ভৌতিক গল্প : অন্ধকারের ছায়া

পিনাকী রঞ্জন পাল

অধ্যায় ১: পুরোনো বাড়ির চাবি

রাইমা সাধারণত রহস্য, অতীন্দ্রিয় বা অলৌকিক কোনো কিছুতে বিশ্বাস করত না। তার মন ছিল যুক্তিনির্ভর, বিজ্ঞানমনস্ক। সে কলকাতার এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্রী, প্রায় সবসময়ই বই আর গবেষণাপত্র নিয়ে মগ্ন থাকত। কিন্তু নিয়তির পরিহাস সম্ভবত এমনই, যখন সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল, তখনই ঘটল সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা। তার ঠাকুরদা, অসীম রঞ্জন চৌধুরী, মারা গেলেন। ঠাকুরদা ছিলেন এক অদ্ভুত মানুষ, নিজের জগতে মগ্ন, আর তার জীবনটা যেন ছিল এক খোলা বই, যার শেষ পৃষ্ঠাগুলো রহস্যে মোড়া। মৃত্যুর আগে ঠাকুরদা রাইমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন একটি জীর্ণ ডায়েরি আর একটি ছোট, মরচে পড়া চাবির গোছা। সেই ডায়েরিতেই লেখা ছিল এক পুরনো বাড়ির ঠিকানা, যার অস্তিত্ব সম্পর্কে রাইমা বিন্দুমাত্র অবগত ছিল না।

ডায়েরিটা ছিল চামড়ার বাঁধাই করা, পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে আর কালির লেখা স্থানে স্থানে অস্পষ্ট। ঠাকুরদা লিখেছিলেন, “এই চাবি তোর হাতে তুলে দিলাম, রাইমা। এ বাড়ির সঙ্গে আমার এক গভীর সম্পর্ক, এক করুণ ইতিহাস জড়িয়ে আছে। হয়তো তুই সেই রহস্যের কিনারা করতে পারবি, যা আমি কোনোদিন পারিনি। এ বাড়ি তোর প্রতীক্ষায় আছে, আমার শেষ ইচ্ছের মর্যাদা দিস।” রাইমা তখন কথাগুলোর গভীরতা বুঝতে পারেনি। তার কাছে মনে হয়েছিল, এটা বুঝি ঠাকুরদার শেষ বয়সের কোনো খেয়াল। কিন্তু ডায়েরির প্রতিটি পাতায় ছড়ানো ছিল কিছু ইঙ্গিত, কিছু অস্পষ্ট তারিখ, আর অদ্ভুত কিছু সাংকেতিক চিহ্ন। শেষ পাতায়, কালির কালচে দাগের নিচে, একটি ঠিকানা জ্বলজ্বল করছিল: “ভূতপুর, সুন্দরবন অঞ্চলের শেষ গ্রাম, বুড়ো শিবতলার পূর্ব প্রান্তে।”

সুন্দরবন? রাইমা চমকে উঠলো। তার ঠাকুরদার কোনো সম্পত্তির কথা সে জানত না, বিশেষ করে সুন্দরবনের মতো দুর্গম অঞ্চলে। গ্রামের নামটাও যেন কেমন ভৌতিক—ভূতপুর। যেখানে কেউ যায় না! এই বাক্যটাই যেন তার মনে এক গভীর কৌতূহলের জন্ম দিল। তার বিজ্ঞানমনস্ক মন যতই তাকে নিষেধ করুক না কেন, ইতিহাস নিয়ে কাজ করার সূত্রে তার ভেতরে সব সময় এক অনুসন্ধিৎসু সত্তা কাজ করত। এইবার সেই সত্তা যেন প্রবলভাবে জেগে উঠলো।

সে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু অর্জুনকে ফোন করলো। অর্জুন, কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র, রাইমাকে সব সময় আগলে রাখত। যেকোনো বিপদে বা সিদ্ধান্তে অর্জুনই ছিল তার প্রথম ভরসা। রাইমা যখন তাকে ঠাকুরদার ডায়েরি আর রহস্যময় বাড়ির কথা বললো, অর্জুন প্রথমে হাসলো। “ভৌতিক কিছু নাকি? তোর ঠাকুরদা কি হরর গল্পের প্লট রেখে গেছেন?” কিন্তু রাইমার চোখে যখন সে কৌতূহলের গভীরতা দেখতে পেল, তখন আর না করতে পারলো না।

এক শনিবার সকালে তারা দু’জনে মিলে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। যাত্রাটা ছিল বেশ দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর। প্রথমে বাস, তারপর লঞ্চ, তারপর আবার ছোট ডিঙি নৌকায় সরু খাল পেরিয়ে শেষমেশ ভূতপুর গ্রামের প্রান্তে পৌঁছালো তারা। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে, লালচে আলোয় পুরো গ্রামটাকে কেমন রহস্যময় দেখাচ্ছিল। গ্রামের মানুষগুলো তাদের দেখে কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল, যেন তারা অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো অতিথি। রাইমা আর অর্জুন দুজনেরই গা ছমছম করছিল, যদিও তারা মুখে কিছু বলেনি।

গ্রামের শেষ প্রান্তে, একটা ঘন জঙ্গলের পাশ দিয়ে হেঁটে তারা যখন সেই বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালো, তখন চারদিকে প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে। ঠাকুরদার ডায়েরির বর্ণনা অনুযায়ী, বাড়িটা ছিল একটা বিশাল এলাকা জুড়ে, চারদিকে উঁচু প্রাচীর। প্রাচীরের লতাপাতায় ঢাকা পুরনো লোহার গেটটা দেখে মনে হলো যেন বহু বছর ধরে কেউ খোলেনি। গেটের উপর বিশাল বটগাছের ডালপালা ঝুলে আছে, তাতে বাদুড়ের কিচিরমিচির। বাতাসের সাথে শুকনো পাতার মরমর শব্দ পরিবেশটাকে আরও ভুতুড়ে করে তুলল।

রাইমা হাত বাড়িয়ে মরচে পড়া গেটে হাত দিল। চাবির গোছা থেকে সবচেয়ে পুরনো চেহারার চাবিটা বের করে লক-এর গর্তে ঢোকালো। এক মোচড় দিতেই মরচে ধরা লোহার গেটটা বিশ্রী শব্দ করে খুলে গেল। একটা ঠাণ্ডা, স্যাঁতসেঁতে হাওয়া এসে তাদের স্পর্শ করলো, তাতে মেশানো ছিল পুরনো লোহা আর পোড়া মাটির এক অদ্ভুত গন্ধ। রাইমার শরীর শিউরে উঠলো। অর্জুনও কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠলো। এই জায়গাটা সত্যিই যেন অন্যরকম। গেটের ওপারে এক বিশাল, পরিত্যক্ত বাগান। আগাছায় ভরা, আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরনো বাড়ি। অন্ধকারে বাড়িটাকে এক বিশাল, মৃত দানবের মতো দেখাচ্ছিল। তার ভাঙা জানালাগুলো যেন মৃত চোখ, আর দরজার ফাঁক দিয়ে বের হওয়া কালো অন্ধকার যেন তার অদেখা মুখগহ্বর। তাদের দু’জনেরই এক অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো।

গেট পেরিয়ে তারা সাবধানে ভেতরে প্রবেশ করলো। শুকনো পাতা আর ভাঙা ডালপালায় ভরা পথটা পেরিয়ে তারা বাড়ির মূল দরজার সামনে দাঁড়ালো। দরজাটাও ছিল কাঠের তৈরি, তাতে ধুলোর পুরু আস্তরণ। অন্য একটা চাবি দিয়ে রাইমা সেই দরজাও খুলল। দরজার পাল্লা খুলতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো এক দম বন্ধ করা বাতাস। সেই বাতাসে মিশে ছিল স্যাঁতসেঁতে মাটির গন্ধ, আর এক ধরণের অদ্ভুত, মিষ্টি কিন্তু পচা গন্ধ, যা বমি বমি ভাব এনে দিচ্ছিল। টর্চের আলো জ্বেলে তারা ঘরের ভেতরে ঢুকল। ঘরের ভেতরে আসবাবপত্রগুলো ধুলোর চাদরে মোড়া, আর সব কিছুতে যেন এক দীর্ঘদিনের নীরবতা জমে আছে। তাদের মনে হলো, যেন তারা সময়ের কোনো এক রহস্যময় সুরঙ্গে প্রবেশ করেছে, যেখানে অতীত আর বর্তমানের মাঝে এক অদেখা দেয়াল। তারা তখনও জানত না, এই বাড়ির ভেতরে তাদের জন্য কী ভয়ংকর সত্য অপেক্ষা করছে।

অধ্যায় ২: প্রথম রাতের আওয়াজ

বাইরের অন্ধকারে যখন চারিদিক ঢাকা পড়েছে, রাইমা আর অর্জুন পুরনো বাড়ির ভেতরের পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। ধুলো আর স্যাঁতসেঁতে গন্ধটা তখনও তীব্র, কিন্তু তারা জোর করে শ্বাস নিতে লাগল। তারা প্রথমে শোবার ঘরটা ঠিক করার সিদ্ধান্ত নিল। সেকেলে আসবাবপত্রগুলো কাপড় দিয়ে ঢাকা, সেগুলোকে সরিয়ে তারা একটি পরিষ্কার জায়গা বের করল। নিজেদের বিছানার চাদর বিছিয়ে, ছোট টর্চ জ্বালিয়ে তারা ব্যাগ থেকে কিছু শুকনো খাবার আর জলের বোতল বের করল। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক ছিল না বললেই চলে, তাই বাইরের জগতের সাথে তাদের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা তাদের মনে এক ধরণের চাপা উদ্বেগ তৈরি করছিল, যদিও তারা মুখে কিছু বলেনি।

রাত যত গভীর হতে লাগল, বাইরের নিস্তব্ধতা যেন ঘরের ভেতরের ছোট ছোট শব্দগুলোকে আরও প্রকট করে তুলল। একটা পুরনো ঘড়ির টিক টিক শব্দ, জানালার বাইরে ঝোলা ডালপালার মচমচ আওয়াজ – সবকিছুই কেমন যেন রহস্যময় লাগছিল। রাইমা আর অর্জুন বিছানায় বসে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছিল। দিনের বেলার কৌতূহল এখন এক ধরণের অস্থিরতায় রূপ নিচ্ছিল। অর্জুন বলছিল, “জায়গাটা কেমন গা ছমছম করছে, না?” রাইমা মাথা নেড়ে সায় দিল। তার বিজ্ঞানমনস্ক মন যতই তাকে যুক্তির আশ্রয় দিতে চাক, ভেতরের এক অজানা ভয় তাকে গ্রাস করছিল।

তখনই হঠাৎ তারা দুজনেই স্পষ্ট শুনতে পেল, ঘরের ভেতর থেকে পায়ের শব্দ আসছে! প্রথমে ছিল খুব মৃদু, যেন কেউ সন্তর্পণে হেঁটে চলেছে। শব্দের উৎস খুঁজে বের করার জন্য তারা টর্চ জ্বেলে চারিদিকে আলো ফেলল। কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে পেল না। ঘরটা তো পুরোপুরি বন্ধ! কোথা থেকে আসছে এই শব্দ? অর্জুন হেসে উঠলো, “মনে হয় ইঁদুর টিঁদুর হবে। পুরনো বাড়িতে এগুলো থাকেই।” রাইমাও নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে এটা ইঁদুরেরই শব্দ। কিন্তু তাদের দু’জনের মনেই এক ধরণের অস্বস্তি দানা বাঁধতে শুরু করল। ইঁদুরের পায়ের শব্দ এমন চাপা আর ভারী হয় না, যেন কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সন্তর্পণে হেঁটে চলেছে।

শব্দটা বন্ধ হলো না। বরং মনে হলো যেন তাদের বিছানার কাছেই আসছে। রাইমা আর অর্জুন একে অপরের দিকে তাকালো। তাদের মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। এইবার আর ইঁদুরের অজুহাত খাটে না। এই শব্দ সাধারণ কোনো প্রাণীর হতে পারে না। ঠিক তখনই, সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে, তারা ফিসফিস করে কথা বলার একটা মৃদু আওয়াজ শুনতে পেল। শব্দটা যেন ঘরের দেয়াল ফুঁড়ে আসছিল, আর তা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল। মনে হলো যেন কেউ তাদের কানের কাছে এসে বলছে।

অর্জুন টর্চের আলোটা শব্দের উৎস লক্ষ্য করে ফেলল, কিন্তু কিছু দেখা গেল না। রাইমা ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো। তার যুক্তি আর বিজ্ঞানবোধ যেন এক নিমেষে ভেঙে পড়লো। সে অর্জুনের হাত শক্ত করে ধরলো। শব্দটা আরও স্পষ্ট হলো, যেন এক নারীকণ্ঠ, ফ্যাসফেসে আর শুকনো। সেই কণ্ঠস্বর যেন সরাসরি তাদের মস্তিষ্কে আঘাত হানল: “এটা তোমাদের শেষ সুযোগ… চলে যাও… নয়তো…”

কথাগুলো অস্পষ্ট হলেও তার অর্থ বুঝতে তাদের বিন্দুমাত্র দেরি হলো না। তাদের শরীর হিম হয়ে গেল। এটা কোনো ইঁদুর নয়, এটা কোনো সাধারণ আওয়াজ নয়। এটা অন্য কিছু, এমন কিছু যা তারা জীবনেও দেখেনি বা বিশ্বাস করেনি। অর্জুন সাহসী ছেলে হলেও, এই অভিজ্ঞতায় তার মুখ সাদা হয়ে গেল। তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল। সে রাইমাকে জড়িয়ে ধরলো।

ঘরের ভেতরের বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে উঠলো। একটা শীতল স্রোত তাদের গা বেয়ে নেমে গেল। তারা বুঝতে পারল, এই বাড়িতে তারা একা নয়। এখানে আরও কিছু আছে, যা তাদের উপস্থিতি পছন্দ করছে না। ফিসফিসানিটা থেমে গেল, কিন্তু তার রেশ তাদের মনে তখনও বাজছিল। তারা একে অপরের দিকে তাকালো। তাদের চোখে ভয়, বিস্ময় আর এক ধরণের গভীর জিজ্ঞাসা। কেন এই বাড়ি তাদের শেষ সুযোগের কথা বলছে? কিসের সুযোগ? আর না গেলে কী হবে?

তাদের মনে পড়ল ঠাকুরদার ডায়েরির শেষ কথাগুলো: “এ বাড়ি তোর প্রতীক্ষায় আছে।” আর গ্রামের লোকেদের অদ্ভুত দৃষ্টি। এই বাড়িতে নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে, যা সাধারণ মানুষের কল্পনার অতীত। রাতটা যেন অনন্ত মনে হচ্ছিল। তারা দু’জনেই ভয়ে চুপচাপ শুয়ে রইল, কোনো কথা বলার সাহস পেল না। কেবল নিজেদের হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে ডাক আর দূর থেকে আসা শিয়ালের হাঁক তাদের মনে এক অজানা আতঙ্ক তৈরি করছিল। এই প্রথম, রাইমা অনুভব করল, তার যুক্তির প্রাচীর ভেঙে পড়ছে, আর সে এক অজানা, অলৌকিক শক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। সেই রাতটা ছিল তাদের জীবনে দেখা সবচেয়ে দীর্ঘ, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাত।

অধ্যায় ৩: আয়নার প্রতিবিম্ব

রাতটা কোনোমতে পার হয়েছিল রাইমা আর অর্জুনের। ভোরের আলো ফুটতেই তাদের চোখে একটু স্বস্তি ফিরে এসেছিল, যদিও গত রাতের ফিসফিসানি আর পায়ের শব্দ তাদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। ভয়ের আতিশয্যে তারা দু’জনে এক মুহূর্তের জন্যও চোখ বন্ধ করতে পারেনি। সারা রাত ধরে তাদের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, “কে ছিল ওটা? কিসের শেষ সুযোগ?” ভোরের আবছা আলোয় ঘরের ভেতরের ধুলো আর ভাঙাচোরা আসবাবপত্রগুলো যেন আরও রহস্যময় লাগছিল।

সূর্য ওঠার পর, বাইরের উজ্জ্বল আলোয় তাদের ভয় কিছুটা কমলো। অর্জুন বলল, “রাইমা, আমরা হয়তো ভুল শুনেছি। হয়তো ক্লান্তির কারণে এমনটা মনে হয়েছে।” রাইমা মাথা ঝাঁকাল, নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তার ভেতরের অস্বস্তি কাটল না। তার বিজ্ঞানমনস্ক মন যতই যুক্তি দিক, গত রাতের অভিজ্ঞতা তাকে নাড়া দিয়েছিল। তারা দু’জনেই ক্লান্ত আর অবসন্ন ছিল, কিন্তু এই অবস্থায় ফিরে যাওয়ার কথা তারা ভাবতেও পারছিল না। ঠাকুরদার ডায়েরির রহস্য তাদের আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

তারা প্রথমে বাথরুমের দিকে গেল। পুরনো দিনের বাড়ি, ভেতরে আধুনিকতার কোনো চিহ্ন নেই। কল থেকে যে জল পড়ছিল, তা ছিল ঠান্ডা আর মরচে ধরা পাইপের গন্ধ মেশানো। রাইমা হাত-মুখ ধোয়ার জন্য ঘরের এক কোণে রাখা ভাঙা আয়নার সামনে দাঁড়াল। আয়নাটা ছিল বেশ পুরোনো, তার ফ্রেমগুলো কালো হয়ে গেছে আর কাঁচের ওপর ধুলোর পুরু আস্তরণ। রাইমা তার সালোয়ারের ওড়না দিয়ে আয়নার ধুলো মুছতে শুরু করল।

ধুলো সরতেই আয়নায় প্রথমে নিজের ফ্যাকাশে মুখটা দেখতে পেল রাইমা। সারারাত না ঘুমানোর কারণে তার চোখগুলো লালচে দেখাচ্ছিল। সে নিজেকে দেখে হতাশ হলো। কিন্তু পরক্ষণেই তার হৃৎপিণ্ড যেন থেমে গেল! আয়নার ভেতর নিজের মুখের পাশে আরেকটি মুখ স্পষ্ট দেখতে পেল সে! সেটা একটি ফ্যাকাশে মেয়ের মুখ, তার চোখ দুটো স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বড়, আর সেই চোখে যেন রক্ত লেগে আছে! মেয়েটির মুখটা করুণ, কিন্তু তার দৃষ্টিতে ছিল এক অদ্ভুত শীতলতা। রাইমার সমস্ত শরীর ভয়ে কাঁপতে লাগল। সে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না।

আয়নার প্রতিবিম্বটা স্থির হয়ে ছিল, যেন মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। রাইমা ভয়ে পিছিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু তার পা দুটো যেন মাটিতে গেঁথে গিয়েছিল। সে নিজের চোখ কচলে আবার তাকাল। হ্যাঁ, মুখটা এখনও সেখানেই আছে, স্পষ্ট, বাস্তব। এটা কোনো ভ্রম নয়। তার চোখের সামনেই যেন এক অলৌকিক সত্তা মূর্ত হয়ে উঠেছে।
তারপর ঘটল আরও ভয়ংকর কিছু। আয়নার কাঁচের ওপর, সেই ফ্যাকাশে মেয়েটির মুখের নিচেই, রক্তে লেখা অক্ষরগুলো ধীরে ধীরে ফুটে উঠলো: “১৯৪৭ সালের ভুল এখনো শোধ হয়নি।”

রাইমা বাক্যটি দেখে যেন পাথর হয়ে গেল। ১৯৪৭ সাল! ভারত ভাগের বছর! তার ঠাকুরদার ডায়েরিতেও অস্পষ্টভাবে সেই সময়ের কিছু উল্লেখ ছিল, যা সে তখন তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এখন, এই রক্তাক্ষরে লেখা বাক্যটি তাকে এক চরম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। তবে কি এই বাড়ির রহস্য ১৯৪৭ সালের কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িত? কিসের ভুল? আর সেই ভুল কেন এখনও শোধ হয়নি?

রাইমার চিৎকার শুনে অর্জুন ছুটে এল। “কী হয়েছে রাইমা? কী দেখেছিস?” অর্জুন আয়নার দিকে তাকিয়ে প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না। সে ভাবল রাইমা বোধহয় ভয় পেয়ে ভুল দেখছে। কিন্তু রাইমা যখন আয়নার দিকে আঙুল দিয়ে দেখালো, অর্জুনও এবার চমকে উঠলো। তার মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। সেও দেখতে পেল, রক্তাক্ষরে লেখা সেই বাক্যটি আর তার পাশের ফ্যাকাশে মেয়েটির অস্পষ্ট প্রতিবিম্ব। অর্জুন দ্রুত তার মোবাইল বের করে ছবি তোলার চেষ্টা করল, কিন্তু মোবাইলটা ধরতেই ব্যাটারির আলো নিভে গেল।

অর্জুন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “রাইমা, এটা কী হচ্ছে? এটা তো আর ইঁদুরের কাজ নয়!” রাইমা তখনও কাঁপছিল। তার বিজ্ঞানমনস্ক মন সম্পূর্ণরূপে ভেঙে গেছে। সে বুঝতে পারছিল, এই বাড়িতে এমন কিছু আছে, যা তাদের কল্পনারও অতীত। গত রাতের ফিসফিসানি, পায়ের শব্দ – সব কিছুর যেন এক নতুন অর্থ পাচ্ছিল। এই বাড়িটা তাদের কাছে কিছু বলতে চাইছে, এক গভীর রহস্যের জাল বুনছে।

রাইমা আর অর্জুন আয়নার সামনে থেকে সরে এল। তাদের মন জুড়ে তখন হাজারো প্রশ্ন আর এক গভীর আতঙ্ক। এই বাড়ির ইতিহাস কী? ১৯৪৭ সালে কী ঘটেছিল? আর এই ফ্যাকাশে মেয়েটি কে? সে কি এই বাড়িরই কোনো পুরনো বাসিন্দা, যে এখনও মুক্তি পায়নি? তাদের মনে হলো, যেন তারা এক এমন খেলার অংশ হয়ে উঠেছে, যার নিয়মকানুন তারা জানে না, আর যার শেষটা হয়তো খুবই ভয়াবহ হতে চলেছে। রাইমা ঠাকুরদার ডায়েরির কথা ভাবল। এই রহস্য হয়তো সেখানেই লুকিয়ে আছে। কিন্তু এই ভুতুড়ে বাড়িতে, যেখানে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই, সেখানে প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক নতুন আতঙ্ক নিয়ে আসছিল। তারা জানত না, এই আয়নার প্রতিবিম্ব কেবলই এক শুরুর ইঙ্গিত ছিল, আসল ভয়াবহতা তখনও তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।

অধ্যায় ৪: গোপন তলার সিঁড়ি

আয়নার সেই ফ্যাকাশে মুখ আর রক্তাক্ষরে লেখা বাক্যটি দেখে রাইমা ও অর্জুন দু’জনেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। ভোরের আলোয় তাদের ভয় কিছুটা কাটলেও, মনের গভীরে এক অজানা আতঙ্ক বাসা বেঁধেছিল। “১৯৪৭ সালের ভুল এখনো শোধ হয়নি” – এই কথাগুলো যেন তাদের মস্তিষ্কে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। তারা বুঝতে পারছিল, এই বাড়িতে তারা নিছকই কৌতূহল মেটাতে আসেনি, এসেছে এক গভীর এবং অন্ধকার ইতিহাসের মুখোমুখি হতে।

তারা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো, যেন এক দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেয়ে। দু’জনেরই মুখ ফ্যাকাশে। অর্জুন রাইমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের কি ফিরে যাওয়া উচিত, রাইমা? এটা হয়তো আমাদের জন্য নয়।” কিন্তু রাইমার চোখে তখন ভয় ছাপিয়ে এক অদ্ভুত জেদ ফুটে উঠেছে। ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে, এই রহস্যের সমাধান করার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাকে গ্রাস করেছিল। “না অর্জুন,” সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমরা এতদূর এসেছি। ঠাকুরদা এই চাবিটা হয়তো কোনো কারণ ছাড়াই দেননি। এই রহস্যের সমাধান আমাদের করতেই হবে।”

অর্জুন অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলো। তার বন্ধুর জেদ সে জানতো। তারা সিদ্ধান্ত নিল, দিনের আলো থাকতে থাকতেই তারা বাড়ির প্রতিটি কোণা ভালোভাবে খুঁজে দেখবে। যদি কোনো সূত্র পাওয়া যায়, যা এই অশরীরী ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারে। তারা প্রথমেই শোবার ঘরটিতে ফিরে গেল, যেখানে তারা গত রাতে ঘুমানোর চেষ্টা করেছিল। ঘরটা অন্যান্য ঘরের মতোই ধুলো আর ভাঙা আসবাবপত্রে ভরা।

অর্জুন একটা পুরনো আলমারির পাল্লা খোলার চেষ্টা করছিল, যখন হঠাৎ তার নজরে পড়ল মেঝের দিকে। ঘরের এক কোণে, একটি পুরনো কার্পেটের নিচে, মেঝের কাঠগুলো কেমন যেন অগোছালোভাবে বসানো। অর্জুন ধীরে ধীরে কার্পেটটা সরাল। তার নিচে দেখা গেল একটি লুকানো কাঠের ঢাকনা, তার চারপাশে মরচে ধরা কব্জা। তাদের দু’জনেরই হৃৎপিণ্ড দ্রুত তালে ধুকপুক করতে শুরু করলো। গত রাতের অজানা ভয়ে আর দিনের বেলার নতুন আবিষ্কারে তাদের শরীর টানটান হয়ে উঠল।

“মনে হচ্ছে, ঠাকুরদার ডায়েরির রহস্য এই ঢাকনার নিচেই লুকিয়ে আছে,” রাইমা ফিসফিস করে বলল। অর্জুন একটি পুরনো লোহার রড দিয়ে সাবধানে ঢাকনাটি তোলার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর ঢাকনাটি উঠল, আর তাদের সামনে বেরিয়ে এলো একটি সরু, অন্ধকার সিঁড়ি! সিঁড়িটা নিচের দিকে চলে গেছে, আর তার ভেতর থেকে ভেসে আসছে এক দুর্গন্ধ। গন্ধটা এতটাই তীব্র আর জঘন্য ছিল যে তাদের দু’জনেরই বমি পেয়ে গেল। যেন পচা মাংসের গন্ধ!

অর্জুন আর রাইমা একে অপরের দিকে তাকাল। এই গন্ধ কোনো সাধারণ ধুলো বা ইঁদুরের গন্ধ নয়। এটা কোনো পচনশীল বস্তুর গন্ধ। তাদের কৌতূহল ছাপিয়ে ভয় এবার জেদকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল। এই সিঁড়ির নিচে কী আছে, তা জানার জন্য তারা অস্থির হয়ে উঠল। অর্জুন তার টর্চ বের করে সিঁড়ির মুখে আলো ফেলল। সিঁড়িগুলো পাথরের তৈরি, স্যাঁতসেঁতে আর পিচ্ছিল। অন্ধকার যেন গিলে খাচ্ছিল আলোটাকে।

সাবধানে, এক পা দু’পা করে তারা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলো। প্রতি পদক্ষেপে তাদের মনে এক অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধছিল। অন্ধকার যত ঘন হচ্ছিল, পচা গন্ধটাও তত তীব্র হচ্ছিল। নিচটা যেন এক বদ্ধ কুঠুরি, যেখানে বাতাস চলাচল করতে পারে না। টর্চের আলোয় তারা দেখতে পেল, কুঠুরিটি ছোট, আর তার দেয়ালগুলো স্যাঁতসেঁতে। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে পুরনো মাটি আর কিছু ভাঙা পাত্রের টুকরো।

অর্জুন টর্চের আলোটা ঘুরিয়ে দেখছিল। হঠাৎ তার আলো একটা জিনিসের উপর গিয়ে স্থির হলো, আর তাদের দু’জনেরই শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। ঘরের এক কোণে, মাটির বেশ কয়েকটি ভাঙা কলসি পড়ে আছে। আর সেই ভাঙা কলসিগুলোর ভেতর থেকে উঁকি মারছে কিছু পুরনো হাড়গোড়! মানুষের হাড়! মাথার খুলি, হাতের হাড়, আর আরও অনেক ছোট ছোট হাড়ের টুকরো। সেগুলো এতটাই পুরনো যে মাটি আর ধুলোয় মিশে গেছে।

রাইমা আর অর্জুন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। তাদের শরীরের সমস্ত রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। এই প্রথম তারা এমন ভয়াবহ কিছু দেখল। এই হাড়গোড়গুলো কাদের? কেন এখানে এভাবে কলসিতে রাখা আছে? আর কেনই বা এমন পচা মাংসের গন্ধ? তাদের মনে পড়ল আয়নায় লেখা সেই “১৯৪৭ সালের ভুল”-এর কথা। তবে কি এই হাড়গোড়গুলো সেই ভুলেরই পরিণতি?

অর্জুন ভয়ে টর্চটা ফেলে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু রাইমা তাকে থামালো। তার মুখে ভয়ের চেয়েও বেশি ছিল এক ধরণের অস্থিরতা, এক ধরণের প্রবল জিজ্ঞাসা। সে জানতো, এই হাড়গোড়গুলোই হয়তো এই বাড়ির রহস্যের মূল সূত্র। তারা আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করার জন্য সাহসী হলো। রাইমা নিচু হয়ে একটি ভাঙা কলসির দিকে এগিয়ে গেল। মাটির কলসির ভেতরে শুধু হাড়গোড়ই নয়, তার সাথে আরও কিছু ছিল – কিছু মরচে ধরা গয়না, আর ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো।

অধ্যায় ৫: ভুতুড়ে ডায়েরি

অর্জুন কাঁপা হাতে টর্চ ধরেছিল। তার চোখ তখনও হাড়গোড়গুলোর দিকে স্থির। “রাইমা, আমরা আর এক মুহূর্তও এখানে থাকব না। এটা আমাদের কাজ নয়। আমাদের এখান থেকে এক্ষুনি বেরিয়ে যাওয়া উচিত।” অর্জুনের কণ্ঠে স্পষ্ট ভয়।

কিন্তু রাইমার চোখে তখন অন্য এক উন্মাদনা। ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে, এই নির্মম সত্যের গভীরে প্রবেশ করার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাকে গ্রাস করেছিল। এই হাড়গোড়গুলো কেবল মৃতদেহের অবশেষ ছিল না, ছিল ইতিহাসের এক চাপা পড়া অধ্যায়। “অর্জুন, শান্ত হ। আমরা এতদূর এসেছি। এই হাড়গোড়গুলো একটা গল্প বলছে, আর সেই গল্পটা আমাদের শুনতে হবে।”

রাইমা সাবধানে একটা ভাঙা কলসির কাছে এগিয়ে গেল। পচা গন্ধটা অসহ্য লাগছিল, কিন্তু সে নিজেকে সামলে নিল। টর্চের আলোয় সে কলসির ভেতরে আরও কিছু দেখল। হাড়গোড়ের নিচে চাপা পড়েছিল একটি কালো রঙের জীর্ণ ডায়েরি। ডায়েরিটা ছিল চামড়ার বাঁধাই করা, বহু পুরনো, ধুলো আর নোংরায় মাখা। রাইমা হাত বাড়িয়ে ডায়েরিটা তুলে নিল। তার হাত কাঁপছিল। সে জানতো, এই ডায়েরিতেই হয়তো লুকিয়ে আছে এই বাড়ির সব রহস্য।

অর্জুন তখনও ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে ছিল, কিন্তু রাইমার দৃঢ়তা দেখে সেও কিছুটা সাহস পেল। তারা দু’জনে কুঠুরি থেকে বেরিয়ে এসে সিঁড়ি বেয়ে আবার শোবার ঘরে ফিরে এলো। বাইরের সামান্য আলো ঘরে প্রবেশ করছিল, তাতে কিছুটা স্বস্তি পেল তারা। রাইমা ধুলো ঝেড়ে ডায়েরিটা খুলল। পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে, আর কালির লেখা স্থানে স্থানে অস্পষ্ট। প্রথম কয়েকটি পাতা ছিল সাধারণ দিনের কথা, কিন্তু তারপরই লেখাগুলো ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগল।

ডায়েরিতে লেখা ছিল এক পরিবারের করুণ ইতিহাস। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় এই বাড়িটি ছিল এক হিন্দু জমিদার পরিবারের। তাদের নাম ছিল রায়চৌধুরী পরিবার। ডায়েরির লেখক ছিলেন পরিবারেরই এক সদস্য, সম্ভবত জমিদার মশাইয়ের ছোট মেয়ে, যার নাম ছিল ঊর্মিলা। ঊর্মিলা তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন, কীভাবে দেশভাগের উত্তাল সময়ে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে পড়ছিল। তাদের গ্রামেও একদল উন্মত্ত জনতা এসে আক্রমণ করেছিল। তারা ভেবেছিল, এই পরিবার সীমান্তের ওপার থেকে আসা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিচ্ছে।

ঊর্মিলা লিখেছিলেন, যেদিন দাঙ্গাকারীরা তাদের বাড়িতে আক্রমণ করে, সেদিন তারা বাড়ির গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে ছিল। তারা ভেবেছিল, সেখানেই তারা সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু দাঙ্গাকারীরা তাদের খুঁজে বের করে। ডায়েরিতে বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছিল সেই ভয়াবহ রাতের কথা। কীভাবে দাঙ্গাকারীরা তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিল। ঘরের ভেতরেই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, আর তারা আটকা পড়ে সেই গোপন কুঠুরিতে। শেষ মুহূর্তে তাদের মধ্যে একজন, যিনি বাইরে থেকে সাহায্য আনতে গিয়েছিলেন, তিনি ফিরে এসে দেখেন, বাড়ির সব জানালা-দরজা বন্ধ, ভেতর থেকে চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। তিনি চেষ্টা করেও কাউকে বাঁচাতে পারেননি। সেই ভয়ঙ্কর রাতটিই ছিল রায়চৌধুরী পরিবারের শেষ রাত।

রাইমা আর অর্জুন ডায়েরিটা পড়তে পড়তে যেন সেই বিভীষিকাময় অতীতে ফিরে গিয়েছিল। তারা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল সেই পরিবারের আর্তনাদ, আগুনের লেলিহান শিখা, আর উন্মত্ত জনতার উল্লাস। তাদের মনে পড়ল আয়নায় লেখা সেই “১৯৪৭ সালের ভুল এখনো শোধ হয়নি” বাক্যটি। এইবার তার অর্থ পরিষ্কার হলো। এই পরিবারের উপর যে অবিচার হয়েছিল, তার প্রতিশোধ তারা এখনও পায়নি।

ডায়েরির শেষ পাতায় গিয়ে তাদের শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। সেখানে রক্তে লেখা ছিল কিছু অস্পষ্ট শব্দ, যা দেখে মনে হলো যেন কেউ মৃত্যুর শেষ মুহূর্তে লিখে গেছে। রক্ত শুকিয়ে গেছে, কিন্তু তার লালচে দাগ তখনও স্পষ্ট। সেই শব্দগুলো যেন তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছিল, এক ভয়ংকর ভবিষ্যৎবাণী নিয়ে: “তোমরা পরবর্তী।”

রাইমা আর অর্জুন একে অপরের দিকে তাকালো। তাদের মুখে ভয়ের চেয়েও বেশি ছিল এক ধরণের অস্থিরতা, এক ধরণের অবিশ্বাস। “তোমরা পরবর্তী” মানে কী? তার মানে কি এই পরিবারের আত্মারা তাদের মুক্তি চায়? আর তাদের মুক্তি না দিলে কি তারা রাইমা আর অর্জুনকে তাদের পূর্বসূরীদের ভাগ্য বরণ করতে বাধ্য করবে? গত রাতের ফিসফিসানি, আয়নার প্রতিবিম্ব – সব কিছুর যেন এক নতুন এবং ভয়াবহ অর্থ পাচ্ছিল।

তারা বুঝতে পারছিল, এই বাড়িতে তারা নিছকই কৌতূহল মেটাতে আসেনি, এসেছে এক নির্মম ইতিহাসের সাক্ষী হতে। ঠাকুরদার ডায়েরি, সেই চাবি, আয়নার প্রতিবিম্ব, গোপন কুঠুরির হাড়গোড়, আর এখন এই কালো ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় লেখা রক্তাক্ষরের ভবিষ্যৎবাণী – সব কিছু যেন তাদের এক অদৃশ্য জালে বেঁধে ফেলছিল। তারা জানত না, এই ডায়েরি তাদের জন্য কী পরীক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করছে, আর সেই পরীক্ষার শেষটা কত নির্মম হতে চলেছে। তারা দু’জনেই এক চরম সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল: এই বাড়িটা তাদের মুক্তি চায়, আর সেই মুক্তির একমাত্র পথ হয়তো তাদের জীবন দিয়েই তৈরি হবে।

অধ্যায় ৬: অদৃশ্য হাত

কালো ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় রক্তে লেখা “তোমরা পরবর্তী” বাক্যটি রাইমা আর অর্জুনের মনে এক গভীর আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল। দিনের আলো ফুরিয়ে আসছিল, আর তাদের মনে হচ্ছিল, যেন এক অদৃশ্য হাত তাদের চারপাশ থেকে ধীরে ধীরে জালের মতো গুটিয়ে নিচ্ছে। সেই গোপন কুঠুরির হাড়গোড়, আয়নার ফ্যাকাশে প্রতিবিম্ব—সবকিছুই এখন এক ভয়ংকর বাস্তবতার অংশ।

তারা দু’জনে ডায়েরিটা হাতে নিয়ে শোবার ঘরে বসে ছিল। সন্ধ্যা নামতেই চারপাশের নিস্তব্ধতা আরও গাঢ় হয়ে উঠলো। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, আর দূর থেকে ভেসে আসা পেঁচার একটানা শব্দ যেন তাদের বুকের ভেতরটা কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। তারা জানত, আজ রাতটা গত রাতের চেয়েও কঠিন হতে চলেছে। অর্জুন বলল, “রাইমা, আমাদের এখনই এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। এই বাড়িতে থাকাটা আর নিরাপদ নয়।” কিন্তু রাইমার চোখে তখনো এক গভীর জেদ। “না অর্জুন। ঠাকুরদার এই ডায়েরি, এই বাড়ি, সব কিছুর পেছনে একটা কারণ আছে। আমরা যতক্ষণ না এর শেষ দেখতে পাচ্ছি, ততক্ষণ ফিরতে পারব না।”

অগত্যা অর্জুন রাজি হলো। তারা রাতের খাবার খাওয়ার কোনো আগ্রহ পেল না। কেবল একটু জল খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। যদিও ঘুমানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তাদের ছিল না। গত রাতের মতো এই রাতটাও যেন ছিল এক অনন্ত প্রতীক্ষা। রাইমা পাশ ফিরে শুয়ে ছিল, চোখ বন্ধ করে। ডায়েরির পাতাগুলো তার চোখের সামনে ভাসছিল। সেই পরিবারের আর্তনাদ, আগুনের লেলিহান শিখা – সব যেন সে স্পষ্ট শুনতে-দেখতে পাচ্ছিল।

রাত যখন গভীর হলো, ঠিক তখনই ঘটল সেই ভয়াবহ ঘটনা। রাইমা অনুভব করলো, তার গলায় যেন কেউ এক অদৃশ্য হাত দিয়ে চাপ দিচ্ছে! শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তার শরীর যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে গিয়েছিল। সে কোনো শব্দ করতে পারছিল না, কেবল হাত-পা ছুঁড়ছিল। গলার উপর চাপটা ক্রমশ বাড়ছিল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে চাইছে।

রাইমার ছটফটানি দেখে অর্জুন ঘুম থেকে জেগে উঠল। সে দেখলো, রাইমা বিছানায় শুয়ে হাত-পা ছুঁড়ছে, তার মুখ নীল হয়ে আসছে, যেন কেউ তাকে গলা টিপে ধরছে। কিন্তু অর্জুন কাউকে দেখতে পেল না। সে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো, “রাইমা! কী হচ্ছে তোর?” অর্জুন দ্রুত রাইমার দিকে হাত বাড়িয়ে তার গলা থেকে অদৃশ্য চাপটা সরানোর চেষ্টা করল। তার মনে হলো যেন সে এক অদৃশ্য শক্তিকে স্পর্শ করছে, যা বরফের মতো ঠান্ডা। সে সর্বশক্তি দিয়ে রাইমার গলা থেকে সেই চাপ সরাতে চেষ্টা করল।

মুহূর্তের মধ্যে সেই অদৃশ্য চাপটা সরে গেল। রাইমা হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসলো। তার গলা লাল হয়ে গেছে, আর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তার চোখ দুটো ছিল ভয়ে বিস্ফারিত। “অর্জুন… কেউ… কেউ আমার গলা টিপে ধরেছিল!”
অর্জুন তখনও কাঁপছিল। সে রাইমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি দেখেছি, রাইমা। আমি কাউকে দেখিনি, কিন্তু মনে হলো যেন কেউ আছে। আমরা এখান থেকে চলে যাবো কাল সকালে।”

তারা দু’জনে তখনও পুরোপুরি আতঙ্ক থেকে মুক্তি পায়নি। তখনই তাদের নজরে পড়ল, ঘরের দরজায় রক্তের একটি স্পষ্ট দাগ! দরজার সাদা পাল্লার ওপর সেই রক্তের লালচে দাগটা অন্ধকারেও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছিল। রক্তটা তাজা, যেন কিছুক্ষণ আগেই কেউ তার আঙুল দিয়ে এঁকে গেছে। রাইমা ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। এটা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। এটা নিশ্চিত তাদের জন্য এক বার্তা, এক ভয়ংকর ইঙ্গিত।

তারা যখন দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল, ঠিক তখনই জানালার দিক থেকে ভেসে এল এক করুণ কান্নার শব্দ! প্রথমে খুব ক্ষীণ, তারপর ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগলো। কান্নাটা ছিল একটি মেয়ের, বুকফাটা, দীর্ঘশ্বাসযুক্ত। যেন কেউ গভীর যন্ত্রণায় কাঁদছে। সেই কান্না যেন তাদের শরীরের প্রতিটি লোমকূপ খাড়া করে দিল। এই কান্নার শব্দ যেন সেই অদৃশ্য ফ্যাকাশে মেয়েটির, যার মুখ তারা আয়নায় দেখেছিল। সে কি তার দুঃখ প্রকাশ করছে? নাকি তাদের সতর্ক করছে?

রাইমা আর অর্জুন বিছানার এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসল। তাদের মনে হচ্ছিল, যেন এই পুরো বাড়িটাই তাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে। প্রতিটি কোণ থেকে যেন এক অজানা বিপদ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তারা জানত, এই কান্না সেই রায়চৌধুরী পরিবারের, যারা ১৯৪৭ সালের সেই অভিশপ্ত রাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিল। তাদের আত্মারা এই বাড়িতে এখনও বন্দি, আর তারা রাইমা ও অর্জুনের কাছে এক নতুন বার্তা নিয়ে এসেছে।

ডায়েরিতে লেখা “তোমরা পরবর্তী” কথাটার অর্থ তাদের কাছে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো। এই আত্মারা তাদের মুক্তি চায়, আর যদি মুক্তি না পায়, তবে হয়তো তারাই হবে এই বাড়ির পরবর্তী শিকার। রাইমা ঠাকুরদার ডায়েরির কথা ভাবল। এই রহস্যের সমাধান কি সেই ডায়েরিতেই লেখা আছে? নাকি এই আত্মারা তাদের কাছ থেকে অন্য কিছু চায়?

রাতটা যেন শেষ হচ্ছিল না। কান্নার শব্দ কখনও তীব্র হচ্ছিল, কখনও মিলিয়ে যাচ্ছিল। দরজার রক্তের দাগটা যেন তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছিল। রাইমা আর অর্জুন দু’জনেই ভয়ে চোখ বন্ধ করে রইল, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগল, যেন সকালটা দ্রুত আসে। এই রাত ছিল এক জীবন্ত দুঃস্বপ্ন, যা তাদের মনের গভীরে এক স্থায়ী ক্ষত তৈরি করে দিল। তারা জানত, এই বাড়ির প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি কোণে লুকিয়ে আছে এক ভয়ংকর রহস্য, যা তাদের জীবনকে চিরতরে বদলে দিতে চলেছে।

অধ্যায় ৭: ভাঙা কবর

ভোরের আলো ফুটতেই তারা দু’জনেই শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, যেন এক গভীর কুয়াশা থেকে মুক্তি পেল। তাদের চোখগুলো লাল, মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। তারা আর এক মুহূর্তও বাড়ির ভেতরে থাকতে চাইল না। রাইমা প্রস্তাব দিল, “চল, আমরা বাইরে বাগানে যাই। ডায়েরিতে লেখা আছে, দাঙ্গাকারীরা এই পরিবারের সবাইকে বাড়ির ভেতরেই আটকে রেখেছিল। কিন্তু বাইরে কী হয়েছিল?”

অর্জুন অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলো। তার মনে হচ্ছিল, এই বাড়ির প্রতিটি কোণেই এক অজানা বিপদ লুকিয়ে আছে। তারা ধুলো মাখা সদর দরজা ঠেলে বাইরে এলো। সকালের আলোয় বাগানটা কেমন যেন বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। আগাছা আর শুকনো পাতার স্তূপ জমে আছে চারিদিকে। গাছগুলো কেমন যেন অদ্ভুতভাবে বেড়ে উঠেছে, যেন তাদের প্রতিটি ডালে এক চাপা আর্তনাদ লুকিয়ে আছে।

তারা সাবধানে বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। রাইমার মনে পড়ল কালো ডায়েরিতে লেখা ঊর্মিলার কথা। সেই পরিবারের শেষ মুহূর্তের প্রতিটি বর্ণনা তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। তারা বাগানের এক কোণে গিয়ে দেখলো, সেখানে মাটি কিছুটা উঁচু হয়ে আছে, আর তার ওপর কিছু ভাঙা পাথরের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রাইমা থমকে দাঁড়াল। তার মনে হলো, এটাই হয়তো সেই জায়গা, যার কথা ডায়েরিতে অস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল।

অর্জুন বলল, “এখানে কি কিছু কবর দেওয়া হয়েছিল?” রাইমার চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “হয়তো! চল খুঁড়ে দেখি।” তাদের কাছে কোনো কোদাল ছিল না, তাই তারা ভাঙা গাছের ডাল আর পাথর দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করলো। মাটি নরম ছিল, আর দ্রুতই তারা কিছুটা গভীরে পৌঁছাতে পারল। কিছুক্ষণ খোঁড়ার পরই তাদের হাতের লাঠিতে কিছু একটা শক্ত জিনিসের আভাস পাওয়া গেল।

তারা আরও উত্তেজিত হয়ে মাটি সরাতে লাগল, আর তখনই তাদের চোখের সামনে বেরিয়ে এলো এক ভয়াবহ দৃশ্য। মাটির নিচে দেখা গেল একটি ভাঙা কবর! কবরটি ছিল মাটির তৈরি, আর তার ভেতরে দেখা যাচ্ছিল মানুষের হাড়গোড়! করোটি, পাঁজরের খাঁচা, আর অন্যান্য হাড়গুলো মাটি আর ধুলোয় মিশে গেছে। রাইমা আর অর্জুন দু’জনেই ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। এই কবরটি নিশ্চয়ই রায়চৌধুরী পরিবারের সদস্যদের। কিন্তু তারা তো বাড়ির ভেতরে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন, তবে এখানে কী করে তাদের দেহাবশেষ এলো?

তারা আরও মনোযোগ দিয়ে দেখল। হাড়গোড়গুলোর পাশে, মাটির মধ্যে চাপা পড়ে ছিল একটি বস্তু। রাইমা সাবধানে সেটি তুলে নিল। আলোয় তুলে ধরতেই সেটি চকচক করে উঠলো। এটি ছিল একটি নেকলেস! পুরনো রূপোর তৈরি, তাতে খোদাই করা ছিল একটি গোলাপের নকশা। নেকলেসটি দেখে রাইমার চোখ কপালে উঠলো। এই নেকলেসটি সে যেন কোথাও দেখেছে!

রাইমা নিজের শার্টের কলার সরিয়ে নিজের গলার দিকে তাকাল। তার গলার চেনটি, যা তার ঠাকুরদা তাকে উপহার দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে এই নেকলেসটির নকশার হুবহু মিল! পার্থক্য শুধু এই, রাইমার চেনটি ছিল সোনার তৈরি, আর এটি রূপোর। রাইমার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। তার মনে এক অদ্ভুত উপলব্ধি জন্ম নিল। এই নেকলেসটি তার গলার নেকলেসের মতোই!

মুহূর্তের মধ্যে রাইমার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। যেন এক বিদ্যুৎ তরঙ্গ তার শরীর দিয়ে বয়ে গেল। গত রাতের ফিসফিসানি, আয়নার ফ্যাকাশে মুখ —সবকিছু যেন এক নতুন অর্থ পাচ্ছিল। আর এই নেকলেস… এই গোলাপের নকশা…

ঠিক তখনই রাইমা বুঝতে পারল, ভূতটা আসলে তারই পূর্বজন্মের সত্তা! এই নেকলেসটি ছিল ঊর্মিলার, সেই জমিদার কন্যার, যার করুণ পরিণতি ঘটেছিল ১৯৪৭ সালে। যে পরিবারকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, সেই পরিবারেরই একজন ছিল ঊর্মিলা। আর রাইমা, এই জীবনে, তারই আত্মার প্রতিচ্ছবি! ঠাকুরদা কি তবে এই কারণেই তাকে এই বাড়িতে এনেছিলেন? এই রহস্যের জট খোলার জন্য, নাকি তার পূর্বজন্মের সেই অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য?

রাইমার মাথায় যেন হাজারো প্রশ্ন ভিড় করলো। তার বিজ্ঞানমনস্কতা, তার যুক্তিবাদ – সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। এই বাড়ির প্রতিটি রহস্য যেন তার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। সে আর অর্জুন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। তাদের মনে হলো, এই বাগানের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পাথর যেন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, তাদের পূর্বজন্মের গল্পটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

এইবার তারা বুঝতে পারল, কেন সেই আত্মারা তাদের মুক্তি চেয়েছিল। কেন তারা “তোমরা পরবর্তী” বলেছিল। তারা এসেছিল, তাদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে, তাদের মুক্তি দিতে। রাইমা জানত, এই নেকলেসটি হয়তো সেই মুক্তির চাবিকাঠি। তার মনে তখন আর ভয় ছিল না, ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, এক অজানা আকাঙ্ক্ষা। সে জানত, এইবার তাকে সেই ‘ভুল’ শোধ করতেই হবে, যা ১৯৪৭ সালে সংঘটিত হয়েছিল। সে তার পূর্বজন্মের সত্তার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল, আর এইবার সে প্রস্তুত ছিল সেই আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য।

অধ্যায় ৮: প্রেতাত্মার মুক্তি

ভাঙা কবরে পাওয়া নেকলেসটি দেখে রাইমার সমস্ত সত্তা যেন এক নতুন উপলব্ধিতে ভরে গিয়েছিল। সে বুঝতে পারছিল, আয়নার ফ্যাকাশে মুখ, ডায়েরির অস্পষ্ট ইঙ্গিত, আর গত রাতের অদৃশ্য হাতের আক্রমণ – সবকিছুর মূলেই ছিল তার পূর্বজন্মের সত্তা, ঊর্মিলার আত্মা, যার মুক্তির জন্য এই বাড়িটি বহু বছর ধরে অপেক্ষা করছিল। অর্জুন রাইমার এই আকস্মিক আবিষ্কারে প্রথমে হতবাক হয়ে গেলেও, তার বন্ধুর চোখে যে অদম্য দৃঢ়তা দেখেছিল, তাতে সেও এই অলৌকিক সত্যকে মেনে নিতে বাধ্য হলো।
“তাহলে এখন কী করবি?” অর্জুন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।

রাইমা হাতে থাকা কালো ডায়েরিটির দিকে তাকাল। তার মনে পড়ল, ঊর্মিলা এই ডায়েরির শেষ পাতায় কিছু অস্পষ্ট নির্দেশ লিখেছিল। “ডায়েরিতে হয়তো মুক্তির পথ লেখা আছে। আমাদের সেই পথ অনুসরণ করতে হবে।”

তারা দু’জনে মিলে ডায়েরির শেষ কয়েকটি পাতা উল্টালো। সেই রক্তে লেখা বাক্যটির নিচে অস্পষ্ট কালিতে কিছু সাংকেতিক চিহ্ন আর কিছু শব্দ লেখা ছিল। রাইমা মনোযোগ দিয়ে চিহ্নগুলো বোঝার চেষ্টা করল। লেখা ছিল: “যখন আমার স্মৃতির সাথে আমার অলংকার একত্রিত হবে, আর আলো নিভে যাবে, তখনই আমার আত্মা মুক্তি পাবে।” আর তার নিচে একটি ছোট ছবি আঁকা ছিল, একটি ভাঙা কবরের পাশে মোমবাতি জ্বলছে।

রাইমা অর্জুনের দিকে তাকাল। “মনে হচ্ছে, আমাদের এই নেকলেসটা কবরে রাখতে হবে এবং মোমবাতি জ্বালাতে হবে।”

অর্জুন বলল, “কিন্তু মোমবাতি কোথায় পাবো?” রাইমা মনে মনে ঠাকুরদার ডায়েরির কথা ভাবল। ঠাকুরদা নিশ্চয়ই কোনো ইঙ্গিত রেখে গেছেন। দ্রুত তারা বাড়ির ভেতরে ফিরে গেল, ঠাকুরদার পুরনো ট্রাঙ্কটা খুলে দেখল। আশ্চর্যভাবে, ট্রাঙ্কের এক কোণে একটি পুরনো মোমবাতি আর দেশলাই পেল তারা।

দিন ফুরিয়ে আসছিল। আকাশের রঙ ধূসর হয়ে উঠেছে, আর বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে এক অদ্ভুত শান্তিতে। রাইমা আর অর্জুন মোমবাতি আর নেকলেস নিয়ে আবার বাগানের সেই ভাঙা কবরের কাছে ফিরে এলো। তাদের মনে তখন আর ভয় ছিল না, ছিল এক ধরণের পবিত্রতা, এক অশুভ শক্তিকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা।

রাইমা সাবধানে ভাঙা কবরের ভেতরে নেকলেসটি রাখল, ঠিক যেমনটি ডায়েরিতে ইঙ্গিত দেওয়া ছিল। তারপর সে মোমবাতিটি জ্বালিয়ে কবরের পাশে রাখল। নিভে আসা আলোয় মোমবাতির শিখাটা কাঁপছিল, এক অদ্ভুত নীরবতা যেন চারদিক গ্রাস করেছিল। রাইমা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ নীরব প্রার্থনা করল, যেন ঊর্মিলার আত্মা মুক্তি পায়।

তারা দু’জনেই এক মনে অপেক্ষা করছিল। মিনিট কয়েক পর, হঠাৎ করেই আকাশে এক তীব্র ঝড় উঠলো! কোথা থেকে যেন কালো মেঘ এসে সূর্যকে ঢেকে দিল। বাতাসের গতি ক্রমশ বাড়ছিল, গাছপালাগুলো যেন পাগলের মতো দুলছিল। বিকট শব্দে বাজ পড়ছিল, আর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। তাদের মনে হলো, যেন প্রকৃতিও এই প্রাচীন অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য অপেক্ষা করছিল। ঝোড়ো বাতাস মোমবাতির শিখাটাকে নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল, কিন্তু আশ্চর্যভাবে শিখাটা দুলতে দুলতে জ্বলতে থাকল। তাদের মাথার ওপর থেকে শুকনো পাতা আর ভাঙা ডালপালা উড়ে যাচ্ছিল।

ঝড়টা যত তীব্র হচ্ছিল, তাদের মনে হচ্ছিল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি লড়াই করছে। বাতাসের সঙ্গে মিশে এক ধরণের অব্যক্ত আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল, যা ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছিল। তারা চোখ বন্ধ করে সেই তীব্র ঝড় আর আলোর ঝলকানি সহ্য করছিল।

প্রায় দশ মিনিট ধরে ঝড় চলল, তারপর হঠাৎ করেই সব শান্ত হয়ে গেল। মেঘগুলো সরে গেল, আকাশ আবার নীল হয়ে উঠলো, আর সূর্যের আলোয় চারদিক ঝলমল করে উঠলো। বাতাস একদম স্থির, যেন কোথাও কোনো ঝড়ের চিহ্ন নেই। মোমবাতির শিখাটা তখনও জ্বলছিল, শান্তভাবে। রাইমা আর অর্জুন একে অপরের দিকে তাকাল। তাদের চোখে এক ধরণের বিস্ময় আর স্বস্তি। মনে হলো, যেন বহু বছর ধরে জমে থাকা এক চাপা বোঝা তাদের বুক থেকে নেমে গেছে।

রাইমা সাবধানে মোমবাতিটি নিভিয়ে দিল। তারা বুঝতে পারছিল, ঊর্মিলার আত্মা মুক্তি পেয়েছে। সেই পরিবারের উপর যে অবিচার হয়েছিল, তার সমাপ্তি ঘটেছে। তাদের মনে হলো, এই বাড়ির প্রতিটি ইট, প্রতিটি পাথরের ভেতর থেকে যেন এক ধরণের শান্তি আর নীরবতা ছড়িয়ে পড়ছে। তারা আর এক মুহূর্তও সেখানে থাকতে চাইল না। এইবার তাদের কাজ শেষ হয়েছে।

তারা ধীর পায়ে বাড়ির গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। তাদের মন শান্ত, কিন্তু ভেতরে এক গভীর উপলব্ধি। এই অভিজ্ঞতা তাদের জীবনকে চিরতরে বদলে দিয়েছে। তারা আর আগের মতো যুক্তিবাদী ছিল না, তারা অলৌকিকতার এক চরম সত্যের মুখোমুখি হয়েছিল। গেটের কাছে এসে তারা যখন গেট খোলার জন্য হাত বাড়াল, ঠিক তখনই তাদের পেছনে থেকে, একদম কাছ থেকে, একটি ফিসফিসে কন্ঠস্বর ভেসে এল। সেই কন্ঠস্বর ছিল শান্ত, স্নিগ্ধ, আর মিষ্টি।

সেই কন্ঠস্বর যেন তাদের কানেই বলল: “ধন্যবাদ…”

রাইমা আর অর্জুন দু’জনেই চমকে উঠলো। তারা মুহূর্তের জন্য পিছন ফিরে তাকাল, কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। কেবল শান্ত, নীরব বাগান আর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পুরনো বাড়ি, যার জানালাগুলো এখন আর মৃত চোখের মতো লাগছিল না, বরং এক ধরণের শান্তি নিয়ে তাকিয়ে ছিল। তারা আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে গেট খুলে দ্রুত সেই গ্রাম থেকে বেরিয়ে এলো। তাদের মনে এক নতুন ভোরের আশ্বাস ছিল, কিন্তু সেই “ধন্যবাদ” শব্দটা যেন তাদের মনের গভীরে চিরদিনের জন্য গেঁথে গেল। তারা জানত, এই অভিজ্ঞতা তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে, এক অলৌকিক সত্যের সাক্ষী হিসেবে।

শেষ

ছবি এআই

© পিনাকী রঞ্জন পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *