ভৌতিক গল্প : তামসা কুণ্ডের অভিশাপ


পিনাকী রঞ্জন পাল

অধ্যায় ১: স্মৃতিহীন আগমন

সেদিন কলকাতার বাতাস ছিল অস্বাভাবিক ভারী, যেন এক অদৃশ্য চাপ সবকিছুকে গ্রাস করে রেখেছে। সকাল থেকে শহরের আনাচে-কানাচে থেকে উঠে আসা ধুলো আর ঘামের তীব্র গন্ধে বাতাস ছিল বিষাক্ত। ক্যালেন্ডারের পাতায় জ্যৈষ্ঠ মাস, আর সূর্যালোকের প্রতিটি কণা যেন আগুন ঢেলে দিচ্ছিল শহরের বুকে। হাওড়া স্টেশনের গমগমে প্ল্যাটফর্মে সোমের শরীর থেকে ঘাম ঝরছিল অবিরাম। ট্রেন থেকে নামার মুহূর্তে তার মনে হলো যেন এক বিশাল চুল্লির ভেতর থেকে সে বেরিয়ে এসেছে। চারপাশে অজস্র মানুষের ভিড়, কুলিদের হাঁকডাক, আর হকারের চিৎকারে কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়, কিন্তু এই সমস্ত কোলাহল ছাপিয়েও তার কানে একটা অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে এল—একটা মেয়ের গলা, যেন কেউ কাঁদছে, আবার যেন কেউ তাকে ডাকছে। শব্দটা এতটাই অস্পষ্ট ছিল যে সোম প্রথমে ভেবেছিল তার মনের ভুল, ক্লান্তির কারণে শ্রুতিভ্রম হচ্ছে। কিন্তু আওয়াজটা মিলিয়ে গেল না, বরং তার মস্তিষ্কের গভীরে এক অস্থির সুরের মতো বাজতে লাগল।

সোম চারপাশে তাকাল, কিন্তু ভিড়ের মধ্যে কোনো মেয়েকে দেখতে পেল না, যার কান্নার শব্দ এমন তীব্র হতে পারে। তার মাথায় তখন হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, কিন্তু কোনো প্রশ্নেরই উত্তর তার জানা ছিল না। কারণ, সে নিজেকেই চিনতে পারছিল না। কে সে? কোথা থেকে এসেছে? কেন এসেছে এই অচেনা শহরে? তার স্মৃতি যেন এক বিশাল শূন্য গহ্বরে হারিয়ে গেছে। সে মনে করার চেষ্টা করছিল শেষ কী মনে আছে। কেবল অস্পষ্ট কিছু ছায়া, কিছু ভাঙা ছবি… তারপর সব অন্ধকার।

সে প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকালো, কোনো পরিচিত বস্তু খুঁজে পাওয়ার আশায়। একটা পুরনো মানিব্যাগ পেল, তার ভেতর কিছু টাকা আর একটি আইডি কার্ড। আইডি কার্ডে শুধু তার নাম লেখা: সোম চ্যাটার্জী। আর কোনো তথ্য নেই। ঠিকানা নেই, পেশা নেই, এমনকি তার ছবিটিও কেমন যেন অস্পষ্ট। এর আগে সে কোথায় ছিল, কিছুই মনে পড়ছে না। তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়! তার মাথার ভেতরে যেন এক হিমশীতল শূন্যতা।

তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা নেড়ে দেখল সে। পোশাক, একটি জলের বোতল, আর কিছু ছোটখাটো ব্যক্তিগত সামগ্রী। কিন্তু তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা খুঁজে পেল না—তার কাছে থাকা লাল চামড়ার সেই ডায়েরিটা খোয়া গেছে! একটা ঝাপসা স্মৃতি তার মনে ভেসে উঠল—লাল চামড়ার একটি ডায়েরি, যার প্রতিটি পাতায় হয়তো তার জীবনের গল্প লেখা ছিল। ডায়েরিটা খোয়া যাওয়ায় তার শেষ ভরসাও যেন হারিয়ে গেল। এই অপরিচিত শহরে সে একা, স্মৃতির এক টুকরো চিহ্নও নেই তার কাছে, কেবল এক গভীর শূন্যতা আর সেই অদৃশ্য মেয়ের করুণ ডাক।

সোম প্ল্যাটফর্মের একটা বেঞ্চে বসে পড়ল। তার মাথার ভেতরে তখন যেন এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এই শূন্যতা, এই বিস্মৃতি, এই অস্পষ্ট ডাক—সবকিছুই তাকে এক গভীর রহস্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। তার মনে হলো, যেন সে এক বিশাল নাটকের মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছে, যার স্ক্রিপ্ট সে জানে না, এমনকি জানে না তার চরিত্র কী।

চারপাশে মানুষের অবিরাম আনাগোনা, তাদের হাসির শব্দ, তাদের জীবনযাপন—সবকিছুই সোমের কাছে কেমন যেন অচেনা, দূরবর্তী মনে হচ্ছিল। সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করছিল। তার মনে হলো, সে যেন এই বিশ্বের অংশ নয়। হঠাৎ তার মনে এক অদ্ভুত চিন্তা এলো। এই যে স্মৃতির শূন্যতা, এই যে অদ্ভুত ডাক, এর পেছনে কি কোনো উদ্দেশ্য আছে? সে কি কোনো এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পড়ে আছে, যা তাকে কোনো এক নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে?

সূর্যের তীব্র আলো প্ল্যাটফর্মের উপর এসে পড়ছিল। সোমের শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছিল, কিন্তু তার ভেতরের শীতলতা কাটছিল না। সে বুঝতে পারছিল, এই হাওড়া স্টেশন তার গন্তব্য নয়, এটা কেবলই এক যাত্রাপথ, এক রহস্যের শুরু।

অধ্যায় ২: পুরাতন কুন্ড ও তার গোপন কথা

হাওড়া স্টেশনের সেই অস্বাভাবিক তাপ আর স্মৃতির শূন্যতা নিয়ে সোম নিজেকে কলকাতার কোলাহলে ভাসিয়ে দিতে পারল না। তার ভেতরে সেই অচেনা মেয়ের ডাক আর হারানো ডায়েরির অস্পষ্ট স্মৃতি তাকে এক অস্থিরতা দিচ্ছিল। ট্যাক্সিতে বসে সে শুধু বারবার ভাবছিল, কেন সে এখানে? কে সে? ঠিক তখনই তার মনে এক অদম্য টান অনুভব হলো। যেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে কলকাতার বাইরে, আরও গভীরে, আরও নিভৃতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তার মানিব্যাগের আইডি কার্ডে নাম ছাড়া আর কোনো তথ্য না থাকলেও, পকেটে থাকা কিছু টাকা তাকে অন্তত গন্তব্যে পৌঁছানোর সুযোগ দিচ্ছিল।

সে একটি মানচিত্র জোগাড় করল, অদ্ভুতভাবে তার মনে হচ্ছিল, যেন এক বিশেষ স্থানে তাকে যেতেই হবে। মানচিত্রে সে দেখল, একটি ছোট গ্রাম, নাম তামসা, বীরভূম জেলায়। কেন তামসা? এই নামটা তার কাছে পরিচিত লাগছিল না, কিন্তু তার অবচেতন মন যেন তাকে সেই দিকেই ঠেলে দিচ্ছিল। এক অচেনা টানে সে কলকাতা থেকে গাড়ি ভাড়া করে বীরভূমের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। কলকাতার জনারণ্য পেরিয়ে, ধুলো মাখা হাইওয়ে ধরে যখন গাড়ি ছুটে চলছিল, তখন তার মন ধীরে ধীরে আরও বেশি অস্থির হয়ে উঠছিল।

কয়েক ঘণ্টা পর, গাড়ি এসে পৌঁছাল এক নিঝুম, ছোট্ট গ্রামে – তামসা। গ্রামটি ছিল সবুজে ঘেরা, কিন্তু তার মধ্যে এক ধরণের বিষণ্ণতা মিশে ছিল। পুরনো মাটির ঘর, সরু পথ, আর দূরে কিছু শ্মশানকালীর মন্দির। গ্রামের মানুষের চোখে কেমন যেন এক চাপা ভয় আর কুসংস্কারের ছাপ। সোম গাড়ি থেকে নেমে দেখল, গ্রামের প্রায় সব মানুষ তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে, যেন সে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত আগন্তুক। এই দৃষ্টিতে এক ধরণের মিশ্র অনুভূতি ছিল – কৌতূহল, সন্দেহ, আর এক ঝলক ভয়।

গ্রামের কেন্দ্রে একটি বিশাল, পুরনো পুকুর, বা কুন্ড। পুকুরের জল গভীর সবুজ, তার চারপাশ লতাপাতায় ঢাকা। পুরনো পাথরের সিঁড়িগুলো জলের গভীরে নেমে গেছে, আর তার চারপাশে অযত্নে বেড়ে ওঠা কিছু বটগাছ। এটাই যে তামসা কুন্ড, তা তার বুঝতে অসুবিধা হলো না। কুন্ডের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সোমের মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। যেন কুন্ডের জল তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে, তাকে কোনো এক প্রাচীন রহস্যের কথা ফিসফিস করে বলতে চাইছে।

স্থানীয় লোকেরা কুন্ডের ধারেকাছেও ঘেঁষছিল না। সোম দেখল, কয়েকটি শিশু যারা কুন্ডের কাছে খেলছিল, তারা তাকে দেখতেই ভয়ে দৌড়ে পালাল। সোমের কৌতূহল বাড়ছিল। সে একজন বৃদ্ধের কাছে গেল, যিনি গ্রামের একমাত্র চায়ের দোকানে বসে বিড়ি টানছিলেন। বৃদ্ধের মুখে অসংখ্য বলিরেখা, কিন্তু চোখ দুটো ছিল তীক্ষ্ণ।

সোম জিজ্ঞেস করল, “এটা কি তামসা কুন্ড?”

বৃদ্ধ সোমের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বিড়িটা নামিয়ে রাখলেন। তার মুখে এক ধরণের হাসি ফুটে উঠল, কিন্তু সেই হাসিটা যেন শীতল। “হ্যাঁ বাবু, এটাই তামসা কুন্ড। কেন জানতে চান?”

“এই কুন্ড নিয়ে কি কোনো গল্প আছে?” সোম জানতে চাইল।

বৃদ্ধ নিচু স্বরে বলতে লাগলেন, “গল্প নয় বাবু, এটা সত্য। এই কুন্ড অভিশপ্ত। গ্রামের কেউ এর কাছে যায় না। বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে কুন্ডের জল লাল হয়ে ওঠে, রক্তবর্ণ ধারণ করে। আর সেই রাতে, জলের তলায় থেকে কে যেন কিছু টানে, মানুষকে টানে… যারা বেশি সাহস দেখায়, তারা আর ফেরে না।” বৃদ্ধের চোখে তখন এক ধরণের ঘোর।

সোম বিস্মিত হলো। তার বিজ্ঞানমনস্ক মন এসব কুসংস্কার মানতে চাইছিল না, কিন্তু তার ভেতরের এক অদ্ভুত টান তাকে এসব কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য করছিল। সে অনুভব করছিল, এই কুন্ডের সঙ্গে তার স্মৃতির গভীর সম্পর্ক আছে। সেই হারিয়ে যাওয়া ডায়েরি, সেই অচেনা মেয়ের ডাক – সবকিছুর সূত্রপাত যেন এই তামসা কুন্ডেই।

বৃদ্ধ সোমের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। তার চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “তুমি এখানে পা রাখার পর থেকে কুন্ড ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে… এটার অপেক্ষা ছিল বহু বছর ধরে।”

কথাগুলো শুনে সোমের শরীর দিয়ে এক হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। তার মনে হলো, বৃদ্ধ তার সম্পর্কে এমন কিছু জানেন, যা সে নিজেও জানে না। “অপেক্ষা? কিসের অপেক্ষা?” সোম জিজ্ঞেস করল।

বৃদ্ধ হাসলেন, সেই শীতল হাসি। “সে সব সময় এলে জানতে পারবে। এই কুন্ড সাধারণ নয়, বাবু। এর গভীরে অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে। এমন রহস্য, যা কেবল কিছু বিশেষ মানুষই জানে।”

সোম আর কোনো প্রশ্ন করতে পারল না। তার মনে হলো, সে যেন এক বিশাল ধাঁধার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, যার প্রতিটি টুকরোই অগোছালো। বৃদ্ধের কথা, গ্রামের মানুষের ভয়, কুন্ডের সেই অদ্ভুত নীরবতা – সব কিছুই তাকে এক অজানা রহস্যের গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল, তার স্মৃতি হারানোর পেছনে, আর এই তামসা কুন্ডে তার আগমন – এর পেছনে কোনো গভীর সংযোগ আছে, যা হয়তো তার পূর্বজন্মের কোনো অভিশাপ বা অসম্পূর্ণ কাজ। এই গ্রাম, এই কুন্ড, আর সেই বৃদ্ধ – সবকিছুই যেন তাকে কোনো এক প্রাচীন, অভিশপ্ত ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছিল। রাত নামছিল, আর কুন্ডের জল অন্ধকারে আরও রহস্যময় দেখাচ্ছিল। সোম জানত না, এই কুন্ডের গভীরতা কতটুকু, আর এর ভেতর থেকে কী ভয়াবহ সত্য তার জন্য অপেক্ষা করছে।

অধ্যায় ৩: লুকোনো শাস্ত্র ও অস্পষ্ট চরিত্র

পরের দিন সারাদিন ধরে সোম গ্রামের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াল, তার স্মৃতি ফিরে পাওয়ার এক অদম্য চেষ্টায়। কিন্তু কিছুতেই সে মনে করতে পারছিল না তার অতীত। দুপুরের পর সে গ্রামের এক নির্জন প্রান্তে পৌঁছাল, যেখানে কিছু পুরনো, ভাঙাচোরা ইটের স্তূপ দেখা যাচ্ছিল। কাছে গিয়ে সে দেখল, এটি এক ধ্বংসপ্রায় মন্দির। লতাপাতায় ঢাকা, তার দেয়ালগুলো খসে পড়ছে, আর ভেতরের অন্ধকার যেন রহস্যে ঘেরা। মন্দিরটি দেখে মনে হলো, বহু বছর ধরে এটি পরিত্যক্ত।

সোমের মনে এক অদ্ভুত টান অনুভব হলো। যেন কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে এই মন্দিরের দিকে আকর্ষণ করছিল। সে সাবধানে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করল। ধুলো আর মাকড়সার জালে ঢাকা ছিল চারপাশ। ভেতরে অসংখ্য ভাঙা মূর্তি আর পুরনো দিনের পূজার উপকরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। টর্চের আলো জ্বেলে সে মন্দিরের প্রতিটি কোণ খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তার মনে হলো, এখানে এমন কিছু আছে, যা তাকে তার উদ্দেশ্য জানতে সাহায্য করবে।

মন্দিরের এক অন্ধকার কোণে, ভাঙা পাথরের নিচে চাপা পড়ে ছিল একটি বস্তু। সোম সাবধানে পাথরগুলো সরাল, আর তার হাতে উঠে এল একটি পুরাতন পুঁথি। পুঁথিটি ছিল তালপাতার তৈরি, বহু পুরনো, আর তার অক্ষরগুলো ছিল সংস্কৃত হরফের, হাতে লেখা। ধুলো ঝেড়ে সে পুঁথিটি খুলল। প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা ছিল তার নাম: “তামসা তন্ত্র”।

সোম বিস্ময়ের সঙ্গে পুঁথিটি পড়তে শুরু করল। যদিও সংস্কৃত তার পক্ষে পড়া কঠিন ছিল, কিন্তু কিছু চিত্র এবং সাংকেতিক চিহ্ন তাকে অর্থ বুঝতে সাহায্য করছিল। পুঁথিতে লেখা ছিল, এই তামসা কুন্ড এক প্রাচীন কুলদেবীর আশীর্বাদে তৈরি। দেবী ছিলেন গ্রামের রক্ষাকর্ত্রী। তাঁর দৈবশক্তি এতটাই প্রবল ছিল যে তিনি অশুভ আত্মাদের কুন্ডের অতল গভীরে বদ্ধ করে রাখতেন। কুন্ডের জল ছিল পবিত্র, আর তা গ্রামকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করত।

কিন্তু তারপরই পুঁথিতে লেখা ছিল এক ঘোরতর অভিশাপের কথা। বহু বছর আগে, গ্রামেরই এক প্রভাবশালী তান্ত্রিক, ক্ষমতার লোভে এক মন্দ কৃত্য সম্পন্ন করার চেষ্টা করে। সে কুন্ডের দেবীর শক্তিকে নিজের বশে আনতে চেয়েছিল। সেই আচারের ফলস্বরূপ, দেবীর আশীর্বাদ অভিশাপে পরিণত হয়। কুন্ডের জল ধীরে ধীরে বিষাক্ত হয়ে ওঠে, আর অশুভ আত্মারা দেবীর বাঁধন থেকে আংশিকভাবে মুক্তি পায়। কুন্ড পরিণত হয় এক অভিশপ্ত জলাশয়ে, যেখানে আত্মারা মুক্তির জন্য ছটফট করে, আর যখনই তারা শক্তি পায়, তখনই তারা নতুন প্রাণের সন্ধানে কুন্ডের জলকে লাল করে তোলে। পুঁথিতে আরও লেখা ছিল, এই অভিশাপ কেবল তান্ত্রিকের বংশধর দ্বারাই শেষ হতে পারে, যদি সে সঠিক কৃত্য সম্পন্ন করে।

পুঁথিটা পড়তে পড়তে সোমের বুক ধুকপুক করছিল। তার মনে হলো, যেন তার স্মৃতির হারিয়ে যাওয়া টুকরোগুলো এক এক করে জোড়া লাগছে। তান্ত্রিক? অভিশাপ? মুক্তি? এই সবকিছুর সঙ্গেই কি তার কোনো সম্পর্ক আছে? সে কি সেই তান্ত্রিকের বংশধর?

সে পুঁথিটি হাতে নিয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এল। তখন বিকেল গড়িয়েছে, সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে, আর তার লালচে আলো তামসা কুন্ডের ওপর এসে পড়েছে। সোম পুঁথির কথাগুলো নিয়ে ভাবছিল, আর হাঁটতে হাঁটতে আবার কুন্ডের ধারে চলে এল। তার মন তখন হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত। হঠাৎ তার চোখ পড়ল কুন্ডের জলের দিকে।

আর তখনই সোম দেখতে পেল, কুন্ডের ধারে এক অচেনা যুবতী দাঁড়িয়ে আছে! সে এতক্ষণ তাকে দেখতে পায়নি, যেন সে হঠাৎ করেই আবির্ভূত হয়েছে। মেয়েটি ছিল শুভ্র শাড়িতে আবৃত, তার চুল ভেজা, আর তা থেকে জল ঝরে পড়ছিল। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল, জলের দিকে তাকিয়ে। তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু তার ভঙ্গিতে ছিল এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা।

সোম থমকে দাঁড়াল। কে এই মেয়েটি? সে কি গ্রামের কেউ? কিন্তু গ্রামের মানুষ তো কুন্ডের ধারে আসে না। তার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর লাগল মেয়েটির চোখ। যখন মেয়েটি ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে সোমের দিকে তাকাল, তখন সোমের সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। মেয়েটির চোখে ছিল এক ভয়ানক শূন্যতা, যেন তাতে কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। তার চোখগুলো ছিল গভীর কালো, আর তাতে কোনো আবেগ ছিল না। সে এমনভাবে সোমের দিকে তাকিয়েছিল, যেন তাকে চিনতে পেরেছে, বহু বছর ধরে তার জন্যই অপেক্ষা করছিল।

সোমের মনে পড়ল সেই মেয়ের গলার আওয়াজের কথা, যা সে হাওড়া স্টেশনে শুনেছিল। এই কি সেই মেয়ে? এই কি সেই আত্মা, যে কুন্ডে বন্দি? তার মনে হল, যেন সে এক অজানা খেলার অংশ হয়ে গেছে, যার নিয়মকানুন সে জানে না। পুঁথি, কুন্ড, আর এই রহস্যময়ী যুবতী—সবকিছুই তাকে এক গভীর, অন্ধকার সত্যের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। সে জানত না, এই মেয়েটি তার কাছ থেকে কী চায়, আর এই অভিশাপের শেষ কোথায়। সে শুধু অনুভব করছিল, তার স্মৃতি হারানোর পেছনে, আর এই তামসা কুন্ডে তার আসার পেছনে এক গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে, যা এবার প্রকাশিত হতে চলেছে।

অধ্যায় ৪: নিশিযাত্রা ও মৃত্যুর হাতছানি

সন্ধ্যা নামতেই গ্রামের প্রতিটি বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষেরা তাদের দৈনন্দিন কাজ সেরে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল, যেন এক অদৃশ্য ভয়ে তারা সকলে সন্ত্রস্ত। আকাশে চাঁদ ধীরে ধীরে পূর্ণতা পাচ্ছিল। সেই রাতটা ছিল পূর্ণিমা। চারিদিকে এক অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা আর রহস্যময় শান্তি বিরাজ করছিল। পূর্ণিমার আলোয় তামসা কুন্ডের জল কেমন যেন অস্বচ্ছ দেখাচ্ছিল, যেন তার ভেতরে এক গভীরে রহস্য লুকিয়ে আছে।

সোম সেই ভাঙাচোরা মন্দিরের কাছেই একটা নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিল। সে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার মস্তিষ্ক বিশ্রাম নিতে পারছিল না। বারবার সেই ফ্যাকাশে মেয়ের শূন্য চোখগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ঠিক মধ্যরাতে, যখন পূর্ণিমার চাঁদ মধ্যগগনে, সোম অনুভব করল তার শরীর আর মন যেন তার নিয়ন্ত্রণে নেই। এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে টেনে তুলছিল, তাকে বাইরে যাওয়ার জন্য বাধ্য করছিল। সে চেষ্টা করল তার শরীরকে প্রতিরোধ করতে, কিন্তু পারল না। যেন তার ভেতরের কোনো এক সত্তা তাকে পরিচালিত করছিল।

এক অদম্য টানে সে উঠে দাঁড়াল এবং হাঁটতে শুরু করল। তার পা যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রামের সেই কুন্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তার চারপাশে সবকিছু যেন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, কেবল চাঁদের আলোয় গাছের ছায়াগুলো অদ্ভুতভাবে দুলছিল। বাতাস কেমন যেন ভারী লাগছিল, আর দূরে শেয়ালের ডাক তার মনে এক অজানা আতঙ্ক তৈরি করছিল। সোম হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল কুন্ডের পাশে। পূর্ণিমার আলোয় কুন্ডের জল আরও রহস্যময় দেখাচ্ছিল, তার পৃষ্ঠে যেন অসংখ্য নক্ষত্র খেলা করছিল।

সোম জলের ধারে দাঁড়াল। তার শ্বাস দ্রুত হচ্ছিল। সে জলের দিকে তাকিয়ে রইল, আর তার মনে হলো, জলের গভীরে যেন কিছু একটা নড়াচড়া করছে। ধীরে ধীরে জলের নিচের অন্ধকার থেকে দুটি উজ্জ্বল বিন্দু উপরের দিকে উঠে এল। সোম ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। সে স্পষ্ট দেখতে পেল, জলের মধ্যে একজোড়া চোখ! চোখগুলো যেন গভীর অন্ধকার থেকে তাকে দেখছিল, তাতে ছিল এক ধরণের আকর্ষণ, এক ধরণের করুণা। সেই চোখগুলো ছিল সেই ফ্যাকাশে মেয়ের, যাকে সে মন্দিরের পাশে দেখেছিল।
ঠিক তখনই, তার পেছন থেকে এক নরম, কিন্তু হিমশীতল গলার স্বর ভেসে এল:”তুমি ফিরে এসেছ, সোম… এবার আমাদের পূর্ণতা দিতে হবে।”

সোম চমকে উঠলো। সে দ্রুত পিছন ফিরে তাকাল। কুন্ডের ধারে, চাঁদের আলোয়, সেই অচেনা যুবতী দাঁড়িয়ে আছে! তার চুল ভেজা, শুভ্র শাড়িতে সে যেন এক অশরীরী অপ্সরী। তার চোখ দুটি সেই শূন্যতা নিয়ে সোমের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু এইবার তার মুখে এক অস্পষ্ট হাসি দেখা গেল, যা সোমের মনে এক নতুন ভয় আর অস্থিরতা তৈরি করল।

“কে তুমি?” সোম ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছিল না।

মেয়েটি ধীরে ধীরে সোমের দিকে এগিয়ে এল। তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন বাতাসে ভেসে আসছিল। তার কণ্ঠস্বর আবারও শোনা গেল, যেন বহুদিনের পুরনো স্মৃতি থেকে উঠে আসছে: “আমি মাধবী। তুমি ভুলে গেছ? আমরা একসঙ্গে ছিলাম। আমরা একসঙ্গে কুন্ডের গোপন শক্তি জাগিয়ে তুলতে গিয়েছিলাম।”

কথাগুলো শুনে সোমের মাথায় যেন এক বিদ্যুৎ ঝলক খেলে গেল। মাধবী? এই নামটা তার কাছে নতুন নয়। তার স্মৃতিহীন মস্তিষ্কের গভীরে যেন কিছু পরিচিত শব্দ গুঞ্জন করছিল। কুন্ডের গোপন শক্তি?

মাধবী বলতে লাগল, “হ্যাঁ সোম, তুমি। তুমি ছিলে এক শক্তিধর তান্ত্রিক। আমরা দু’জনেই ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম, কুন্ডের শক্তিকে ব্যবহার করে আমরা অমরত্ব লাভ করব। তাই আমরা এক অভিশপ্ত আচারে মেতে উঠেছিলাম।” মাধবীর চোখ দুটি ছলছল করে উঠল। “কিন্তু তুমি ভুল করেছিলে, সোম। সেই আচারের ভুল প্রয়োগের ফলে কুন্ডের দেবী রুষ্ট হলেন। অভিশাপ নেমে এল। ভুলবশত আমি মারা গেলাম, আর আমার আত্মা কুন্ডের অতল গভীরে আটকে পড়ল। আর সেই দিন থেকেই অভিশাপের শুরু।”

সোম হতবাক হয়ে শুনছিল। তার মনে হলো, যেন তার স্মৃতির প্রতিটি শূন্য স্থান পূরণ হয়ে যাচ্ছে। সে ছিল সেই তান্ত্রিক! তারই ভুলে মাধবীর মৃত্যু হয়েছিল, আর তার আত্মাই কুন্ডে বন্দি। এইবার সে বুঝতে পারছিল, কেন তার স্মৃতি হারিয়েছিল, কেন সে এই কুন্ডের দিকে টেনে এসেছিল, আর কেন বৃদ্ধ পাণ্ডা বলেছিল, “কুন্ড ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে… এটার অপেক্ষা ছিল বহু বছর ধরে।”

মাধবী তার হাত বাড়াল সোমের দিকে। তার হাত ছিল বরফের মতো ঠান্ডা, কিন্তু তার স্পর্শে সোম এক অদ্ভুত পরিচিতি অনুভব করল। “তুমি ফিরে এসেছ, সোম। আমার মুক্তি তোমার হাতে। কুন্ডের অভিশাপ শেষ করতে পারবে শুধু তুমি।”

সোম জানত না, এই মুক্তি কীভাবে সম্ভব। এই মুহূর্তে তার মনে ছিল কেবল এক ভয়ংকর সত্য: সে নিজেই এই অভিশাপের মূল কারণ। পূর্ণিমার আলোয় তামসা কুন্ডের জল আরও গভীর দেখাচ্ছিল। তার ভেতরে লুকিয়ে ছিল মাধবীর দীর্ঘদিনের আর্তনাদ, আর এক প্রাচীন অভিশাপের তীব্র ক্ষুধা। সোম বুঝতে পারছিল, এই রাতের নিশিযাত্রা কেবল এক শুরু, আসল পরীক্ষা তখনও বাকি।

অধ্যায় ৫: আত্মার স্খলন ও পুরনো প্রতিশ্রুতি

মাধবীর কথাগুলো সোমের মনে এক প্রবল ঘূর্ণিঝড় তুলেছিল। তার স্মৃতিহীন মস্তিষ্কের প্রতিটি কোণে যেন আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছিল, যা তার পূর্বজন্মের ভয়াবহ সত্যকে উন্মোচন করছিল। সে ছিল সেই তান্ত্রিক! ক্ষমতার লোভে সে এক ভয়ঙ্কর মন্দ কৃত্যে মেতে উঠেছিল, যার ফলস্বরূপ মাধবীর করুণ মৃত্যু হয়েছিল এবং তার আত্মা তামসা কুন্ডে চিরকালের জন্য বন্দি হয়েছিল। সেই অভিশাপের বোঝা আজ এই জীবনে তার কাঁধে ফিরে এসেছে। পূর্ণিমার আলোয় কুন্ডের জল যেন আরও গাঢ়, আরও রহস্যময় দেখাচ্ছিল।

মাধবী তখনও সোমের সামনে দাঁড়িয়েছিল, তার চোখ দুটোতে ছিল এক তীব্র শূন্যতা, যা একই সাথে অভিযোগ আর প্রতীক্ষায় ভরা। “তুমি ছিলে সোম, সেই মহান তান্ত্রিক, যার শক্তি ছিল অসীম। তুমি প্রতিজ্ঞা করেছিলে আমাকে মুক্তি দেবে। কিন্তু তুমি আমাকে এক অভিশপ্ত জলাধারে বন্দি করে রেখে চলে গেছিলে।” মাধবীর কণ্ঠস্বর ছিল বেদনায় ভারী, কিন্তু তার মধ্যে এক চাপা ক্ষোভও ছিল।

সোম ধীরে ধীরে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসল। তার শরীর কাঁপছিল, কিন্তু তার মন যেন এক গভীর বোধগম্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তার স্মৃতি ফিরছে! যেন এক বিশাল চিত্রপট তার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। সে দেখতে পাচ্ছিল তার পূর্বজন্মের সেই অহংকারী তান্ত্রিক রূপ, যে ক্ষমতার শিখরে পৌঁছানোর জন্য সবকিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল। সে দেখতে পাচ্ছিল সেই অভিশপ্ত আচার, যেখানে সে মাধবীকে ব্যবহার করেছিল কুন্ডের শক্তিকে জাগানোর জন্য। কিন্তু তার গণনা ভুল হয়েছিল, তার লোভ তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। সেই আচারের ভুল প্রয়োগেই মাধবী মারা গিয়েছিল, আর তার আত্মাকে কুন্ডের অতল গভীরে বেঁধে ফেলেছিল।

মাধবী বলতে লাগল, “তুমি আমাকে বলেছিল, ‘আমি ফিরে আসব, মাধবী। আমি তোমাকে মুক্ত করব। এই কুন্ডের অভিশাপ আমিই শেষ করব।’ সেই প্রতিশ্রুতিতে আমি বহু বছর ধরে এখানে বন্দি হয়ে আছি, অপেক্ষা করছি তোমার ফিরে আসার জন্য।” মাধবীর কথার সাথে সাথে কুন্ডের জল মৃদু ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করছিল, যেন সেও মাধবীর দীর্ঘ প্রতীক্ষার সাক্ষী।

সোম অনুভব করল, তার স্মৃতিতে আরও কিছু দৃশ্য ভেসে উঠছে। সেই অভিশপ্ত আচারের সময়, যখন কুন্ডের শক্তি বিস্ফোরিত হয়েছিল, তখন সেও গুরুতর আঘাত পেয়েছিল। হয়তো সেই আঘাতই তাকে স্মৃতিহীন করে তুলেছিল, তাকে এক নতুন জীবন দিয়েছিল এই অভিশাপ থেকে দূরে থাকার জন্য। কিন্তু ভাগ্য তাকে আবার এই তামসা কুন্ডে ফিরিয়ে এনেছে, তার অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করার জন্য।

কিন্তু মাধবী হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠলো। তার কণ্ঠস্বর পরিবর্তন হলো, তাতে এক অশুভ ইঙ্গিত। “কিন্তু সোম, তুমি যা জানো না, তা হলো—কুন্ড শুধু আত্মা মুক্তি দেয় না… তাকে চায় নতুন প্রাণ! এই কুন্ড এক ক্ষুধার্ত সত্তা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বলি চাইছে। আমি একা নই, আরও অসংখ্য আত্মা এখানে বন্দি, যারা মুক্তি চাইছে। কিন্তু তাদের মুক্তি আসে নতুন প্রাণের বিনিময়ে।”

সোমের শরীর ভয়ে হিম হয়ে গেল। “তার মানে… এইবার সোম-ই হবে সেই উৎসর্গ?”

মাধবী দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “কুন্ড তার ক্ষুধা মেটাতে চায়, সোম। তুমিই সেই ব্যক্তি, যার মাধ্যমে এই অভিশাপ শুরু হয়েছিল। আর তুমিই সেই ব্যক্তি, যার আত্মত্যাগই এই অভিশাপের চূড়ান্ত মুক্তি আনতে পারে। আত্মারা জেগে উঠছে, অতীত ও বর্তমান মিশে যাচ্ছে। তুমি এসেছ, আর কুন্ডের আত্মারা তাদের পূর্ণতার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।”

সোম অনুভব করল, যেন কুন্ডের ভেতর থেকে অসংখ্য অদৃশ্য হাত তাকে টেনে ধরার চেষ্টা করছে। তার কানে ভেসে আসছিল অসংখ্য আত্মার ফিসফিসানি, তাদের দীর্ঘদিনের বন্দিদশার আর্তনাদ। তার চারপাশে বাতাস ভারী হয়ে উঠলো, আর অন্ধকার আরও ঘনীভূত হলো। সে বুঝতে পারছিল, এই যাত্রা কেবল মাধবীর মুক্তির জন্য নয়, এটা তার নিজের আত্মত্যাগের পথ। তার পূর্বজন্মের পাপের প্রায়শ্চিত্ত।

তামসা কুন্ডের জল হঠাৎ করেই আরও গাঢ় হয়ে উঠলো, যেন গভীর অতল থেকে কোনো ভয়ঙ্কর শক্তি জেগে উঠছে। মাধবীর চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল, কিন্তু তাতে কোনো আনন্দ ছিল না, ছিল কেবল এক প্রাচীন বিষাদ। সোম জানত না, কীভাবে এই অভিশাপের চক্র ভাঙা যাবে। তার সামনে দুটি পথ ছিল: হয় সে নিজের জীবন উৎসর্গ করে অসংখ্য আত্মাকে মুক্তি দেবে, অথবা সে পালিয়ে যাবে এবং কুন্ডের অভিশাপ তামসা গ্রামকে গ্রাস করবে। তার পূর্বজন্মের ভুল, তার বর্তমান জীবনের স্মৃতির শূন্যতা, আর মাধবীর করুণ আকুতি—সবকিছুই তাকে এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এইবার তাকে নিজের অস্তিত্বের জন্য লড়তে হবে, আর একই সাথে অসংখ্য আত্মার মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে হবে। রাত আরও গভীর হচ্ছিল, আর তামসা কুন্ডের অভিশাপ যেন সোমের জন্য তার চরম পরিণতি প্রস্তুত করছিল।

অধ্যায় ৬: রক্তপিপাসু জল

পরদিন সকালে সোম গ্রামে ফিরে এল। তার মুখ ছিল ফ্যাকাশে, চোখে ছিল গভীর অবসাদের ছাপ, কিন্তু তার দৃষ্টিতে ছিল এক নতুন সংকল্প। গ্রামের মানুষেরা তাকে দেখে আরও অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছিল। তাদের চোখে ভয় স্পষ্ট। সোম দেখল, গ্রামের মোড়ের চায়ের দোকানে কয়েকটি লোক ফিসফিস করে কথা বলছে, তাদের মুখে উদ্বেগ।

কাছে গিয়ে সোম শুনতে পেল তাদের কথোপকথন। গ্রামের দুজন যুবক নিখোঁজ হয়েছে। কাল রাত থেকে তাদের আর খোঁজ নেই। তাদের নাম ছিল রতন আর বিনোদ। গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানও চিন্তিত মুখে বসেছিলেন। সোমের মনে পড়ল বৃদ্ধের কথা, “পূর্ণিমার রাতে কুন্ডের জল লাল হয়ে ওঠে, আর কে যেন জলের তলায় কিছু টানে।” আর মাধবীর কথা, “কুন্ড শুধু আত্মা মুক্তি দেয় না—তাকে চায় নতুন প্রাণ।”

সোম বুঝতে পারছিল, নিখোঁজ হওয়া যুবকেরা নিশ্চয়ই কুন্ডের নতুন শিকার। অভিশপ্ত আত্মারা তাদের ক্ষুধার জন্য নতুন প্রাণ আকর্ষণ করছে। তামসা কুন্ডের জল ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠছে—এই কথাটা যেন তার কানে বাজছিল। যদি সে কিছু না করে, তাহলে কুন্ডের ক্ষুধা আরও বাড়বে, এবং একসময় কুন্ড পুরো গ্রামকে গ্রাস করবে। এই গ্রাম, এই কুন্ড, আর এই অভিশাপ—সবকিছুর উৎস সে নিজেই। তাই, এর সমাধানও তাকেই করতে হবে।

সোম সেই ধ্বংসপ্রায় মন্দিরের দিকে ছুটল। তার হাতে ছিল সেই পুরাতন পুঁথি—’তামসা তন্ত্র’। সে জানত, এই পুঁথিতেই লুকিয়ে আছে এই অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায়। মন্দিরের ধুলোমাখা মেঝেতে বসে সে পুঁথির প্রতিটি পাতা উল্টাতে লাগল, গভীরভাবে পাঠ করতে লাগল প্রতিটি সংস্কৃত শ্লোক আর সাংকেতিক চিহ্ন। তার পূর্বজন্মের তান্ত্রিক জ্ঞান ধীরে ধীরে ফিরে আসছিল, তাকে সাহায্য করছিল পুঁথির গভীরে লুকিয়ে থাকা অর্থ বুঝতে।

বহুক্ষণ ধরে পুঁথি পড়ার পর, সোম একটি নির্দিষ্ট অধ্যায়ে এসে থমকে গেল। সেখানে অভিশাপ মুক্তির এক প্রাচীন প্রতিকারমূলক কৃত্যর বর্ণনা ছিল। এই কৃত্য ছিল অত্যন্ত জটিল এবং বিপজ্জনক। এতে একটি বিশেষ তাবিজ তৈরি করতে হবে, যা কুন্ডের আত্মাদের শান্ত করতে পারবে। কিন্তু সেই তাবিজ তৈরি করতে হলে ত্যাগ করতে হবে নিজের এক প্রিয় বস্তু—তার আত্মা। অর্থাৎ, আত্মত্যাগই হবে এই অভিশাপের শেষ পরিণতি।

সোমের শরীর শিউরে উঠলো। তার আত্মা? তার মানে কি তাকে মরতে হবে? এই অভিশাপের চেইন ভাঙতে হলে তাকে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হবে? তার মন এক দ্বিধায় পড়ে গেল। একদিকে জীবন বাঁচানোর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, অন্যদিকে অসংখ্য আত্মাকে মুক্তি দেওয়ার নৈতিক দায়িত্ব। মাধবীর মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো—তার শূন্য চোখ, তার দীর্ঘদিনের বেদনা। রতন আর বিনোদের কথা মনে পড়ল। তাদের পরিবার নিশ্চয়ই অপেক্ষায় আছে। সোম আর দ্বিধা করল না। সে জানত, এটাই তার প্রায়শ্চিত্তের পথ।

তান্ত্রিক পুঁথিতে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসারে, সোম তাবিজ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে লাগল। কিছু বিরল লতাপাতা, পুরনো মন্দিরের মাটি, বিশেষ কিছু ফুল, আর একমুঠো চাল—সবকিছুই তাকে নিঁখুতভাবে সংগ্রহ করতে হচ্ছিল। প্রতিটা ধাপ ছিল সূক্ষ্ম এবং ঝুঁকিপূর্ণ। সে জানত, সামান্য ভুলও তার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে পারে, এমনকি তার নিজের জীবনকেও বিপন্ন করতে পারে।

সূর্য ডুবছিল, আর তামসা কুন্ডের জল ধীরে ধীরে আরও গাঢ় লাল হয়ে উঠছিল। যেন জলের নিচে কিছু রক্তপিপাসু সত্তা জেগে উঠেছে। গ্রামের মানুষ ভয়ে নিজেদের ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়েছিল। কেউ জানত না, এই রাতে কী ঘটতে চলেছে। সোম জানত, সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। সে যদি এই কৃত্য সম্পন্ন করতে না পারে, তাহলে কুন্ডের ক্ষুধা বেড়ে যাবে, আর অসংখ্য প্রাণ অকালে ঝরে যাবে।

সে মন্দিরের ভেতরে বসে তাবিজ তৈরি করতে লাগল। তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু তার মন ছিল স্থির। তার সামনে তখন শুধু একটিই লক্ষ্য—এই অভিশাপের অবসান ঘটানো। কিন্তু তার আত্মা? কীভাবে সে তার আত্মাকে উৎসর্গ করবে? পুঁথিতে এর কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা ছিল না, কেবল কিছু সাংকেতিক ইঙ্গিত ছিল, যা আত্মত্যাগের এক ভিন্ন অর্থ বহন করছিল। সোম জানত না, তার জন্য কী অপেক্ষা করছে, কিন্তু সে প্রস্তুত ছিল। কারণ, এই অভিশাপের শুরু হয়েছিল তার হাত ধরেই, আর শেষটাও তাকেই করতে হবে।

অধ্যায় ৭: আত্মা বিনিময়ের রাত

ঠিক মধ্যরাতে, যখন চন্দ্রালোক কুন্ডের জলে রূপালী আলো ছড়াচ্ছিল, সোম সেই তাবিজ হাতে নিয়ে কুন্ডের কাছে এসে দাঁড়াল। তার মনে তখন ভয় ছিল না, ছিল এক ধরণের স্থির সংকল্প। কুন্ডের জল তখন আর লাল ছিল না, কিন্তু তার গভীরতা ছিল এক অন্যরকম রহস্যে মোড়া। সোম জানত, এই রাত তার শেষ রাত হতে পারে, অথবা অসংখ্য আত্মার মুক্তির রাত।

একটু পরেই, কুন্ডের জল থেকে ধীরে ধীরে এক নিরাকার ছায়া উঠে এল। ছায়াটা ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগল, আর রূপ নিল মাধবীর। সোম ও মাধবীর আত্মা মুখোমুখি হলো। মাধবীর চোখ দুটো তখনো শূন্য, কিন্তু তার মধ্যে এক তীব্র আবেগ দেখা যাচ্ছিল। তার মুখে এক অব্যক্ত বেদনা আর বহু বছরের জমে থাকা অভিমান।

মাধবী ফিসফিস করে বলল, “তুমি ফিরে এসেছ, সোম। আমি জানতাম তুমি আসবে। কিন্তু কেন এত দেরি করলে? তুমি আমাকে ভালোবাসলে না কেন? তুমি ক্ষমা পাবে না!”
মাধবীর কণ্ঠে অভিযোগের সুর, তার বেদনা যেন সোমের হৃদয়ে আঘাত করল। সোম অনুভব করল, তার পূর্বজন্মের সমস্ত ভুল, সমস্ত অহংকার যেন এক মুহূর্তে ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে। সে সত্যি মাধবীকে ভালোবাসেনি, ক্ষমতার লোভে সে তাকে ব্যবহার করেছিল। এই অনুশোচনা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল।

সোম ধীরে ধীরে মাধবীর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “মাধবী, আমি জানি আমার ভুল হয়েছিল। আমি ক্ষমা চাইছি। আমার লোভ আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। আমি তোমাকে ভালোবাসিনি, কিন্তু আমি তোমার আত্মার মুক্তি চাই। আমি এই অভিশাপের শেষ করতে চাই। আমি তোমাকে মুক্ত করতে এসেছি।”

মাধবীর চোখে এক ঝলক আলো দেখা গেল, কিন্তু পরক্ষণেই তা মিলিয়ে গেল। “মুক্তি? তুমি কি সত্যিই আমাকে মুক্তি দিতে পারবে? নাকি এটিও তোমার নতুন কোনো ছলনা, যেমনটি তুমি পূর্বে করেছিলে?” তার কণ্ঠে অবিশ্বাস।

সোম দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “না মাধবী। আর কোনো ছলনা নয়। আজ রাতে আমি আমার আত্মা উৎসর্গ করতে এসেছি, এই অভিশাপের অবসান ঘটাতে। আমি আমার প্রিয় বস্তুকে ত্যাগ করব।” কথা শেষ হতেই কুন্ড তখন প্রবল ঝড়ের মতো জেগে উঠলো! কুন্ডের জল যেন ফুঁসে উঠলো, ঢেউগুলো বিশাল আকার ধারণ করল। জলের ভেতর থেকে ভেসে আসতে লাগল অদ্ভুত শব্দ, ছায়া, আর অশরীরী আত্মাদের চিৎকার! অসংখ্য আত্মা যেন তাদের মুক্তির জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। বাতাস ভারী হয়ে উঠলো এক অব্যক্ত যন্ত্রণায়, আর চাঁদের আলোয় কুন্ডের চারপাশে ভৌতিক ছায়াগুলো নড়াচড়া করতে লাগল।

অসংখ্য হাত যেন জলের নিচ থেকে সোমকে টানতে চাইছিল। আত্মারা তাদের আর্তনাদ আর উল্লাসের এক মিশ্রণে চিৎকার করছিল। মাধবীর শরীরটা কেমন যেন কাঁপতে শুরু করল। তার শূন্য চোখে এবার যেন এক ধরণের মুক্তি আর ভয়াবহতার মিশ্রণ দেখা গেল।

সোম তার হাতে থাকা তাবিজটি কুন্ডের দিকে ছুঁড়ে দিল। তাবিজটি কুন্ডের জলের উপর ভেসে উঠলো, আর তার থেকে এক অদ্ভুত আলো বিচ্ছুরিত হলো। আত্মারা আরও বেশি উন্মত্ত হয়ে উঠলো, যেন সেই আলো তাদের জ্বালা দিচ্ছে।

সোম এক গভীর শ্বাস নিল। সে মাধবীর দিকে তাকাল। তার চোখে ছিল এক ধরণের দৃঢ়তা। “মাধবী, আমি তোমার মুক্তি চাই। আমার প্রায়শ্চিত্ত হোক।”

আর কোনো দ্বিধা না করে, সোম নিজের আত্মাকে উৎসর্গ করে তামসা কুন্ডে ঝাঁপ দিল। জলের গভীরে সে তলিয়ে যেতে লাগল, আর তার চারপাশে অসংখ্য আত্মা যেন মুক্তি পেয়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছিল। এক তীব্র আলো কুন্ডের ভেতর থেকে বিচ্ছুরিত হলো, যা রাতের আকাশকে এক মুহূর্তের জন্য আলোকিত করে তুলল। সমস্ত শব্দ থেমে গেল। আত্মাদের চিৎকার, জলের আলোড়ন, বাতাসের তীব্রতা – সবকিছু যেন এক মুহূর্তে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তামসা কুন্ড শান্ত হলো। সোম জলের গভীরে তলিয়ে গেল, আর তার সাথে হারিয়ে গেল অভিশাপের দীর্ঘ ইতিহাস।

কুন্ডের জলের পৃষ্ঠ তখন শান্ত, তাতে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। মাধবীর আত্মা তখনও কুন্ডের ধারে দাঁড়িয়েছিল, তার চোখ দুটো আর শূন্য ছিল না, তাতে ছিল এক ধরণের স্বস্তি, এক ধরণের মুক্তি। সে ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে যেতে লাগল, যেন এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। কিন্তু তার শেষ দৃষ্টিতে ছিল এক গভীর বিষাদ, যা সোমের আত্মত্যাগের নীরব সাক্ষী ছিল। রাত গভীর হলো, আর তামসা কুন্ডে ফিরে এল এক অচেনা শান্তি, যা বহু বছর ধরে অধরা ছিল।

অধ্যায় ৮: নিঃশেষ… না কি নতুন অভিশাপ?

সোমের আত্মত্যাগের পর তামসা কুন্ডের ওপর যেন এক অলৌকিক শান্তি নেমে এসেছিল। রাতভর যে ঝড় আর আত্মাদের উন্মত্ত চিৎকার গ্রামকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছিল, ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই তা মিলিয়ে গিয়েছিল। ভোরবেলা সূর্যের প্রথম রশ্মি যখন কুন্ডের শান্ত জলের ওপর পড়ল, তখন তার স্বচ্ছতা দেখে গ্রামবাসীরা অবাক হয়ে গেল। দীর্ঘ বহু বছর পর, কুন্ডের জল আর রক্তিম ছিল না।

পরদিন সকালে গ্রামের লোক যখন কুন্ডের ধারে এলো, তখন তারা দেখল কুন্ড শান্ত। গতকাল রাতের ভয়াল ঘটনাগুলো যেন এক দুঃস্বপ্ন ছিল। কুন্ডের চারপাশে আর কোনো অশরীরী ছায়া ছিল না, বাতাসে কোনো পচা গন্ধ ছিল না। জলের পৃষ্ঠ ছিল মসৃণ, স্বচ্ছ। প্রথমবারের মতো, কুন্ডের জলে তাদের মুখের প্রতিবিম্ব পড়ল – যা ছিল এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। গ্রামের বয়স্করা যারা বংশপরম্পরায় কুন্ডের অভিশাপের গল্প শুনেছিল, তারা বিশ্বাস করতে পারছিল না তাদের চোখকে। কেউ আর ভয় পায় না কুন্ডের কাছে আসতে। শিশুরা আবার কুন্ডের ধারে খেলাধুলা শুরু করল। মনে হলো, যেন বহু বছরের অভিশাপ থেকে তামসা গ্রাম মুক্তি পেয়েছে।

কিন্তু এই শান্তির পেছনে ছিল এক গভীর বিষাদ। গ্রামবাসীরা সোমকে খুঁজতে লাগল। তারা তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানত না, কেবল এটুকু জানত যে সে এক অচেনা আগন্তুক। তারা মন্দিরের চারপাশে, কুন্ডের ধারে – সম্ভাব্য সব জায়গায় তাকে খুঁজলো। কিন্তু সোম নেই। তার কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। সে যেন বাতাসের সাথে মিলিয়ে গেছে, ঠিক যেমন তার স্মৃতি মিলিয়ে গিয়েছিল হাওড়া স্টেশনে। গ্রামের কিছু মানুষ মনে করল, সে হয়তো অভিশাপ মুক্ত করার পর গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করল, কুন্ডই তাকে গিলে খেয়েছে, তার আত্মত্যাগের বিনিময়েই এসেছে এই শান্তি। সোমের অন্তর্ধান রহস্যই রয়ে গেল, এক নীরব আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে।

দিন কাটল, সপ্তাহ গেল, মাস ঘুরে বছর ঘুরে আবার পূর্ণিমা এলো। তামসা গ্রামে এবার আর পূর্ণিমার ভয় ছিল না। কুন্ডের জল ছিল স্বচ্ছ, আর গ্রামবাসীরা নির্ভয়ে তাদের দৈনন্দিন কাজ করত। অভিশাপের কথাগুলো যেন এক পুরনো কিংবদন্তি হয়ে গেছে। গ্রামের বাতাস ছিল নির্মল, আর মানুষের মুখে ছিল স্বস্তি।

সেই রাতে, যখন পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে আলো ছড়াচ্ছিল, গ্রামের এক বালক কুন্ডের ধারে তার বন্ধুদের সাথে খেলছিল। তার নাম ছিল রনি। সে নির্ভয়ে কুন্ডের জলের দিকে তাকাল, চাঁদের আলোয় কুন্ডের জল রূপালী দেখাচ্ছিল। হঠাৎ রনি দেখল, জলের গভীরে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। সে আরও কাছে গিয়ে জলের দিকে ঝুঁকে পড়ল।

প্রথমেই তার চোখে পড়ল, কুন্ডের শান্ত জলে এক অচেনা পুরুষের প্রতিবিম্ব! প্রতিবিম্বটি ছিল আবছা, কিন্তু তার মুখটা স্পষ্ট ছিল। মুখটা ছিল সোমের! সে একই রকম শান্ত এবং স্থিরভাবে জলের গভীরে তাকিয়ে আছে, যেন সে কোনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

রনি ভয়ে কাঁপতে শুরু করল। সে তার চোখ কচলে আবার দেখল। হ্যাঁ, প্রতিবিম্বটা এখনও সেখানেই আছে, সোমের মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রনি চিৎকার করে তার বন্ধুদের ডাকতে চাইল, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। তার মনে হলো, যেন সে একা এই দৃশ্য দেখছে, অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না।

ঠিক তখনই, জলের গভীর থেকে, যেন খুব কাছ থেকে, এক চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এল! কণ্ঠস্বরটি ছিল শান্ত, গভীর, এবং পরিচিত। এটি ছিল সোমের কণ্ঠস্বর, যা সে কোনোদিন শোনেনি, কিন্তু এখন তার কাছে পরিচিত মনে হলো। কণ্ঠস্বরটি রনির কানে এসে ফিসফিস করে বলল:
“তুমি কি মুক্ত হতে চাও?”

রনি ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। সে পিছিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু তার পা যেন কুন্ডের ধারে আটকে গিয়েছিল। কুন্ডের জলে সোমের প্রতিবিম্বের চোখে তখন এক অদ্ভুত দীপ্তি দেখা গেল। এটি কি সত্যিই মুক্তি, নাকি এক নতুন অভিশাপের সূচনা? সোম কি সত্যিই মুক্তি পেয়েছে, নাকি সে নিজেই এখন কুন্ডের অভিশাপের এক নতুন রূপ হয়ে উঠেছে, নতুন প্রাণের সন্ধানে? রনি জানত না, এই প্রশ্নের উত্তর কী। সে শুধু অনুভব করছিল, তামসা কুন্ডের রহস্য শেষ হয়নি, বরং এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে, যার পরিণতি আরও ভয়ংকর হতে পারে।

শেষ

© পিনাকী রঞ্জন পাল

ছবি এআই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *