হাইড্রোজেন যুগে ভারতের দিগ্বিজয়: পরিবহন খাতে এক নতুন বিপ্লব (ভিডিও সহ)

পিনাকী রঞ্জন পাল : “একদিন স্টিম ইঞ্জিন বিশ্বকে বদলে দিয়েছিল, এরপর এলো ইলেকট্রিক ট্রেনের যুগ। এবার হাইড্রোজেন ফুয়েল প্রযুক্তি নিয়ে ভারত গড়ছে পরিবহনের নতুন দিগন্ত। ৩১ মার্চ ২০২৫—এই দিনটি শুধু ভারতীয় রেলের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে থাকবে। কারণ, ওই দিনই ভারতের মাটিতে গড়াবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হাইড্রোজেন ট্রেনের চাকা।”

ভারত বরাবরই রেল ব্যবস্থায় অগ্রগামী। স্টিম ইঞ্জিন থেকে ডিজেল, ডিজেল থেকে ইলেকট্রিক—প্রযুক্তির প্রতিটি ধাপে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে ভারতীয় রেল। এবার সেই রেল ব্যবস্থায় যুক্ত হচ্ছে হাইড্রোজেন ট্রেন। চেন্নাইয়ের ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরিতে (ICF) চলছে ভারতের প্রথম হাইড্রোজেন ট্রেন তৈরির শেষ পর্যায়ের কাজ।

বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকটি দেশ হাইড্রোজেন ট্রেন চালাতে সক্ষম হলেও, ভারতের নির্মিত ট্রেনের ক্ষমতা তাদের থেকে অনেক বেশি। সাধারণত অন্যান্য দেশের হাইড্রোজেন ট্রেনের ইঞ্জিন ৫০০-৬০০ হর্সপাওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন, অথচ ভারতের তৈরি এই ট্রেনের ইঞ্জিন ১২০০ হর্সপাওয়ার, যা দ্বিগুণ শক্তিশালী।

প্রাথমিকভাবে এই ট্রেন জিন্দ থেকে সোনিপথ পর্যন্ত ৯০ কিলোমিটার পথ চলবে। ভবিষ্যতে এটি দার্জিলিং হিমালয়ান রেল, নীলগিরি মাউন্টেন রেল, কালকা-সিমলা রেলওয়ে ও কাংড়া ভ্যালি রেলওয়ে রুটে চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

হাইড্রোজেন ট্রেনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো—এটি কোনো দূষণ সৃষ্টি করে না। এর জ্বালানি জল থেকে উৎপন্ন হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন দ্বারা তৈরি বিদ্যুৎ। ফলে ট্রেন চলার পর বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে বের হয় শুধুমাত্র জলীয় বাষ্প ও বিশুদ্ধ জল। অর্থাৎ, এটি পরিবেশবান্ধব, সাশ্রয়ী ও কার্যকরী।

এই ট্রেনের খরচও তুলনামূলকভাবে কম। ডিজেল ও ইলেকট্রিক ট্রেনের তুলনায় এটি অনেক কম খরচে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারবে। এমনকি এর শব্দদূষণও খুব কম, ফলে যাত্রীদের যাত্রা হবে আরও আরামদায়ক।

ভারত সরকার ইতিমধ্যেই ২৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে এই প্রকল্পে। প্রথম ধাপে ৩৫টি হাইড্রোজেন ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে, যা ২০২৫ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ হতে পারে। প্রতিটি ট্রেন নির্মাণে খরচ পড়বে প্রায় ৮০ কোটি টাকা।

সরকারের লক্ষ্য শুধু পরিবেশ রক্ষা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে রেল ভাড়া কমিয়ে আনা। যেহেতু হাইড্রোজেন ট্রেনের অপারেটিং খরচ ডিজেলের তুলনায় অনেক কম, তাই এটি যাত্রীদের জন্যও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হতে চলেছে।

শুধু ট্রেন নয়, হাইড্রোজেন জ্বালানি এখন ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক গাড়িতেও ব্যবহারের দিকে এগোচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে কিছু হাইড্রোজেন চালিত গাড়ি বাজারে এসেছে, যেমন: টয়োটা, হুন্ডাই, হোন্ডা-এর মতো কিছু সংস্থা হাইড্রোজেন কার বাজারে এনেছে।

হাইড্রোজেন কারের প্রধান সুবিধা হলো এটি মাত্র কয়েক মিনিটে রিফুয়েল করা যায়, যেখানে ইলেকট্রিক গাড়ির চার্জ হতে দীর্ঘ সময় লাগে। এছাড়া, একবার সম্পূর্ণ ট্যাঙ্ক ভরলে এটি ৮০০-১০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে, যা বৈদ্যুতিক গাড়ির তুলনায় অনেক বেশি।

তবে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে—
☑️ উচ্চমূল্য: হাইড্রোজেন কার এখনও অত্যন্ত ব্যয়বহুল, যা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
☑️ অবকাঠামোর অভাব: বর্তমানে বিশ্বের খুব কম জায়গায় হাইড্রোজেন ফুয়েলিং স্টেশন রয়েছে।
☑️ উৎপাদন খরচ: হাইড্রোজেন উৎপাদন করতে এখনও প্রচুর বিদ্যুৎ লাগে, যা যদি পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি থেকে না আসে, তাহলে এটি প্রকৃতপক্ষে পরিবেশবান্ধব হবে না।

হাইড্রোজেন প্রযুক্তি ভারী যানবাহন—যেমন ট্রাক, বাস ও বিমানেও ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ভারতে ইতোমধ্যে কিছু সংস্থা হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল চালিত বাস তৈরি করছে, যা পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হচ্ছে।

কিন্তু হাইড্রোজেন ট্রাক বা বাস ব্যাপকভাবে চালু হতে হলে যে সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে:
☑️ হাইড্রোজেন উৎপাদন খরচ কমাতে হবে।
☑️ বিস্তৃত ফুয়েলিং স্টেশন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে।
☑️ প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে খরচ ও কার্যকারিতা বাড়াতে হবে।

হাইড্রোজেন জ্বালানির ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল, বিশেষ করে ভারতে যেখানে পরিবেশ দূষণ কমানো ও জ্বালানি খরচ সাশ্রয়ী করা এখন সরকারের অন্যতম লক্ষ্য।

ভারত শুধু একটি হাইড্রোজেন ট্রেন চালু করছে না, বরং বিশ্বকে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ভবিষ্যতের পরিবহন প্রযুক্তি কী হতে চলেছে। এটি পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিপ্লব, যা ভারতকে সবুজ শক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বনেতৃত্বের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

৩১ মার্চ শুধু একটা দিন নয়, এটি ভারতের পরিবহন ব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। সেই অধ্যায়ের নাম—”হাইড্রোজেন যুগের শুরু”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *