালিনীর মনে হচ্ছিল, জঙ্গলটা যেন তাকে পরীক্ষা করছে, তার পথে বাধা সৃষ্টি করছে।

দীর্ঘক্ষণ হাঁটার পর, সে একটি সংকীর্ণ গুহামুখ দেখতে পেল, যা ঘন লতাপাতা দিয়ে ঢাকা ছিল। গুহামুখটা এতটাই ছোট ছিল যে ভেতরে ঢুকতে হলে প্রায় হামাগুড়ি দিতে হয়। মৃণালিনীর বুক ধুকপুক করছিল, কিন্তু রিনির রহস্য উন্মোচনের অদম্য ইচ্ছে তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করল।

গুহার ভেতরে প্রবেশ করতেই এক ঠান্ডা, ভ্যাপসা হাওয়া তার মুখে এসে লাগল। গন্ধটা ছিল অদ্ভুত—পুরনো মাটি, জমাট বাঁধা রক্ত, আর একটা মিষ্টি কিন্তু অস্বস্তিকর সুবাস, যা সে ব্রহ্মপুত্রের ধারে অনুভব করেছিল। টর্চের আলোয় মৃণালিনী গুহার ভেতরের দৃশ্য দেখতে লাগল। গুহাটা বেশ বড়, ক্রমশ নীচের দিকে নেমে গেছে।

আর তারপর, টর্চের আলো যেখানে পড়ল, সেই দৃশ্য মৃণালিনীকে হতবাক করে দিল। গুহার ভেতরে, পাথরের স্তরের উপর শত শত মাটির বাটি সাজানো! ছোট, বড়, মাঝারি বিভিন্ন আকারের বাটি। কিছু বাটি অক্ষত, কিছুর মুখ ভাঙা। কিন্তু প্রতিটি বাটির ভেতরে জমাট বাঁধা কালচে রক্তের দাগ স্পষ্ট। দৃশ্যটা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে মৃণালিনীর মনে হলো, সে যেন এক বিশাল গণকবরের উপর দাঁড়িয়ে আছে।

তার চোখ আরও নীচে নামতেই তার পায়ের কাছে কিছু সাদা রঙের বস্তু নজরে পড়ল। ভালো করে দেখতেই সে বুঝতে পারল—এগুলো মানুষের কঙ্কাল! প্রতিটি বাটির পাশে একটি করে কঙ্কাল পড়ে আছে, যেন সেই বাটিগুলোর নীরব সাক্ষী। মৃণালিনীর শরীর হিম হয়ে গেল। এই বাটিগুলো তাহলে সেই বলিদানের পাত্র, আর কঙ্কালগুলো সেই হতভাগ্যদের, যাদের আত্মারা এই বাটির ভেতরে বন্দী হয়ে আছে।

গুহার দেওয়ালের দিকে তাকাতেই মৃণালিনীর হৃৎস্পন্দন যেন থেমে গেল। টর্চের আলোয় সে দেখল, দেওয়ালের গায়ে অস্পষ্ট কিছু ছবি আঁকা। মানুষের উল্টো মুখ, বাটির প্রতীক—যা সে গ্রামের বাইরে পাথরের গায়ে দেখেছিল। কিন্তু একটি ছবি তার দৃষ্টি কেড়ে নিল। ছবিটি একজন যুবতীর, অস্পষ্ট হলেও তার মুখের আদল মৃণালিনীর খুব চেনা। তার মুখ অবিকল রিনির মতো! সেই একই মিষ্টি হাসি, সেই একই গভীর চোখ। ছবিটি যেন বহু বছর আগে আঁকা, কিন্তু তার মুখের অভিব্যক্তি আজও জীবন্ত।

মৃণালিনী পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই গুহা, এই বাটি, এই কঙ্কাল, আর দেওয়ালের সেই ছবি—সবকিছু যেন এক ভয়ংকর সত্যের দিকে ইঙ্গিত করছে। রিনি কি সত্যিই এই অভিশাপের শিকার হয়েছিল? তার আত্মা কি এই শত শত বন্দি আত্মার সাথে মিশে গেছে? দেওয়ালের সেই ছবি কি রিনির শেষ স্মৃতিচিহ্ন? তার মনে পড়ল রিনির ডায়েরির শেষ লেখা—”বাঁশির শব্দটা… কাছে আসছে… ওরা আসছে… আমাকে ডাকছে… সেই বাটি…!”

গুহার ভেতরে বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠল। মৃণালিনীর মনে হলো, সে যেন অজস্র নীরব আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছে, সেই বন্দি আত্মাদের কান্না। সেই মিষ্টি কিন্তু অস্বস্তিকর গন্ধটা আরও তীব্র হলো, আর তার কানে সেই অশুভ বাঁশির ক্ষীণ সুর ভেসে আসতে লাগল, যেন গুহার অন্ধকার থেকে কেউ তাকে ডাকছে। মৃণালিনী বুঝতে পারছিল, এই নিষিদ্ধ গুহা কেবল বুমসিরার অভিশাপের কেন্দ্র নয়, এটি তার বোনের রহস্যের চাবিকাঠিও। কিন্তু এই রহস্যের গভীরে যা লুকিয়ে আছে, তা হয়তো তার ধারণারও বাইরে, এক ভয়ংকর সত্য যা তার জীবন চিরতরে পাল্টে দিতে পারে। গুহার অন্ধকার যেন ক্রমশ তার দিকে এগিয়ে আসছে, আর সেই বাঁশির সুর তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অমোঘ পরিণতির দিকে।

অধ্যায় ৬: দেহজ উপাসনা

নিষিদ্ধ গুহা থেকে ফিরে আসার পর মৃণালিনী নিজেকে তাঁবুর মধ্যে আটকে রাখল। তার মন অস্থির, শরীর ক্লান্ত। সে তার সংগ্রহ করা সব তথ্য, রিনির ডায়েরি, আর আই-এর দেওয়া পাণ্ডুলিপির অংশবিশেষ নিয়ে বসলো। তার নিজের ব্যক্তিগত ক্ষত, রিনির হারানো স্মৃতি – সব যেন এই গবেষণার সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সে জানত, এইবার সে শুধু একজন সংরক্ষণবিদ নয়, বরং এক ভগ্নী, যে তার বোনের রহস্য উন্মোচন করতে বদ্ধপরিকর।

বিভিন্ন সূত্র মিলিয়ে মৃণালিনী এক ভয়াবহ সত্যের মুখোমুখি হলো। তার গবেষণা তাকে জানান দিল, বুমসিরা গ্রামে এক সময় এক ভয়ংকর দেবী-উপাসনা চলত, যার নাম ছিল ‘শক্তির অর্চা’ বা ‘দেহজ উপাসনা’। এটি ছিল স্থানীয় এক বিলুপ্ত জনজাতির প্রাচীন প্রথা। এই উপাসনায়, দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য বলি ছিল বাধ্যতামূলক। আর এই বলি কেবল পশু নয়, ছিল মানুষেরও। বলি দেওয়ার সময় একটি বিশেষ মাটির বাটিতে সেই বলির রক্ত সংগ্রহ করা হত।

পাণ্ডুলিপি আর পুরনো লোককথার বিবরণ অনুযায়ী, প্রতিটি বলির আত্মা সেই বাটিতে ধরে রাখা হত। বাটিগুলো ছিল আত্মার ধারক। যখন বলি দেওয়া হত, তখন বলির আত্মার শক্তি বাটির মধ্যে শোষিত হত এবং সেই আত্মাকে আর মুক্তি দেওয়া হত না। এই আত্মারা ছিল দেবীর দাস। আর তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হত এক বিশেষ বাঁশির সুরের মাধ্যমে।

মৃণালিনীর গলার ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। তাহলে বাঁশির ডাকের রহস্য এটাই! আই-এর বলা সেই বাঁশির সুর, যা মৃত আত্মাদের ডেকে নিয়ে আসত, সেটা তাহলে এই বাটিতে বন্দী আত্মাদের জাগিয়ে তোলার জন্য ব্যবহার করা হত! বাঁশির মাধ্যমে তাদের ডাকা হত, নতুন শিকারের জন্য। মনোজের চোখ উপড়ে ফেলা, গলায় কাটা দাগ – এই সবই ছিল সেই আচারের অংশ, যেখানে আত্মাকে শরীর থেকে বিচ্যুত করে বাটিতে বন্দী করা হত।

মৃণালিনীর চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই গুহার দৃশ্য – শত শত বাটি, আর তার পাশে কঙ্কালের স্তূপ। প্রতিটি কঙ্কাল এক একটি বলির নীরব সাক্ষী। আর সেই বাটিগুলো, সেগুলো শত শত বন্দি আত্মার বাসস্থান। তার মনস্তাত্ত্বিক চাপ আরও বেড়ে গেল। সে অনুভব করতে পারছিল, এখন সেই আত্মারা বাঁশির টানে ছুটে আসছে। তারা মুক্তি চায়, অথবা তারা নতুন সঙ্গীদের চায়, যারা তাদের মতো এই বাটিতে বন্দী হবে।

রিনির ডায়েরি আবার হাতে নিল মৃণালিনী। “বাঁশির শব্দটা… কাছে আসছে… ওরা আসছে… আমাকে ডাকছে… সেই বাটি…!” রিনিও সেই একই বাঁশির সুর শুনেছিল। রিনির শেষ লেখা, তার অসম্পূর্ণ বাক্য – সব কিছুর পেছনে সেই আত্মাদের ডাক, আর বাটিতে বন্দী হওয়ার ভয়।

মৃণালিনী চোখ বন্ধ করল, আর তার মনে এক ভয়াল সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারে, হয়তো তার বোনও তাদের মধ্যে আছে। রিনি এখন আর হয়তো জীবিত নেই, সেও সেই আত্মাদেরই একজন, যারা বাটির ভেতরে বন্দী। আর রাতের সেই বাঁশির সুর, রিনির কণ্ঠস্বর – সবই হয়তো তারই মুক্তির আকুতি, অথবা নতুন শিকারের জন্য এক অশুভ ডাক।

তাঁবুর বাইরে, রাত গভীর হচ্ছে। ক্যাম্পের জেনারেটরের শব্দ যেন আরও একঘেয়ে লাগছে। মৃণালিনী উঠে দাঁড়াল, তার হাতে রিনির ডায়েরি। তাকে বাঁচতে হবে এবং রিনির আত্মাকে মুক্তি দিতে হবে। কিন্তু কীভাবে? সে কি সেই বাটিগুলো ধ্বংস করবে? নাকি সেই বাঁশিকে? নাকি তাকেও এই অশুভ শক্তির সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে, যা শত শত বছর ধরে বুমসিরাকে গ্রাস করে রেখেছে? তার চারপাশে এক অদৃশ্য আতঙ্ক দানা বাঁধছিল, আর সে অনুভব করছিল, বুমসিরার অভিশাপ এবার তাকেও তার শেষ সীমানায় টেনে নিয়ে যাবে।

অধ্যায় ৭: বাটির ভিতরে

সেদিন রাতটা ছিল ঘোর অমাবস্যা। আকাশে মেঘের ঘনঘটা, আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল মুহুর্মুহু। বুমসিরার পাহাড়ে তখন এক প্রলয়ঙ্করী ঝড় শুরু হয়েছে। গাছপালা দুলে উঠছে বিকট শব্দে, বিদ্যুতের ঝলকানি মুহূর্তের জন্য চারদিক আলোকিত করে তুলছে, আর সেই আলো-আঁধারিতে পাহাড়ের চূড়া থেকে ভেসে আসছিল এক অদ্ভুত আর্তনাদ, যেন শত শত আত্মা একযোগে চিৎকার করছে। ক্যাম্পের জেনারেটর বিকল হয়ে গেছে, চারিদিক ঘন অন্ধকারে ডুবে গেছে।

মৃণালিনী তাঁবুর ভেতরে নিজেকে গুটিয়ে বসেছিল। তার কানের কাছে সেই বাঁশির সুরটা যেন আরও তীব্র হয়ে বাজছিল, আর রিনির কণ্ঠস্বর আরও স্পষ্ট হয়ে ডাকছিল, “দিদি… এসো… আমরা তোমার অপেক্ষায়…”। ঝড়ের তীব্রতা যেন তার মনের অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই ঝড় যেন তাকে গুহার গভীরে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে, যেখানে তার বোন হয়তো তার জন্য অপেক্ষা করছে।

হঠাৎ, এক বিকট শব্দে তার তাঁবুর খুঁটি ভেঙে গেল। তাঁবুটা তার উপর ভেঙে পড়ল, আর সে ছিটকে গেল বাইরে। ঝড়ের তীব্রতায় সে নিজেকে সামলাতে পারল না। অন্ধকার আর বাতাসের ঝাপটায় সে কোথায় যাচ্ছে, তা বুঝতে পারছিল না। তার মনে হলো, যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচের দিকে। সে নিজেকে থামাতে চাইল, কিন্তু পারল না। পাথরের উপর দিয়ে ছিটকে যেতে যেতে তার শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল।

অবশেষে, সে এক জায়গায় এসে থামল। মাথার উপর দিয়ে এক বিশাল পাথর সরে গেছে, আর তার সামনে এক গভীর অন্ধকার গহ্বর। টর্চটি তার হাত থেকে ছিটকে গেছে। মৃণালিনী তার মোবাইল ফোনের আলো জ্বেলে দেখল—সে সেই নিষিদ্ধ গুহার ভেতরে এসে পড়েছে! ঝড়ের কারণে গুহার প্রবেশপথের পাথর সরে গেছে, আর সে সোজা গুহার গভীরে গিয়ে পড়েছে। তার পায়ের কাছ থেকে একটি ভাঙা পাথরের টুকরো গুহার গভীরে গড়িয়ে গেল, তার শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে মিলিয়ে গেল এক অসীম শূন্যতায়।

মৃণালিনী উঠে দাঁড়াল। তার শরীর ব্যথা করছিল, কিন্তু তার মনে এক অদ্ভুত সংকল্প। সে গুহার গভীরে প্রবেশ করল। মোবাইল ফোনের টিমটিমে আলোয় সে দেখল, চারদিকে শত শত বাটি সাজানো, আর তার পাশে কঙ্কালের স্তূপ। গুহার ভেতরটা ঠান্ডা, বাতাসে সেই পুরনো, মিষ্টি গন্ধটা তীব্র হয়ে উঠেছে।

সে যখন গুহার আরও গভীরে প্রবেশ করল, তখন সেই বাঁশির সুরটা আরও স্পষ্ট হলো, যেন গুহার দেওয়ালগুলো থেকেই ভেসে আসছে। আর তার সাথে মিশে যাচ্ছে অসংখ্য ফিসফিসানি। “এসো… দিদি… এসো…”

মৃণালিনী অনুভব করল, তার শরীরটা যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে, তার চেতনা যেন পরিবর্তিত হচ্ছে। সে দেখল, গুহার শেষ প্রান্তে একটি ছোট কুন্ড, তার থেকে এক নীলচে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সেই আলোর দিকে এগিয়ে যেতেই, তার চোখ কুন্ডের পাশেই, সেই নীলচে আলোর ভেতরে, সে দেখতে পেল এক ছায়া মূর্তি। ছায়াটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো, আর মৃণালিনীর হৃৎপিণ্ড থেমে গেল। সে দেখতে পায়, তার বোন সত্যিই আছে সেখানে!

রিনি দাঁড়িয়ে আছে কুন্ডের পাশে, তার চেহারা ফ্যাকাশে, চোখ দুটো বড় বড়। সে হাসছে, কিন্তু তার হাসিটা প্রাণহীন। রিনি ছিল, কিন্তু বেঁচে নেই! তার শরীরটা ছিল স্বচ্ছ, যেন ধোঁয়া দিয়ে তৈরি। রিনি হাত বাড়িয়ে মৃণালিনীকে ডাকছে, তার মুখে সেই চেনা হাসি, কিন্তু তার চোখগুলো ছিল গভীর শূন্যতায় ভরা।

“দিদি… চলে এসো…” রিনি ফিসফিস করে বলল, তার কণ্ঠস্বর যেন শত শত মৃত আত্মার সমষ্টি। “তুমিও এসো, আমরা তোমার অপেক্ষায়…”

মৃণালিনী বুঝতে পারল, সে এক মায়াময় বাস্তব-অবাস্তবের মাঝে আটকা পড়েছে। রিনি সত্যিই এখানে আছে, কিন্তু এক অন্য রূপে, এক আত্মা হয়ে। তার বোন তাকে তার জগতে টেনে নিতে চাইছে, যেখানে শত শত বলির আত্মা বন্দী হয়ে আছে। মৃণালিনীর চারপাশে, গুহার অন্ধকার থেকে ভেসে আসছিল সেই ফিসফিসানি, “তুমিও এসো, আমরা তোমার অপেক্ষায়…”। প্রতিটি শব্দ যেন তার মস্তিষ্ককে গ্রাস করছিল, তার আত্মাকে টেনে নিচ্ছিল বাটির গভীরে। মৃণালিনী জানত, যদি সে একবার এই মায়ার টানে রিনির কাছে চলে যায়, তাহলে সে আর কখনোই বাস্তব জগতে ফিরে আসতে পারবে না। সেও হবে বুমসিরার বাটির নতুন দাস, শত শত মৃত আত্মার একজন। ঝড়ের শব্দ তখনো গুহার ভেতরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, আর মৃণালিনী অনুভব করছিল, তার জীবনের শেষ পরীক্ষা শুরু হয়েছে।

অধ্যায় ৮: শেষ বাঁশি

বাইরে তখন ঝড়ের তাণ্ডব আরও বেড়ে গেছে। পাহাড় কেঁপে উঠছিল, যেন কোনো অশুভ শক্তি তাকে গ্রাস করতে চাইছে। হঠাৎই, এক বিকট শব্দে গুহার ভেতরের বাতাস কেঁপে উঠল। পাথরের টুকরোগুলো ভেঙে পড়তে লাগল, আর মাটি কাঁপতে শুরু করল প্রবলভাবে। দূর থেকে ভেসে আসছিল এক ভয়াবহ গুম গুম শব্দ, যা ক্রমাগত কাছে আসছিল।

মৃণালিনী বুঝতে পারল – ড্যাম বিস্ফোরণ! এতদিনের কাজ, সরকারের এত বড় প্রজেক্ট – সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের বুক চিরে তৈরি হওয়া সেই ড্যাম ভেঙে যাচ্ছে, আর তার সাথে মিশে যাচ্ছে বুমসিরার অস্তিত্ব। এই বিস্ফোরণ শুধু ড্যামের নয়, এটা যেন শত শত বছরের অভিশাপকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার এক ভয়ঙ্কর শক্তি।

গুহার ভেতরটা তখন ধুলো আর পাথরের টুকরোয় ভরে যাচ্ছিল। রিনির ছায়া আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল, তার চোখ থেকে যেন এক মায়াবী আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। রিনি হাত বাড়িয়ে মৃণালিনীকে আরও প্রবলভাবে টানতে লাগল, “দিদি… চলে এসো… আমাদের সাথে… মুক্তি নেই… শুধু এখানেই শান্তি…”। রিনির কণ্ঠস্বর এখন আর্তনাদে পরিণত হয়েছে, তার চোখগুলো গভীর শূন্যতায় ভরা। সে চাইছে মৃণালিনীও তাদেরই একজন হোক।

মৃণালিনী দেখল, তার বোন তাকে টানছে এক অতল গহ্বরের দিকে, যেখানে কেবল মৃত্যু আর আত্মার দাসত্ব। আর একই সময়ে, পাহাড়ের কম্পন, পাথর ভাঙার শব্দ, ধুলোর কণা – বাস্তব তাকে ছিঁড়ে টানছে বাইরে, জীবনের দিকে। তার মন চাইছে রিনির কাছে যেতে, তার ভালোবাসা আর বোনের জন্য আত্মত্যাগ করতে। কিন্তু তার ভেতর থেকে এক প্রবল প্রতিরোধ শক্তি তাকে থামিয়ে দিচ্ছিল। সে জানত, রিনিকে বাঁচাতে হলে তাকে এই মায়ার জাল ছিঁড়ে বেরোতে হবে।

গুহার ছাদ থেকে বিশাল পাথরের টুকরো ভেঙে পড়ছিল। মৃণালিনী বুঝে গেল, আর সময় নেই। তাকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে কি বাঁচবে? নাকি থেকে যাবে বাটির ভিতরে সেই শত বলির আত্মাদের সঙ্গে?

মৃণালিনী চোখ বন্ধ করল। তার মনে পড়ল রিনির হাসিমাখা মুখ, তাদের ছোটবেলার স্মৃতি, তার জীবনের প্রতি রিনির ভালোবাসা। রিনি কখনও চাইত না তার দিদি এমন এক অভিশপ্ত জায়গায় আটকা পড়ুক। তার বোন মুক্তি চায়, আর সেই মুক্তি কেবল তাকে একা ছেড়ে দেওয়ায়।

এক চরম মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে মৃণালিনী সিদ্ধান্ত নিল। সে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে রিনির হাতের টান থেকে নিজেকে মুক্ত করল। “না রিনি! আমি তোকে মুক্তি দেব! তুই শান্তিতে থাক!” মৃণালিনীর কণ্ঠস্বর ফেটে যাচ্ছিল, তার চোখের জল গাল বেয়ে নামছিল।

রিনির ছায়া আর্তনাদ করে উঠল, তার মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। গুহার ভেতর থেকে এক তীব্র আলো বিচ্ছুরিত হলো, আর বাঁশির সুরটা এক বীভৎস চিৎকারে পরিণত হয়ে মিলিয়ে গেল। মৃণালিনী অনুভব করল, সে যেন শূন্যে ভেসে যাচ্ছে, তার শরীরটা হালকা হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে ধুলো আর পাথরের টুকরো। সে আর কিছু দেখতে পেল না, তার চেতনা লুপ্ত হয়ে গেল।

অন্ধকার, তারপর এক দীর্ঘ নীরবতা।

অনেক দিন কেটে গেল। ড্যামের ধ্বংসস্তূপের নিচে বুমসিরা গ্রাম সম্পূর্ণরূপে চাপা পড়ে গেছে। সরকারি উদ্ধারকারী দল ধ্বংসাবশেষ সরানোর কাজ করছিল। পাহাড়ের সেই অংশটি এখন সম্পূর্ণ সমতল, কেবল কিছু বিচ্ছিন্ন পাথরের টুকরো আর কাদামাটি ছড়িয়ে আছে।

এক বিকেলে, শ্রমিকরা যখন ধ্বংসস্তূপ সরাচ্ছিল, তখন তাদের মধ্যে একজন একটি অদ্ভুত জিনিস খুঁজে পেল। কাদা আর পাথরের নিচে চাপা পড়া একটি বস্তু, যেটা দেখতে একটি পুরনো, হাতে গড়া মাটির বাটির মতো। বাটিটা ছিল ছোট, তার গায়ে কোনো নকশা নেই, কিন্তু তার গা থেকে এক অদ্ভুত ঠান্ডা অনুভূতি আসছিল।

শ্রমিকটি বাটিটা হাতে তুলে নিল। তার ভেতরের দিকে তাকিয়ে সে চমকে উঠল। ড্যামের ধ্বংসস্তূপের নিচে পাওয়া যায় একটি মাটির বাটি—ভেতরে কিছু রক্ত, আর একটি আধভাঙা সোনালি চুলের ক্লিপ—রিনির!

শ্রমিকটি ভয় পেয়ে বাটিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। বাটিটা মাটিতে পড়ে ভেঙে চৌচির হয়ে গেল, তার ভেতর থেকে এক আবছা, নীলচে আলো নিভে গেল। কিন্তু রিনির সেই আধভাঙা সোনালি চুলের ক্লিপটি মাটির উপরেই পড়ে রইল, ধ্বংসের নীরব সাক্ষী হয়ে।

ডঃ মৃণালিনী দাসের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সরকারি রিপোর্টে তাকে ‘নিখোঁজ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বুমসিরা গ্রামের লোককথা, সেই বাটির অভিশাপ আর রিনির ছায়া যেন আজও সেই ধ্বংসস্তূপের নিচে লুকিয়ে আছে, যা প্রমাণ করে—কিছু রহস্য চিরকাল অধরা থেকে যায়, আর কিছু আত্মা চিরকাল মুক্তি পায় না।

[সমাপ্ত]

ছবি : এআই

© পিনাকী রঞ্জন পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *