পিনাকী রঞ্জন পাল
১৮৫৯ সালের ২৪ জুন উত্তর ইতালির সোলফেরিনো নামক একটি গাঁয়ের কাছে অস্ট্রিয়ার রাজকীয় বাহিনী এবং ফ্রাঙ্কোসার্ডিনিয়ার মৈত্রী জোটের মধ্যে সারাদিনব্যাপী ভীষণ যুদ্ধ হয়। এই ভয়াবহ যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা ছিল বিপুল। প্রায় ৪০ হাজার জন নিহত, আহত বা নিখোঁজ হয়েছিল। সে আমলে মিলিটারি মেডিক্যাল সার্ভিস বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। ফলে যন্ত্রণাকাতর আহতের আর্তনাদে তিষ্টোনো কষ্টকর হয়ে উঠলো এবং সেবা যত্নের অভাবে আহতদের অনেকেরই মৃত্যু হল। আহত শতশত সৈনিকদের করুণ আর্তনাদ সেই যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী সুইস যুবক হেনরী ডুনান্টকে (Henry Dunant) অভিভূত করে, বিচলিত করে। তিনি স্থানীয় মানুষদের সহায়তায় কাস্তিগওলিওনের গির্জায় আহতদের সেবাযত্নে তৎপর হলেন। সেই সময় মানব প্রেমিক ডুনান্ট সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে আহত সৈনিকদের সেবার জন্য একটি স্থায়ী সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। আন্তরিক প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায় থাকলে যে মহৎ কাজে সফলতা পাওয়া যায় হেনরী ডুনান্ট তা প্রমাণ করলেন।
জেনিভাতে নিজের বাড়ি ফিরে এসে সেই যুদ্ধের অভিজ্ঞতার ওপরে একখানি বই লিখলেন। তাঁর ‘সোলফেরিনো স্মৃতি’ (Memory of Solferino) ১৮৬২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং ইউরোপময় দারুণ সাড়া ফেলেছিল। এই বই এর ভাবনা চিন্তার উদ্দেশ্যকে বাস্তবে রূপায়ণে সহায়তার জন্য জেনিভার চারজন নাগরিক এগিয়ে এলেন। এঁরা হলেন—গুস্তাভ মোইনিয়ার, জেনারেল গিলাউমে হেনরি, দ্যুফোর, ডাঃ লুই অ্যাপ্পিয়া এবং ডাঃ থিওডোর মৌনেয়র। তাদের সহযোগিতায় ডুনান্ট গঠন করলেন ১৮৬৩ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিটি ফর রিলিফ টু দি উন্ডেড’। পরে এই প্রতিষ্ঠানই ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দি রেডক্রস’ (আই সি আর সি) নামে পরিচিত হয়। সেই ১৮৬৩ সালেই রেডক্রস আন্দোলনের প্রতীক চিহ্ন হিসাবে সাদা জমির ওপর লাল ক্রস চিহ্নকে গ্রহণ করা হয়।
ভূমিষ্ঠ হল রেডক্রস (Red Cross)। রেডক্রস আন্দোলনের জনক হেনরী ডুনান্টের চিন্তাধারার মূল তত্ত্বটি হল—মানুষের মর্যাদাকে সব সময় শ্রদ্ধা সহকারে মানতে হবে এমনকি যুদ্ধের সময়েও এই মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকা চাই। প্রতি বছর হেনরী ডুনান্টের জন্মদিন ৮ মে তারিখে পৃথিবীর সর্বত্রই পালিত হয় বিশ্ব রেডক্রস দিবস এবং রেড ক্রেসেন্ট দিবস। ভারতে ১৯২১ সালে ভারতীয় রেডক্রস সমিতি গঠন হয়েছিল। গত ১০১ বছর ধরে ভারতীয় রেডক্রস সমিতির বিভিন্ন শাখা ত্রাণ, সেবা, সাহায্য এবং অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজে লিপ্ত রয়েছে। বিশ্বের ১৪৫টির বেশি দেশে আজ রেডক্রস সোসাইটি গড়ে উঠেছে এবং প্রায় ২৫০ মিলিয়নেরও বেশি পূর্ণ সদস্য সংখ্যা রেডক্রসের।
রেডক্রস কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হল এটা তো জানা গেল। কিন্তু এর প্রতিষ্ঠাতা হেনরী ডুনান্ট সম্পর্কে কয়েকটি কথা না লিখলে যে প্রতিবেদনটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
১৮২৮ সালের ৮ মে জেনিভায় হেনরী ডুনাণ্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কুড়ি বছর বয়সে পা দেওয়ার আগে থেকেই তিনি সমাজের দুর্দশা কবলিতদের সেবাযত্নে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ১৮৫৫ সালে যে সমিতি স্থাপন করেন, বর্তমানে আমাদের কাছে সেই প্রতিষ্ঠানে ওয়াই এম সি এ নামে পরিচিত। তখন তাঁরা তার নাম দিয়েছিলেন দি ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স অব ইয়ং মেনস কৃশ্চান অ্যাসোসিয়েশনস। জীবিকা অর্জনের উদ্দেশ্যে ডুনান্ট একটি ব্যাঙ্কে ব্যবসাপত্র শেখেন।
১৮৬৭ সালটা ছিল তাঁর সবচেয়ে মারাত্মক বছর। গত চার বছর যাবৎ, দেখাশোনার অভাবে তাঁর আলজিরিয়ার ব্যবসা নষ্ট হতে বসেছে। জেনিভা ব্যাঙ্ক—তিনি যার একজন ডিরেক্টর–দেউলিয়া হল। আর ডুনান্ট স্বয়ং প্রায় মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ (প্রায় ১ কোটি টাকা) দেনায় জড়িয়ে পড়লেন। নিজের এই চরম দুরবস্থা সত্ত্বেও ১৮৭০ সালে ফ্রান্স আর প্রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বাঁধলে ডুনান্ট আহতদের ত্রাণের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
আবার শান্তি ফিরে এল। চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও ডুনান্টের মন আন্তর্জাতিক সালিশ-সুপারিশের মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসার উপায় এবং যুদ্ধে বন্দিদের সুরক্ষার্থে আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নের ধ্যানে সর্বদাই সক্রিয়। প্যারিসে তাঁর বক্তব্য শোনার গরজ কেউ দেখায়নি। তাই ডুনান্ট চলে যান ইংল্যান্ডে। যুদ্ধে বন্দিদের স্বপক্ষে বিধি বিধান রচনা করার প্রকল্পটি বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য ডুনান্ট চরম দারিদ্র্যের কামড় অগ্রাহ্য করে প্রাণপাত পরিশ্রম করেছিলেন দু’বছর ধরে। এরপরে তাঁকে আশাস, জার্মানি, ইতালির যত্রতত্র ভবঘুরের মতো অস্থিরভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। অবশেষে হাইডেনের ছোট্ট এক হাসপাতালে দারিদ্র্য লাঞ্ছিত এক বৃদ্ধাকে আবিষ্কার করেন এক জার্মান সাংবাদিক।
এতদিনে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার জন্য পৃথিবী তৎপর হয়ে উঠল। মানবজাতিকে তিনি সেবা দিয়ে এসেছেন, তার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯০১ সালে প্রথম নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হল প্রি দ্য মস্কৌ দেওয়া হল। জার্মানিতে একটি পাবলিক চাঁদার তহবিল খোলা হল এবং অন্যান্য দেশ সাহায্যে এগিয়ে এল। কিন্তু ডুনান্ট এসব কিছুই চান না। সম্মান এবং খ্যাতির প্রতি উদাসীন ডুনান্ট দর্শনার্থীদের পরিহার করে আন্তর্জাতিক সালিশী এবং শান্তির সংগ্রামের ব্রতে মগ্ন রইলেন। অনেক দেরিতে যে বিপুল ধনসম্পদ এসেছে তাঁর হাতে, সেগুলো তিনি সুইজারল্যান্ড ও নরওয়ের দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করে দেন। ১৯১০ সালের ৩০ অক্টোবর এই মহান মানব প্রেমিকের মৃত্যু হয়।
Photo Credit- Google.