হরর গল্প : অশরীরী

পিনাকী রঞ্জন পাল

এক চিঠি, এক অপ্রকাশিত উপন্যাস, এক অশরীরীর প্রতিশোধ! মহাদেবের সামনে খুলে যায় ১৯৪২ সালের ব্রিটিশ হত্যার এক অভিশপ্ত ইতিহাস। রহস্য, অতিপ্রাকৃত আর সাইকোলজিকাল হররের দুর্দান্ত মিশেল—অশরীরী একবার শুরু করলে থামা যায় না!

অধ্যায় ১: হারানো চিঠি

কোচবিহার শহরের আবছা ধুলো আর বইয়ের ম ম গন্ধে ভরা শ্রীরামপুর পাবলিক লাইব্রেরি। এর উঁচু তাকগুলো যেন হাজারো গল্পের নীরব সাক্ষী, আর প্রতিটি পাতার ভাঁজে লুকিয়ে আছে সময়ের ইতিহাস। এই লাইব্রেরিরই একজন নিবেদিত প্রাণ কর্মী, লেখক মহাদেব রায়। তার দিন কাটে পুরোনো বইয়ের গন্ধ শুঁকে, তাদের পাতায় হারিয়ে যাওয়া গল্প খুঁজে। মহাদেব নিজে লেখক হলেও তার লেখার জগতে রহস্য আর ভৌতিক উপাদানের আনাগোনা কম। বরং সে ইতিহাসের গভীরে ডুব দিতে ভালোবাসে।

একদিন, রুটিন মাফিক পুরোনো বইপত্র গোছাতে গিয়ে মহাদেব একটি জীর্ণ, মলাটছেঁড়া ঐতিহাসিক উপন্যাসের মধ্যে একটি চাপা দেওয়া খাম দেখতে পেল। খামটা এতটাই পুরোনো যে তার রঙ হলুদ হয়ে গেছে, আর তাতে লেগে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধুলো। সাবধানে খামটা খুলতেই তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটি ভাঁজ করা চিঠি। তারিখটা স্পষ্ট— ১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে পৃথিবীতে, আর ভারত তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে।

মহাদেব কৌতুহল নিয়ে চিঠিটা খুলল। হাতে নিতেই কেমন যেন একটা ঠান্ডা অনুভূতি হলো, যেন চিঠিটা কোনো জমাট বাঁধা বরফের টুকরো। অক্ষরের কালিতে কালচে ছোপ, যেন রক্ত শুকিয়ে গেছে। চিঠির কয়েকটি লাইন যেন মহাদেবের চোখ আটকে দিল: “ওরা আমাকে মেরে ফেলেছে, কিন্তু আমি ফিরে আসব… তুমি যদি এটা পড়ো, সাবধান।” চিঠির নিচে স্পষ্ট স্বাক্ষর—”দেবজ্যোতি”।

মহাদেবের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। কে এই দেবজ্যোতি? তাকে কে মেরে ফেলেছে? আর কেনই বা সে ফিরে আসার কথা বলেছে? চিঠিটা কি শুধু একটা নাটকীয় কোনো খেলার অংশ, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো ভয়ঙ্কর সত্যি? ১৯৪২ সালের প্রেক্ষাপটে ‘মেরে ফেলা’ মানে কি স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনো শহীদের শেষ আর্তনাদ? মহাদেবের মন দ্রুতগতিতে নানা প্রশ্ন আর সংশয়ের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল। সে চিঠিটা যত্ন করে নিজের পকেটে রাখল। লাইব্রেরির শান্ত পরিবেশেও হঠাৎ একটা চাপা অস্বস্তি তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।

সেদিন রাতে ফ্ল্যাটে ফিরে মহাদেব চিঠিটা আবার খুঁটিয়ে দেখল। দেবজ্যোতি নামটা যেন কানের কাছে ফিসফিস করে উঠল। মহাদেব বহু ঐতিহাসিক নথি ঘেঁটেছে, কিন্তু এই নামের কোনো উল্লেখ তার মনে পড়ছে না। একটা পুরোনো, অপরিচিত চিঠি কেন তাকে এমন অস্থির করে তুলছে? মহাদেব চা তৈরি করে জানালার পাশে বসল। বাইরে রাত গভীর হচ্ছে, আর কোচবিহারের পরিচিত শব্দগুলো কেমন যেন দূরে মনে হচ্ছে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বোঝাতে চাইল, এই চিঠিটা কেবল একটা কাগজ নয়, এটা কোনো এক অতৃপ্ত আত্মার শেষ বার্তা। সে জানত না, এই চিঠির মাধ্যমেই সে এক ভয়ঙ্কর অন্ধকারের দুয়ার খুলে ফেলেছে, যেখান থেকে আর সহজে ফেরা যাবে না।

অধ্যায় ২: অদৃশ্য উপস্থিতি

সেই রাত থেকেই মহাদেবের ফ্ল্যাটে অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা শুরু হলো। কোচবিহারের ছোট্ট ফ্ল্যাট, যেখানে মহাদেব একা থাকে, সেখানে এতদিন সে নির্জনতা আর শান্তিতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু এখন যেন সেই নির্জনতাটা এক অন্যরকম উপস্থিতিতে ভরে উঠেছে।

প্রথম ঘটনাটা ঘটল তার পড়ার টেবিলে। মহাদেব সাধারণত বইপত্র গোছানো অবস্থায় রাখে, কিন্তু সকালবেলা উঠে দেখে তার প্রিয় রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ বইটি টেবিলের মাঝখানে খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। কেবল খোলা নয়, বইয়ের পাতাগুলো এমনভাবে ভাঁজ করা যেন কেউ গভীর মনোযোগ দিয়ে কোনো নির্দিষ্ট লাইন পড়ছিল। মহাদেব অবাক হয়ে পাতা উল্টে দেখল, নির্দিষ্ট কোনো অংশে দাগ দেওয়া নেই। সে ভাবল হয়তো ভুলবশতই এমনটা হয়েছে। বইটা বন্ধ করে যথাস্থানে রেখে সে তার দৈনন্দিন কাজে মন দিল।

কিন্তু দুপুর গড়াতেই ঘটনাটা আরও স্পষ্ট হলো। মহাদেবের লেখার ঘরে একটা কাঁচের দোয়াত ছিল, যেখানে সে কালির মণ্ড তৈরি করে রাখত। সেই দোয়াতের কালি টেবিলের ওপর ছড়ানো ছিটানো। মনে হচ্ছে যেন কেউ ইচ্ছে করে দোয়াতটা উল্টে দিয়েছে। অথচ মহাদেব ঘর থেকে বেরোনোর আগে সব ঠিকঠাকই ছিল। তার বুকটা ধুকপুক করে উঠল। ভুলবশত? নাকি… অন্য কিছু? একটা চাপা ভয় বুকের মধ্যে বাসা বাঁধতে শুরু করল।

রাত যত গভীর হতে লাগল, অদ্ভুত ঘটনাগুলোও তত বাড়তে লাগল। বিছানায় শুয়ে মহাদেব যখন চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করছে, তখন সে স্পষ্ট শুনতে পেলো তার কানের কাছেই কেউ যেন শ্বাস নিচ্ছে। শ্বাসটা ভারী, যেন দীর্ঘ পরিশ্রমের পর হাঁপাচ্ছে। মহাদেব চোখ খুলে চারদিকে তাকাল, কিন্তু ফ্ল্যাটের কোথাও কোনো মানুষ তো দূরের কথা, কোনো প্রাণীর অস্তিত্বও নেই। সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল, হয়তো এটা তার মনের ভুল, চিঠির প্রভাব। কিন্তু শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটা আরও স্পষ্ট হতে লাগল, যেন শব্দটা তার ঘাড়ের কাছেই আসছে।

আরেক রাতে, মহাদেব ঘুম ভেঙে হঠাৎ তীব্র শীত অনুভব করল। মনে হলো ঘরের তাপমাত্রা যেন এক লহমায় নেমে গেছে হিমাঙ্কের নিচে। সে উঠে ওয়াশরুমে গেল জল পান করতে। বেসিনের সামনে আয়নার দিকে তাকাতেই তার মেরুদণ্ড দিয়ে এক ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। আয়নায় সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল, কিন্তু তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে এক লম্বা, মুখহীন মানুষের ছায়া! ছায়াটা স্থির, নিথর, যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার চোখ ছিল না, নাক ছিল না, কিন্তু মহাদেব অনুভব করতে পারছিল, ছায়াটা তাকেই দেখছে। আতঙ্কে মহাদেবের গলা শুকিয়ে গেল, সে চিৎকার করতে চাইল, কিন্তু গলা থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। এক পলক, শুধু এক পলক ছিল সেই ছায়া, তারপর যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

মহাদেব দ্রুতগতিতে ফ্ল্যাটের সব আলো জ্বালিয়ে দিল। প্রতিটি কোণায় চোখ বুলিয়ে দেখল, কিন্তু কোথাও কিছু নেই। তবুও সেই মুখহীন মানুষের ছবিটা তার মনে গেঁথে গেল। এ কি কেবল মনের ভুল, নাকি দেবজ্যোতির সেই চিঠি সত্যিই কোনো অশরীরী অস্তিত্বকে তার জীবনে ডেকে এনেছে? মহাদেব নিশ্চিত হলো, সে একা নয় এই ফ্ল্যাটে। কেউ আছে, যা সে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু যার উপস্থিতি সে তীব্রভাবে অনুভব করতে পারছে। আর সেই ‘কেউ’টা সম্ভবত সেই দেবজ্যোতি, যে বলেছিল, “আমি ফিরে আসব…”।

অধ্যায় ৩: রহস্যময় ডায়েরি

অদৃশ্য উপস্থিতি আর আয়নার সেই মুখহীন ছায়া মহাদেবের রাতের ঘুম কেড়ে নিল। লাইব্রেরিতে বসেও তার মন টিকছে না। দেবজ্যোতি কে ছিল, কেনই বা তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল— এই প্রশ্নগুলো মহাদেবের মাথায় পোকার মতো কিলবিল করছে। সে বুঝতে পারল, এই রহস্যের সমাধান না করলে সে নিজেও শান্তিতে থাকতে পারবে না।
মহাদেব ঠিক করল, দেবজ্যোতিকে নিয়ে আরও বিশদ গবেষণা করবে। কোচবিহারের পুরনো নথিপত্র, ঐতিহাসিক দলিল, এমনকি পুরনো খবরের কাগজের ফাইলপত্র ঘাঁটতে শুরু করল সে। বহু খোঁজাখুঁজির পর সে জানতে পারল, দেবজ্যোতি সত্যিই একজন বামপন্থী লেখক ছিলেন। ১৯৪০-এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং তার বিপ্লবী লেখনিগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু হঠাৎই ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। সরকারি নথিতে তার কোনো মৃত্যুর রেকর্ড নেই, শুধু ‘নিখোঁজ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রিটিশ পুলিশ তাকে ‘গুম’ করে দিয়েছিল—এই গুজব তখন বেশ প্রচলিত ছিল। মহাদেবের মনে পড়ল চিঠির সেই কথাগুলো: “ওরা আমাকে মেরে ফেলেছে…”।

এই তথ্যের সাথে চিঠির কথাগুলো মিলে যাওয়ায় মহাদেবের সন্দেহ আরও জোরালো হলো। দেবজ্যোতি কি সত্যিই মারা যাননি? নাকি তার আত্মা আজও ন্যায়বিচার চাইছে?

মহাদেব এবার লাইব্রেরির পুরোনো বইয়ের দোকান, অ্যান্টিক শপ এবং পুরোনো কাগজ বিক্রেতাদের কাছে খোঁজ নিতে শুরু করল। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল দেবজ্যোতি সম্পর্কে আরও কোনো সূত্র খুঁজে বের করা। দিন কয়েকের চেষ্টায়, শহরের এক কোণে একটি পুরোনো অ্যান্টিক শপে সে এক আশ্চর্য জিনিসের সন্ধান পেল।

দোকানদার একটি ধুলো মাখা, চামড়ার মলাটের ডায়েরি দেখাল, যেখানে লেখকের নাম লেখা—দেবজ্যোতি!মহাদেবের হাত কাঁপছিল যখন সে ডায়েরিটা খুলল। প্রথম কয়েকটি পাতা এলোমেলো লেখা। কিন্তু মাঝের একটি পাতায় তার চোখ আটকে গেল। সেখানে মোটা কালিতে লেখা কয়েকটি লাইন:

“ওরা আমাকে গলায় দড়ি দিয়ে মেরেছে… অন্ধকার কুঠুরিতে। আমার শেষ আর্তনাদ কেউ শোনেনি। আমি ন্যায় চাই। আমার কথা শেষ হয়নি। আমি এখনও এখানে আছি।” লাইনগুলো পড়ে মহাদেবের গলা শুকিয়ে গেল। ডায়েরির পাতায় যেন দেবজ্যোতির শেষ যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি। গলায় দড়ি দিয়ে মেরেছে! তাহলে কি তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল? কিন্তু কেন? আর ‘আমি এখনও এখানে আছি’—এই কথাটার মানে কি তার আত্মা এখনও এই পৃথিবীতেই আটকে আছে? মহাদেবের ফ্ল্যাটে যে অদৃশ্য উপস্থিতি, যে মুখহীন ছায়া, তা কি তবে দেবজ্যোতিরই আত্মা?

ডায়েরির আরও কিছু পাতা উল্টে মহাদেব দেখল, কিছু জায়গায় অস্পষ্ট আঁকিবুকি, যেন ভয়ে বা যন্ত্রণায় কলম কাঁপছিল। শেষ দিকের একটি পাতায় কিছু এলোমেলো শব্দ লেখা: ‘বাড়ি’, ‘ফাঁসি’, ‘রহস্য’, ‘মুক্তি’। এর নিচে একটি ঠিকানা—কিছুটা অস্পষ্ট হলেও বোঝা যাচ্ছে, এটি শহরের উপকণ্ঠের একটি ভাঙা বাড়ির ঠিকানা। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে মহাদেব বুঝতে পারল, এটা শুধু দেবজ্যোতির ব্যক্তিগত ডায়েরি নয়, এটা তার শেষ ইচ্ছাপত্র। দেবজ্যোতি হয়তো চেয়েছিল তার মৃত্যুর সত্য একদিন প্রকাশ পাক, তার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন হোক।

মহাদেবের মনে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি হলো। একদিকে ভয়, অন্যদিকে এই রহস্য ভেদ করার এক অদম্য জেদ। দেবজ্যোতি তাকে তার ফ্ল্যাটে অস্বস্তিতে ফেলছে, কিন্তু একইসাথে তাকে এই সত্য উন্মোচনের পথে চালিত করছে। মহাদেব ঠিক করল, ডায়েরিতে লেখা সেই ভাঙা বাড়ির ঠিকানা খুঁজে বের করবে। হয়তো সেখানেই লুকিয়ে আছে দেবজ্যোতির মৃত্যুর আসল রহস্য, আর তার অতৃপ্ত আত্মার মুক্তির পথ।

চতুর্থ অধ্যায়: ভাঙা বাড়ির সন্ধান

ডায়েরির প্রতিটি ছত্রে মহাদেব যেন এক অতল গহ্বরে ডুব দিচ্ছিল। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল এক অজানা রহস্যের গভীরে। বহু পুরোনো আর জীর্ণ সেই ডায়েরির পাতায় ধুলো আর সময়ের ছাপ। প্রতিটি পৃষ্ঠা উল্টানোর সাথে সাথে মহাদেবের হৃদস্পন্দন বাড়ছিল। অবশেষে, বেশ কিছুক্ষণ ঘেঁটে, সে একটা অস্পষ্ট ঠিকানা খুঁজে পেল। হাতে লেখা, প্রায় মুছে আসা অক্ষরে লেখা—একটা ভাঙা বাড়ির ঠিকানা। ডায়েরিতে এর উল্লেখ ছিল কেবল ‘শেষ আশ্রয়’ হিসেবে।

ঠিকানাটা নিয়ে মহাদেব তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ল। সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, আলো কমে আসছে দ্রুত। শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে, জনবসতিহীন এক নির্জন এলাকায় অবস্থিত সেই বাড়ি। চারদিকে আগাছা আর শুকনো পাতার জঙ্গল, যেন প্রকৃতিও বাড়িটাকে আড়াল করে রাখতে চাইছে। ভাঙা দেয়াল, ভেঙে যাওয়া ছাদ, আর মাকড়সার জালে ঢাকা জানালাগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, বাড়িটা বহু যুগ ধরে পরিত্যক্ত। একটা শীতল, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ চারপাশে ভাসছিল, যা জানান দিচ্ছিল ভেতরের অন্ধকার আর নিস্তব্ধতার কথা।

মহাদেব সাবধানে এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে। তার মনে ভয় আর কৌতূহল দুটোই সমান তালে কাজ করছিল। জীর্ণ লোহার গেটটা মরিচা ধরে আটকে আছে, কিন্তু মূল ফটকটা অদ্ভুতভাবে খোলা। সে যখন ফটকের সামনে দাঁড়াল, হঠাৎ মৃদু ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে পুরোনো কাঠের দরজাটা নিজে থেকেই হাট করে খুলে গেল। যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাকে ভেতরে স্বাগত জানাচ্ছে। এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে, যা মহাদেবের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নামিয়ে দিল।

ভেতরে প্রবেশ করতেই এক তীব্র দুর্গন্ধ নাকে এলো, আর তার সাথে মিশে ছিল পুরোনো কাঠ আর ধুলোর গন্ধ। সূর্যাস্তের শেষ আলোয় ভেতরের ভাঙাচোরা আসবাবপত্রের আবছা প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছিল। মনে হলো যেন কোনো অশরীরী ছায়া চারপাশে ঘোরাফেরা করছে। মহাদেব সাবধানে পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকল। প্রতিটা পদক্ষেপেই মেঝের পুরোনো কাঠ ক্যাঁচক্যাঁচ করে উঠছিল, আর সেই শব্দের প্রতিধ্বনি হচ্ছিল যেন এক ভুতুড়ে নীরবতার মাঝে। ঠিক তখনই, একটা ফিসফিসানি মহাদেবের কানে এলো। শব্দটা এত মৃদু ছিল যে প্রথমে মনে হচ্ছিল কানের ভুল, কিন্তু পরক্ষণেই তা আরও স্পষ্ট হলো। মনে হলো যেন খুব কাছ থেকে কেউ তার নাম ধরে ডাকছে, অথবা সরাসরি তার মনের ভেতরেই কথা বলছে। সেই ফিসফিসানিটা যেন বাতাসেই মিশে আছে, চারপাশ থেকে তাকে ঘিরে ধরছে। “তুমি কেন এখানে এসেছ?”

মহাদেব থমকে দাঁড়াল। তার গা কাঁটা দিয়ে উঠল। সে চারপাশে তাকাল, কিন্তু কোথাও কেউ নেই। দেয়ালগুলো যেন অন্ধকার আর রহস্যে মোড়া। সে জানত, এটা কোনো মানুষের কণ্ঠস্বর নয়। এটা ছিল সেই অশরীরী সত্তার কণ্ঠ, যার কথা ডায়েরিতে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। সেই ফিসফিসানি যেন ঘরের কোণায় কোণায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, মহাদেবকে যেন আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মহাদেব যখন চারপাশে চোখ বোলাচ্ছিল, হঠাৎ তার চোখ গেল একটা দেয়ালের দিকে। পুরোনো, পলেস্তারা খসা সেই দেয়ালের ওপর রক্তের গাঢ় দাগে কিছু একটা লেখা। যেন কোনো অদৃশ্য আঙুল দিয়ে কেউ তা লিখে গেছে। রক্তের শুকিয়ে যাওয়া লালচে রং অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। মহাদেব সভয়ে আরও কাছে এগিয়ে গেল, তার বুক ধড়ফড় করছিল। লেখাটা স্পষ্ট করে পড়া যাচ্ছিল: “মৃত্যুই শেষ নয়…”

এই কয়েকটি শব্দ যেন মহাদেবের রক্ত হিম করে দিল। তার মনে হলো, সে এক এমন রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়েছে, যেখানে জীবন আর মৃত্যুর সীমানা মুছে গেছে। এই ভাঙা বাড়িটা শুধু একটা কাঠামো নয়, এটা যেন এক অন্ধকার জগতের প্রবেশদ্বার, যেখানে অশরীরী আত্মারা তাদের না বলা গল্প নিয়ে অপেক্ষা করছে। মহাদেব বুঝল, সে যা ভেবেছিল, তার চেয়েও গভীর কিছু এই বাড়ির সাথে জড়িত। তার অনুসন্ধান তাকে এক ভয়ংকর সত্যের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে।

পঞ্চম অধ্যায়: অতীতের ছায়া

‘মৃত্যুই শেষ নয়…’ রক্তের দাগে লেখা সেই অশুভ বার্তা মহাদেবের মনে এক গভীর ছাপ ফেলেছিল। ভাঙা বাড়ির সেই অশরীরী ফিসফিসানি আর হিমশীতল অনুভূতি তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। সে জানত, এই বাড়ির প্রতিটি দেয়াল যেন কোনো এক অন্ধকার অতীতের সাক্ষী। ডায়েরিতে দেবজ্যোতির কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছিল—তার মৃত্যু, তার যন্ত্রণা। মহাদেবের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বলছিল, এই বাড়ির ভেতরেই লুকিয়ে আছে সেই রহস্যের চাবিকাঠি, যা দেবজ্যোতির অপমৃত্যুর কারণ উন্মোচন করবে।

মহাদেব সাবধানে ঘরের ভেতর হাঁটতে লাগল। প্রতিটি কোণে তার চোখ, সে খুঁজছিল কোনো গোপন পথের সন্ধান। পুরোনো আসবাবপত্র, ভাঙা কাঁচ, আর ধুলায় ঢাকা জিনিসপত্র সরিয়ে সে খুঁটিয়ে দেখছিল দেয়াল, মেঝে। একসময় তার নজর গেল ঘরের এক কোণে, যেখানে একটা আলমারি দেয়ালের সাথে অদ্ভুতভাবে মিশে আছে। আলমারির পাল্লা নেই, কেবল একটা ফাঁকা গহ্বর। মহাদেব আলমারির পাশ দিয়ে দেয়ালটা স্পর্শ করল, আর তখনই তার মনে হলো, দেয়ালের একটা অংশ যেন অন্য জায়গার চেয়ে কিছুটা ফাঁপা।

কৌতূহলবশত মহাদেব আলমারির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেয়ালের সেই অংশে চাপ দিল। একটা মৃদু ঘর্ষণের শব্দ হলো, আর তারপরেই অপ্রত্যাশিতভাবে দেয়ালের একটা ছোট অংশ ভেতরের দিকে সরে গেল। একটা সংকীর্ণ, অন্ধকার কুঠুরির প্রবেশপথ উন্মোচিত হলো। স্যাঁতসেঁতে বাতাস আর পুরোনো লোহার গন্ধ বেরিয়ে এল সেখান থেকে।

মহাদেব তার মোবাইলের আলো জ্বেলে কুঠুরির ভেতরে উঁকি দিল। অন্ধকার এতটাই গাঢ় ছিল যে প্রথমে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। মোবাইল এগিয়ে নিতেই তার আলো পড়ল কুঠুরির মেঝেতে পড়ে থাকা কিছু পুরোনো জিনিসপত্রের ওপর। কিছু ভাঙা বাক্স, ছেঁড়া কাগজপত্র—আর ঠিক সেগুলোর মাঝে, একটা মোটা, কালো রঙের দড়ি। দড়িটা অন্য সবকিছুর চেয়ে আলাদা দেখাচ্ছিল, যেন তার ভেতরে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ শক্তি লুকিয়ে আছে।
মহাদেব বুঝতে পারছিল না কেন, কিন্তু তার মন তাকে সেই দড়িটার দিকেই ঠেলে দিচ্ছিল। এক শীতল অনুভূতি তার হাত বেয়ে নেমে এল যখন সে দড়িটা হাতে নিল। দড়িটা বেশ মোটা, পুরোনো আর শক্ত, আর তার গাঁটগুলো যেন কোনো ভারী জিনিসের চাপ সহ্য করেছে বহুবার।

যেই না দড়িটা স্পর্শ করল, অমনি মহাদেবের গলায় এক অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হলো! মনে হলো যেন অদৃশ্য কোনো ফাঁস তার গলা টিপে ধরছে। সে নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না, তার চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সে কুঠুরির ভেতরেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, দড়িটা তার হাত থেকে পড়ে গেল না।

ঠিক সেই মুহূর্তে, মহাদেবের চোখের সামনে ভেসে উঠল এক ভয়ংকর দৃশ্য। যেন কুঠুরির অন্ধকার দেয়ালগুলো এক লহমায় স্বচ্ছ হয়ে গেল, আর সে নিজেকে আবিষ্কার করল এক অন্য সময়ে, অন্য এক ঘটনার সাক্ষী হিসেবে। তার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল এক করুণ চিত্র। সে দেখল, দেবজ্যোতিকে! তার মুখ ফ্যাকাশে, চোখে ভয় আর অসহায়তা। তার চারপাশে কয়েকজন মানুষের অস্পষ্ট অবয়ব, যারা দেবজ্যোতিকে জোর করে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। দেবজ্যোতি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার শক্তি ফুরিয়ে আসছে।

এরপরের দৃশ্য আরও বিভীষিকাময়। মহাদেব দেখল, দেবজ্যোতিকে একটা ফাঁসিকাঠের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অদৃশ্য মানুষেরা তাকে ফাঁসির দড়ির নিচে দাঁড় করাল। দেবজ্যোতির চোখে তখন মৃত্যুর ভয়, কিন্তু তার মুখে এক অদ্ভুত স্থিরতা। তাকে জোর করে দড়ি পরানো হলো। মহাদেব অনুভব করতে পারছিল দেবজ্যোতির শ্বাসকষ্ট, তার শেষ মুহূর্তের ছটফটানি। তার নিজের গলাতেও সেই যন্ত্রণার তীব্রতা অনুভব হচ্ছিল, যেন সেই দড়িটা আজও তার গলায় আটকে আছে।

দৃশ্যটা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল, যেমনটা এসেছিল। মহাদেব হাঁপাতে হাঁপাতে মেঝেতে পড়ে রইল, তার গলা ধরে অসহ্য ব্যথায় সে কাতরাচ্ছিল। তার শরীর ঘামে ভিজে গেছে, হৃদপিণ্ড প্রচণ্ড বেগে ধুকপুক করছে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারল, এটা কোনো সাধারণ দড়ি নয়। এটা ছিল দেবজ্যোতির ফাঁসির রশি, আর সেই রশি স্পর্শ করার ফলেই সে দেবজ্যোতির শেষ মুহূর্তের সেই ভয়াবহ যন্ত্রণা আর মৃত্যুকে নিজের চোখে দেখতে পেল, নিজের শরীরে অনুভব করল।

মৃত্যুই শেষ নয়… রক্তের দাগে লেখা সেই কথাটা যেন এখন আরও বেশি অর্থবহ মনে হলো। দেবজ্যোতির আত্মা হয়তো আজও এই বাড়িতে বন্দি, তার অপমৃত্যুর বিচার চাইছে। মহাদেব বুঝল, সে কেবল একটা রহস্যের সমাধান করতে আসেনি, সে এসেছে একটা আত্মাকে মুক্তি দিতে।

ষষ্ঠ অধ্যায়: আত্মার আবেশ

ফাঁসির রশি স্পর্শ করার পর মহাদেবের শরীর আর মন যেন এক নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। দেবজ্যোতির শেষ মুহূর্তের সেই বিভীষিকাময় দৃশ্যের ঘোর তার কাটছিল না। কোনোমতে ভাঙা বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে তার ফ্ল্যাটের দিকে রওনা হলো, তার মনে তখন এক অদ্ভুত আতঙ্ক আর অস্থিরতা। দেবজ্যোতির অপমৃত্যুর যন্ত্রণা যেন তার প্রতিটি শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে।

ফ্ল্যাটে ফিরে মহাদেব যেন আরেক দফা ধাক্কা খেল। তার লেখার টেবিলে রাখা সমস্ত বই, তার যত্নে সাজানো পাণ্ডুলিপি, প্রতিটি পাতায় পাতায় রক্তের গাঢ় দাগ! কালচে লাল রঙের সেই দাগগুলো যেন শুকিয়ে যাওয়া রক্তেরই প্রতিচ্ছবি। মহাদেব নিশ্চিত ছিল, সে যখন বেরিয়েছিল তখন বইগুলো একদম ঠিক ছিল। এই রক্ত কোত্থেকে এলো? তার মনে পড়ল ভাঙা বাড়ির দেওয়ালে লেখা সেই অশুভ বার্তা—”মৃত্যুই শেষ নয়…”। তবে কি দেবজ্যোতির আত্মা তাকে অনুসরণ করে এখানেও চলে এসেছে?

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফ্ল্যাটের ভেতরের পরিবেশ আরও থমথমে হয়ে উঠল। বাইরে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, আর ভেতরে মহাদেবের বুক ধড়ফড়ানি। সে যত শান্ত থাকার চেষ্টা করছিল, দেবজ্যোতির আত্মার উপস্থিতি যেন ততটাই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ঘরের প্রতিটি কোণায় যেন এক অদৃশ্য উপস্থিতি টের পাচ্ছিল মহাদেব। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, তার কানের পাশ দিয়ে কেউ ফিসফিস করে কিছু বলছে, আবার কখনো মনে হচ্ছিল, তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। একটা ঠান্ডা বাতাস যেন ঘরের মধ্যে অনবরত বয়ে যাচ্ছিল, অথচ সব জানালা বন্ধ।

মহাদেব ঠিক করল, আজ আর লেখার চেষ্টা করবে না। তার মন অস্থির, সে ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুম আর আসে না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যেন তার চোখ লেগে গেল।

স্বপ্নটা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট, যেন বাস্তবের চেয়েও বেশি জীবন্ত। মহাদেব দেখল, সে সেই ভাঙা বাড়ির কুঠুরির ভেতরেই রয়েছে। চারপাশ অন্ধকার, কিন্তু একটা আবছা আলোর উৎস থেকে দেবজ্যোতির অবয়ব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দেবজ্যোতি তার সামনে দাঁড়িয়ে, তার মুখটা ফ্যাকাশে, চোখে এক গভীর বিষাদ। তার পরনে ছেঁড়া পুরোনো পোশাক, গলায় তখনও যেন ফাঁসির দড়ির কালচে দাগ স্পষ্ট। তার চোখের দৃষ্টিতে ছিল এক তীব্র আর্তি, যেন সে মহাদেবের কাছে কিছু বলতে চাইছে।

দেবজ্যোতি মুখ খুলল। তার কণ্ঠস্বর ছিল ভাঙা, যন্ত্রণাকাতর, কিন্তু তার প্রতিটি শব্দ মহাদেবের কানে পরিষ্কারভাবে বাজছিল: “আমার কাহিনী শেষ করো… আমাকে মুক্তি দাও…”

কথাগুলো যেন কুঠুরির প্রতিটি দেয়াল থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, মহাদেবের মনের গভীরে গেঁথে যাচ্ছিল।

দেবজ্যোতির চোখ স্থিরভাবে মহাদেবের দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন তার অন্তরের সবটুকু যন্ত্রণা সেই দৃষ্টিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। মহাদেব অনুভব করল, দেবজ্যোতির আত্মা গভীর অতৃপ্তিতে ভুগছে, আর সেই অতৃপ্তি একমাত্র তারই লেখার মাধ্যমে শেষ হতে পারে।

এরপর দেবজ্যোতির অবয়ব যেন আরও গাঢ় হলো, তার কণ্ঠস্বর আরও জোরদার হলো, তাতে মিশে ছিল এক তীব্র হুঁশিয়ারি: “নইলে তুমিও চলে যাবে আমার মতো…!” এই কথাগুলো শুনে মহাদেবের বুকটা কেঁপে উঠল। তার শরীর ঘামে ভিজে গেল। দেবজ্যোতির চেহারা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল অন্ধকারে, কিন্তু তার শেষ কথাগুলো মহাদেবের কানে অনুরণিত হচ্ছিল।

ধড়ফড় করে ঘুম ভেঙে গেল মহাদেবের। সে বিছানায় উঠে বসল, তার হৃদপিণ্ড তখনো প্রচণ্ড বেগে ধুকপুক করছে। সারা শরীর কাঁপছে ভয়ে। সে বুঝতে পারল, এটা কোনো সাধারণ স্বপ্ন ছিল না। দেবজ্যোতির আত্মা তাকে সত্যিই সাবধান করে দিয়েছে। তার কাহিনী শেষ না করলে মহাদেবও একই পরিণতি ভোগ করবে। এখন মহাদেবের সামনে শুধু একটা পথ খোলা—দেবজ্যোতির অপূর্ণ কাহিনীকে সম্পূর্ণ করা, তাকে মুক্তি দেওয়া, এবং নিজের জীবন বাঁচানো।

সপ্তম অধ্যায়: সত্যের মুখ

দেবজ্যোতির স্বপ্ন আর তার শেষ হুঁশিয়ারি মহাদেবকে আর এক মুহূর্তও স্থির থাকতে দিল না। তার মনে হয়েছিল, দেবজ্যোতির আত্মা মুক্তি না পেলে সে নিজেও এই অশরীরী আবেশ থেকে মুক্তি পাবে না। সে জানত, দেবজ্যোতির অকালমৃত্যুর পেছনে একটা বড় রহস্য লুকিয়ে আছে, যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এই আত্মার শান্তি নেই। সেই রাতেই, ভোরের আলো ফোটার আগেই, মহাদেব নিজেকে গবেষণায় ডুবিয়ে দিল।

সে পুরোনো সংবাদপত্র, ঐতিহাসিক দলিল, এবং ব্রিটিশ আমলের রেকর্ড ঘাঁটতে শুরু করল। গ্রন্থাগারের নীরব পরিবেশেও তার মনে হচ্ছিল দেবজ্যোতির ফিসফিসানি তার পিছু ছাড়ছে না। দীর্ঘ গবেষণা আর অদম্য জেদের পর মহাদেব এক ভয়ঙ্কর সত্য জানতে পারল: দেবজ্যোতিকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে, আত্মহত্যার নাটক সাজিয়ে! সে ব্রিটিশ সরকারের এক গোপন ষড়যন্ত্রের কথা জেনে ফেলেছিল, যা সাম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারত। দেবজ্যোতি সেই ষড়যন্ত্রের কথা তার শেষ উপন্যাসে তুলে ধরতে চেয়েছিল, কিন্তু তার আগেই তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

মহাদেব বুঝতে পারল, দেবজ্যোতির সেই অপ্রকাশিত উপন্যাসটিই এই রহস্যের চাবিকাঠি। সেই পাণ্ডুলিপি যদি প্রকাশিত হয়, তবেই দেবজ্যোতির আত্মা মুক্তি পাবে। তার একমাত্র লেখা উপন্যাসটি হয়তো কোনো অন্ধকার স্থানে লুকিয়ে আছে, যা ব্রিটিশরা কোনোদিন আলোতে আসতে দেয়নি। এই চিন্তায় মহাদেব মরিয়া হয়ে সেই পাণ্ডুলিপির খোঁজে লেগে পড়ল।

প্রথমেই তার মনে পড়ল দেবজ্যোতির ভাঙা বাড়ির কথা। হয়তো সেখানেই লুকিয়ে আছে সেই অমূল্য পাণ্ডুলিপি। মহাদেব আবারও সেই পুরোনো বাড়ির দিকে রওনা হলো। এবার তার মনে ভয় ছিল না, ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। ভাঙা বাড়ির সেই কুঠুরিতে ঢুকল যেখানে সে ফাঁসির দড়ি পেয়েছিল। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল প্রতিটি কোণ, প্রতিটি ভাঙা আসবাবপত্র। মনে হচ্ছিল যেন দেবজ্যোতির আত্মা তাকে পথ দেখাচ্ছে, প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে সাহায্য করছে।

হঠাৎ মহাদেবের চোখ পড়ল একটা পুরোনো কাঠের সিন্দুকের দিকে, যা ধুলো আর মাকড়সার জালে ঢাকা। সিন্দুকটা এতোই পুরোনো যে মনে হচ্ছিল স্পর্শ করলেই ভেঙে পড়বে। অনেক কষ্টে সে সিন্দুকের ঢাকনা খুলল। ভেতরে কয়েকটি পুরোনো পোশাক আর তার নিচে কিছু জীর্ণ কাগজপত্র। মহাদেব দ্রুত সেগুলোকে সরিয়ে ফেলল। ঠিক তার নিচেই একটা মোটা, কালো কাপড়ে মোড়ানো পাণ্ডুলিপি। মহাদেবের হৃদপিণ্ড প্রচণ্ড বেগে ধুকপুক করে উঠল—এটাই কি দেবজ্যোতির শেষ লেখা উপন্যাস? পাণ্ডুলিপিটা হাতে নিতেই মহাদেবের মনে এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এল। সে বুঝল, তার অনুসন্ধান সফল হয়েছে। সে যখন সেই পাণ্ডুলিপিটা খুলতে যাবে, ঠিক তখনই এক অদৃশ্য শক্তি তাকে সজোরে আঘাত করল! মহাদেব ছিটকে পড়ল মেঝেতে। তার হাত থেকে পাণ্ডুলিপিটা ফসকে গেল।
সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই, এক অদৃশ্য হাত তার গলা টিপে ধরল! মহাদেব শ্বাস নিতে পারছিল না, তার চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। মনে হচ্ছিল যেন কেউ তার গলা টিপে শ্বাসরোধ করতে চাইছে, তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে। তার পুরো শরীরে তীব্র ব্যথা হচ্ছিল, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তাকে চেপে ধরেছে। মহাদেব বুঝতে পারল, এটা কেবল দেবজ্যোতির অতৃপ্ত আত্মা নয়, যারা দেবজ্যোতিকে মেরেছিল, তাদের অশুভ ছায়াও এই বাড়ির সাথে জড়িত। তারা চায় না এই সত্য কোনোদিন প্রকাশ পাক।

মহাদেব প্রাণপণে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু অদৃশ্য হাতের বাঁধন এতোই শক্ত ছিল যে তার শরীর অবশ হয়ে আসছিল। তার চোখ অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করল। সে অনুভব করতে পারল, এই মুহূর্তে যদি সে পাণ্ডুলিপিটা ছেড়ে দেয়, তবেই হয়তো এই অদৃশ্য শক্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে। কিন্তু সে জানত, পাণ্ডুলিপিটা না পেলে দেবজ্যোতির আত্মা কোনোদিনও মুক্তি পাবে না, আর হয়তো সে নিজেও।

অষ্টম অধ্যায়: মুক্তি

অদৃশ্য হাতের সেই শ্বাসরোধকারী আক্রমণে মহাদেব প্রায় জ্ঞান হারাতে বসেছিল। তার ফুসফুস অক্সিজেনের জন্য ছটফট করছিল, চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসছিল। কিন্তু দেবজ্যোতির সেই শেষ কথাগুলো, “নইলে তুমিও চলে যাবে আমার মতো…” তার কানে বারবার বাজছিল। সে জানত, এই পাণ্ডুলিপিটা তার নিজের জীবনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এটা শুধু দেবজ্যোতির কাহিনী ছিল না, ছিল এক ঐতিহাসিক সত্যের উন্মোচন।
সমস্ত শক্তি এক করে মহাদেব শেষবারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা পাণ্ডুলিপিটার দিকে সে হাত বাড়াল। অদৃশ্য শক্তি তাকে আরও জোরে চেপে ধরল, কিন্তু মহাদেব হাল ছাড়ল না। তার আঙ্গুলগুলো কোনোমতে পাণ্ডুলিপিটা স্পর্শ করল। যেই না সে পাণ্ডুলিপিটা মুঠোয় ধরল, অমনি যেন সেই অদৃশ্য হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। মহাদেব হাঁপাতে হাঁপাতে মেঝেতে পড়ে গেল, তার গলা ধরে তখনো তীব্র ব্যথা। কিন্তু তার হাতে দেবজ্যোতির অমূল্য পাণ্ডুলিপিটা শক্ত করে ধরা ছিল।
ধীরে ধীরে সেই ভাঙা বাড়ির ভেতর থেকে এক অদ্ভুত শান্তি ছড়িয়ে পড়ল। অশরীরী ফিসফিসানি থেমে গেল, বাতাস শান্ত হয়ে এল। মনে হলো যেন দেবজ্যোতির আত্মা অবশেষে মুক্তি পেয়েছে। মহাদেব বুঝতে পারল, তার কাজ শেষ হয়েছে। সে পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে দ্রুত সেই ভাঙা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।

ফ্ল্যাটে ফিরে আসার পর মহাদেব এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফ্ল্যাটের ভেতরের থমথমে ভাবটা উধাও হয়ে গেল। কোনো ফিসফিসানি নেই, কোনো শীতল অনুভূতি নেই। বাতাস যেন বিশুদ্ধ হয়ে গেছে। মনে হলো যেন বহুদিনের জমে থাকা ধুলো আর অন্ধকার কেটে গেছে। মহাদেব দ্রুত দেবজ্যোতির সেই পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে কাজ শুরু করল। দিনের পর দিন সে নিজেকে লেখার মধ্যে ডুবিয়ে রাখল, দেবজ্যোতির অপূর্ণ কাহিনীকে সম্পূর্ণ করল, তার জীবনের শেষ মুহূর্তের যন্ত্রণা আর তার আবিষ্কার করা সেই ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরল।

অবশেষে, বহু প্রতীক্ষার পর সেই উপন্যাসটি প্রকাশিত হলো। বইয়ের প্রচ্ছদে লেখক হিসেবে মহাদেবের নাম লেখা। বইটি বাজারে আসার পরপরই পাঠক মহলে এক দারুণ সাড়া ফেলে দিল। দেবজ্যোতির মতো একজন ঐতিহাসিক চরিত্রের এমন করুণ পরিণতি এবং তার অপ্রকাশিত সত্যের উন্মোচন মানুষকে হতবাক করে দিল। বইটি বেস্ট সেলারের তালিকায় চলে এল, আর মহাদেব রাতারাতি এক পরিচিত লেখক হয়ে উঠল।

একদিন মহাদেব একটি জনপ্রিয় সাহিত্য ম্যাগাজিন পড়ছিল। সেখানে তার প্রকাশিত উপন্যাসটির একটি রিভিউ লেখা হয়েছে। রিভিউটি অত্যন্ত প্রশংসাসূচক ছিল, কিন্তু শেষ লাইনটা মহাদেবের চোখে আটকে গেল। রিভিউয়ার যেন এক গভীর রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
সেখানে লেখা ছিল:

“এই উপন্যাসের লেখক কে? মহাদেব নাকি… দেবজ্যোতি?”

মহাদেব চমকে উঠল। রিভিউয়ার কি তবে কিছু বুঝতে পেরেছে? নাকি এটা শুধু লেখকের লেখার গভীরতার প্রশংসা? সে জানত, এই উপন্যাসে তার নিজের কলম চললেও, এর আত্মা ছিল দেবজ্যোতির। এই লাইনটা পড়ার পর মহাদেব এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি অনুভব করল। একদিকে ছিল মুক্তির আনন্দ, অন্যদিকে ছিল এক নতুন রহস্যের ছোঁয়া। হয়তো দেবজ্যোতির আত্মা সত্যি সত্যিই তার লেখার মধ্য দিয়ে মুক্তি পেয়েছে, আর সেই মুক্তি এতটাই গভীর যে পাঠকও তা অনুভব করতে পারছে। মহাদেব হাসল। হয়তো এই রহস্যই তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

শেষ

ছবি এআই

© পিনাকী রঞ্জন পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *