অরুণ কুমার : প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের অবস্থা ক্রমশ যেদিকে গড়িয়ে চলেছিল তাতে আন্তর্জাতিক মহল অন্যরকম আশঙ্কায় ছিলেন কিন্তু বাস্তবে ঘটে গেল অন্য কিছু।
বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতা বদল না করার এই যে বাতাবরণ, ঘটনাচক্রে ইমরান যার সাক্ষী থাকলেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও কম বড় কথা নয়। পাকিস্তান দেশটার পক্ষে তো এটা স্রেফ ইতিহাস।
যে কোনও ক্ষেত্রের বিরোধীদের সঙ্গে লড়ে বরাবর তিনি জয়লাভ করেছেন, তা সে ক্রিকেট মাঠ হোক বা রাজনীতির ময়দান। যে বছর বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দেন দেশকে সে বছর দেশের মধ্যেই নানা মহলের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছিলেন। বিরোধিতা করেছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বেনজির ভুট্টো। কিন্তু সেবার দেশকে তিনি শুধু নেতৃত্বই দেননি, জিতেছিলেন কাপও। এটাও ইতিহাস। এই নামটা হলো ইমরান খান নিয়াজী। প্রতিষ্ঠান দিয়ে তাঁকে মাপা যায় না। কেননা, বরাবরের প্রতিষ্ঠান বিরোধী তিনি। অথচ ভাগ্যের কী খেলা– তিনি বরাবর সেই প্রতিষ্ঠানেই স্থিত, তা সে ক্রিকেটেই হোক, কিংবা রাজনীতিতে। আর এবার পাকিস্তানের রাজনীতিতেও দেখা গেল লড়াকু ইমরানেরই ছবি।
যে সময়ে মনে করা হয়েছিল পাকিস্তানে শেষ হতে বসেছে ইমরান-যুগ, ঠিক সেই সময়েই এক প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলশ্রুতিস্বরূপ পাকিস্তানকে ভোটের দিকে যেতে দেখা গেল। যা বহমান পাক-রাজনীতির ঐতিহ্যের বিপরীত। রীতিমত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন তিনি।এখানেও ইমরানের জয়ই দেখছে সংশ্লিষ্ট মহল। যে দেশে বরাবর সেনাই ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে এমন পরিস্থিতিতে সেখানে দাঁড়িয়ে এই অর্জনটুকু কোন অংশ কম নয়। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব সাংবিধানিক কারণ দেখিয়েই খারিজ করে দিয়েছেন ডেপুটি স্পিকার। ফলে এবার ভোটে যেতে হবে কায়েদ এ আজমের দেশ পাকিস্তানকে।
গত সপ্তাহের শেষদিকে ৪৮ ঘন্টা হাই ভোল্টেজে
সরগরম ছিল পাক-রাজনীতি। রবিবারই ইমরানের বিরুদ্ধে পেশ করা অনাস্থা প্রস্তাবে ভোট হওয়ার কথা ছিল। তবে অধিবেশন শুরু হলে ডেপুটি স্পিকার অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল করেন। তিনি জানান, অনাস্থা প্রস্তাব দেশের সংবিধান বিরুদ্ধ ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও তা ঝুঁকি তৈরি করছে।ডেপুটি স্পিকারের এই ঘোষণার পরই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি বলেন– সরকারের পতনের জন্য যে চক্রান্ত করা হচ্ছিল, তা ভেস্তে দেওয়া হয়েছে। আপনারাই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন, কোনও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা বিদেশিরা নয়। প্রেসিডেন্টের কাছে সংসদ ভেঙে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছি। গণতান্ত্রিক পথেই দেশের শাসন চলুক। আপনারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত থাকুন।
এদিকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে পাক সংসদ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি। সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়েছে আগামী ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন করতে হবে। ফলে সাময়িক স্বস্তি পেয়েছেন পাক ক্রিকেটের রাজপুত্র তথা বর্তমানে পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে এর আগে,
ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে সরাতে বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল। রবিবার পাক সংসদে তা খারিজ করে দেওয়া হয়। এরপরই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। সেখানেই তিনি জানান, প্রেসিডেন্টের কাছে অধিবেশন ভেঙে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের দায়িত্ব যাতে দেশবাসীর উপরই দেওয়া হয়, এজন্য দ্রুত নির্বাচনের দাবিও জানান তিনি। ইমরানের সেই দাবিকে মান্যতা দিয়েই ভেঙে দেওয়া হয়েছে পাক সংসদ। এবং সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়েছে আগামী ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন করতে হবে সে দেশে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ইতিহাসের এ যেন টানটান উত্তেজনার মধ্যে প্রতি মুহূর্তের নাটকীয় মোড়। অনাস্থা ভোট চলাকালীন প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেওয়ার আর্জি জানান। সেই পরামর্শ মতো ঘোষণা করেছেন পাক প্রেসিডেন্ট। সেইমতো ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভেঙে দিলেন তিনি।
এই সময়কালে ইমরানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা -ভোটটাই হয় নি পাকিস্তানের ন্যশনাল অ্যাসেম্বলিতে। অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে অ্যাসেম্বলিতে যখন আলোচনা চলছে, সেই সময় পাক প্রধানমন্ত্রী চলে গিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভির কাছে। প্রস্তাব দেন, অ্যাসেম্বলি ভেঙে দিতে। যাতে নতুন করে ভোট হয় দেশে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা করেন আরিফ।
ইমরানই আপাতত দেশের তদারকি প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন নাকি অন্য কেউ। সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে পাকিস্তানে। এদিকে অনাস্থা- ভোট হলে হার যে নিশ্চিত, বুঝে গিয়েছিলেন আগেই। জল্পনা চলছিল, সেই হারের আগে তিনি নিজে থেকেই ইস্তফা দিয়ে দেন কি না। কিন্তু ইমরান খান তা করেননি। উল্টে, বিরোধীদের নিশ্চিত জয়ের অঙ্ক মোক্ষম চালে থমকে দিলেন এক্কেবারে শেষ মুহূর্তে। বোঝা গেল, বিরোধীদের গদি দখলের যাত্রাভঙ্গ করতে গত কয়েক দিন ধরেই নিজের বোলিং স্ট্র্যাটেজি গুছিয়ে নিচ্ছিলেন প্রাক্তন এই পেশ বোলার। জোরে বোলার হলেও ইমরানের মধ্যে স্পিনারের ধূর্ততাও রয়েছে। এটা প্রমাণ হল এবারের হাই ভোল্টেজ রাজনীতির খেলাতেও।যে রাজনৈতিক অস্থিরতা গত বেশ কয়েক দিন ধরে শিরোনামে রেখেছে পাকিস্তান তথা ইমরান খানকে, তার আপাত-সমাপ্তি ঘটল নাটকীয় ভাবেই।
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে এসে জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দেন ইমরান সেখানে দেশবাসীকে ভোটের জন্য তৈরি হতে বলেন। আরও বললেন, ‘‘ঘবড়ানা নেহি হ্যায়। ঈশ্বর উপর থেকে পাকিস্তানের উপর নজর রেখে চলেছেন।’’ তাঁর দাবি, ঈশ্বর দেখছেন কী ভাবে তাঁর সরকার ফেলতে বিরোধীরা পাকিস্তানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। এর পর ইমরানকে বলতে শোনা যায়, দেশবাসীই স্থির করুন, তাঁরা কাকে ক্ষমতায় দেখতে চান।
তবে এই আস্থা ভোটকে কেন্দ্র করে সে দেশের একাধিক এলাকায় অশান্তি চলছিল। অশান্তি রুখতে ইসলামাবাদে জারি হয়েছিল ১৪৪ ধারা। এমনটা শোনা গিয়েছিল, গ্রেপ্তার হতে পারেন ইমরান। মেয়াদ শেষ করতে পারলেন না ইমরান। অপরদিকে ,অনাস্থা-প্রস্তাব বাতিল করা প্রসঙ্গে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বিলাবল ভুট্টো জারদারি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। অনাস্থা প্রস্তাবে ভোট দিতে দেয়নি। ঐক্যবদ্ধ বিরোধী দল সংসদ ছাড়ছে না। আমাদের আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছেন।’’
সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পরিস্থিতির ওপর নজরদারি শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার কাসিম খান সুরিও বিরোধীদের ডাকা অনাস্থা প্রস্তাব, ‘অসাংবিধানিক’ তকমা দিয়ে বাতিল করে দেন। তারও আগে বিরোধীরা পাকিস্তান পার্লামেন্টের স্পিকার আসাদ কায়জারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে। তারপরই কায়জারের আসন সামলাতে নিয়মমাফিক সুরি আসেন।
কিন্তু পরবর্তীতে এভাবে তাঁদের অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল হয়ে যাবে, তা বিরোধীরা কল্পনাও করতে পারেননি। অন্যতম বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি অভিযোগ করেছেন, ইমরান খান পাকিস্তানের সংবিধানকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করছেন। এর বিরুদ্ধে তাঁদের জনপ্রতিনিধিরা সুপ্রিম কোর্টে যাবেন।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা ও পাকিস্তানের বিরোধীদের আশা, এক্ষেত্রে পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট সুকৌশলে একটা দরবার করতে পারে। সুপ্রিমকোর্ট বলতে পারে যে এভাবে পার্লামেন্ট মুলতুবি করে দেওয়া অবৈধ। পাশাপাশি, পাকিস্তানের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ না-দেওয়াটাও অসংসদীয়। এটা বলে ফের ভোটাভুটির জন্য চাপ দিতে পারে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট। পাকিস্তানের নিয়ম অনুযায়ী যে কোনও অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে এলে তিন দিনের একটা সময় দিতে হয়। আবার তিন দিনের পর বিরোধীরা একটা অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আবার তিন দিনের পর বিরোধীরা একটা অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে এলে ফের ভোটাভুটির নির্দেশ দিতে পারে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট। আর একটা হতে পারে যে, একটা তদারকি সরকারও সুপ্রিম কোর্ট গঠন করে দিতে পারে। আর, সেটা ইমরান খানের নেতৃত্বে নয়। সব মিলিয়ে বলা যায় যে এখনও ইমরান খান নিয়াজীর সংকট কাটেনি।
তবে আপাতত প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে পটবদল যে ঘটে গেল, সে কথা সত্যি। তার রহস্য লুকিয়ে ইমরানের ব্যক্তিত্বে না অন্য কোথাও তা আগামী দিনে উন্মোচিত হবে। সময়ই বলবে ইমরান আগামী এক পক্ষ অর্থাৎ ১৫ দিন পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি কৌশলে তিনি মোকাবিলা করেন এবং আসন্ন ভোটে জিতবেন না হারবেন এর জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলও সেদিকে তাকিয়ে আছে।
Photo source- ANI official FB page.