ভয়ের গল্প : শ্মশানের পিশাচ

পিনাকী রঞ্জন পাল

অনেক দিন আগের কথা। জলপাইগুড়ি তখন ছিল এক নির্জন শহরতলীর মতো। দূরে দূরে মানুষের বাস, মাঝখানে সবুজ মাঠ আর শস্যখেত। শহরের বুক চিরে বয়ে চলা করলা নদী ছিল জীবনের স্রোতস্বিনী। করলার জলে বয়ে যেত মানুষের সুখ-দুঃখ, আর নদীর তীরেই এক প্রাচীন শ্মশান ছিল, যেখানে চিতার ধোঁয়া প্রায় সবসময়ই আকাশে উঠত।

তবে এই শ্মশান ছিল রহস্যময়। দিনের বেলাতেও সেটি ছিল ভুতুড়ে, আর রাতে তো কেউ ভুলেও তার ধারে-কাছে যেত না। স্থানীয় লোকেরা বলত, শ্মশানে এক অশুভ শক্তির বাস। পুরনো গল্পে শোনা যায়, বহু বছর আগে এই জায়গায় এক তান্ত্রিক এসেছিলেন। তিনি ছিলেন বিদ্বান, কিন্তু অত্যন্ত অহংকারী। তার জানা ছিল তন্ত্র-মন্ত্র, কিন্তু সেই মন্ত্র ব্যবহার করে তিনি মানুষের উপকারের বদলে নিজের শক্তি বাড়ানোর কাজে লিপ্ত ছিলেন।

একদিন সেই তান্ত্রিক ভুলবশত এমন এক মন্ত্র প্রয়োগ করেন, যা এক পিশাচকে মুক্তি দেয়। সেই পিশাচ তান্ত্রিককে অভিশাপ দেয় এবং তাকে হত্যা করে। তান্ত্রিকের আত্মা আর মুক্তি পায়নি এবং সে শ্মশানেই বন্দী হয়ে থাকে। তার সাথে সেই পিশাচও চিরকাল ওই শ্মশানের তত্ত্বাবধানে রয়ে যায়।

এলাকারই এক তরুণ ছিল রঘু। বয়স হবে ২১-২২ বছর। সে ছিল অত্যন্ত সাহসী, কিন্তু বেপরোয়া। গ্রামের লোকেরা তাকে ভয় পেত, কারণ সে কাউকে পরোয়া করত না। শ্মশানের গল্প শোনার পর থেকেই রঘুর ইচ্ছা হয়, সেখানে গিয়ে প্রমাণ করবে যে এসব পুরোটাই মিথ্যে।

এক বর্ষার সন্ধ্যায় বন্ধুরা মিলে তাকে চ্যালেঞ্জ দেয়। তারা বলে, “তোর সাহস যদি এতই বেশি হয়, তাহলে রাতে শ্মশানে গিয়ে একটা শালপাতা নিয়ে আয়।” রঘু এই চ্যালেঞ্জ হাসিমুখে গ্রহণ করে। এলাকার বৃদ্ধরা তাকে সাবধান করেন, কিন্তু সে কারও কথা শোনে না।

রাত ঠিক বারোটা। হাতে মশাল নিয়ে রঘু শ্মশানের দিকে রওনা হয়। তার বুকের ভেতর ধুকপুক করছিল, কিন্তু মুখে সাহসের হাসি ধরে রেখেছিল। করলা নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে শ্মশানের গেটের সামনে পৌঁছায়। গেটটা পুরনো লোহার, জং ধরেছে। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই একটা ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা তার মুখে লাগে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। দূরে কুকুরের হালকা ডাক শোনা যায়।

শ্মশানের ভেতরে ঢুকে রঘু চারপাশে তাকায়। পুরনো, পচা শবদেহের গন্ধ নাকে এসে লাগে। হঠাৎ, মশালের আলো নিভে যায়। অন্ধকার তাকে ঘিরে ধরে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ সে শুনতে পায় কারও ফিসফিস আওয়াজ, “তুমি এখানে কেন?”

রঘু পিছন ফিরে তাকায়। কেউ নেই।

হঠাৎ, তার কাঁধে ভারী একটা হাতের স্পর্শ পায়। সে ভয় পেয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। সামনে দাঁড়িয়ে এক বিশাল ছায়ামূর্তি। তার লাল চোখ জ্বলছে, মুখ থেকে পচা মাংসের গন্ধ বেরোচ্ছে। মূর্তিটি ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে।

পিশাচটি বলল, “তোমার সাহস আছে, কিন্তু তুমি ভুল জায়গায় এসেছ। যারা আমাকে বিরক্ত করে, তারা এই শ্মশানেই বন্দী হয়ে যায়।”

রঘু পালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তার পা যেন মাটিতে আটকে যায়। পিশাচটি তার দিকে এগিয়ে এসে তার গলায় হাত দেয়। রঘু অসহায়ভাবে চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু তার আওয়াজ যেন করলার জলে মিলিয়ে যায়।

পরের দিন সকালে গ্রামের লোকেরা শ্মশানের পাশে রঘুর মৃতদেহ খুঁজে পায়। তার মুখে এমন এক ভয়ের ছাপ যে কেউ সহজে ভুলতে পারবে না। তার চোখ ফেটে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে যেন।

এই ঘটনার পর থেকে আর কেউ রাতের বেলা শ্মশানের ধারে-কাছে যায় না। লোকেরা বিশ্বাস করে, রঘু এখন সেই পিশাচের বন্দী। করলার জলে মাঝেমাঝে অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়, আর শ্মশানের বাতাসে ভেসে আসে সেই ভৌতিক ফিসফিসানি, “তুমি এখানে কেন?”

(গল্পটি কাল্পনিক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *