ডিজিটাল ডেস্ক : ভারতের পরিবহণ ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাইপারলুপ প্রযুক্তি। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মেলবন্ধনে জন্ম নেওয়া এই উচ্চগতির ট্রেন কয়েক ঘণ্টার পথ মাত্র মিনিটেই পাড়ি দেবে। সম্প্রতি আইআইটি মাদ্রাজের সহযোগিতায় ভারতের প্রথম হাইপারলুপ ট্র্যাকের সফল পরীক্ষার খবর এসেছে, যা রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
হাইপারলুপ কী এবং কেমন হবে এর গতি?
হাইপারলুপ মূলত একটি লো-প্রেশার টিউবের মধ্যে চলা চৌম্বক শক্তিচালিত ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা, যেখানে বাতাসের বাধা প্রায় নেই বললেই চলে। সাধারণ ট্রেনের মতো একাধিক কামরা নেই, বরং ছোট আকারের একটিমাত্র পডের মাধ্যমে যাত্রী বা পণ্য পরিবহন করা হবে। এই প্রযুক্তির মূল আকর্ষণ এর গতি— যা প্রতি ঘণ্টায় ১১০০-১২০০ কিমি পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।
ভারতের ক্ষেত্রে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরুতে সর্বোচ্চ ৬০০ কিমি প্রতি ঘণ্টার গতিতে হাইপারলুপ চলবে। কিন্তু ভবিষ্যতে এই গতি আরও বাড়ানো হতে পারে।
দিল্লি-জয়পুর: ৩০ মিনিটের যাত্রা?
দিল্লি থেকে রাজস্থানের জয়পুর— ৩৫০ কিলোমিটারের দূরত্ব পাড়ি দিতে সাধারণ ট্রেনে সময় লাগে ৪-৫ ঘণ্টা, কিন্তু হাইপারলুপ চালু হলে এই পথ মাত্র ৩০ মিনিটেই অতিক্রম করা সম্ভব হবে। রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব সম্প্রতি হাইপারলুপ ট্র্যাকের ছবি ও ভিডিও শেয়ার করে জানান, এটি ভারতের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে।
পরীক্ষামূলক হাইপারলুপ ট্র্যাক এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
আইআইটি মাদ্রাজ ও রেল মন্ত্রকের যৌথ উদ্যোগে চেন্নাইয়ের থাইয়ুর ক্যাম্পাসে ৪২২ মিটার দীর্ঘ হাইপারলুপ টেস্ট ট্র্যাক তৈরি করা হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেনটি প্রতি ঘণ্টায় ১০০ কিমি গতিতে ছুটেছে, এবং এখন লক্ষ্য ধাপে ধাপে ৬০০ কিমি প্রতি ঘণ্টায় পৌঁছানো।
এছাড়া, মুম্বই-পুণে, চেন্নাই-কোয়েম্বাটোর, এবং অমৃতসর-চণ্ডীগড় রুটেও হাইপারলুপ চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। মুম্বই-পুণে রুটে এই ট্রেন চালু হলে মাত্র ২৫ মিনিটে দুই শহরের মধ্যে যাতায়াত করা যাবে।
কীভাবে কাজ করবে হাইপারলুপ ট্রেন?
হাইপারলুপের মূল প্রযুক্তি চৌম্বকীয় লেভিটেশন (Magnetic Levitation) এবং লো-প্রেশার টিউব। বিশেষভাবে নির্মিত টানেলের মধ্যে কোনও বাতাস থাকবে না, ফলে ট্রেন চলার সময় বাতাসের বাধা থাকবে না। ঘর্ষণহীন পরিবেশে ট্রেনটি প্রায় ভাসমান অবস্থায় সামনে এগোবে, ফলে গতি হবে অভাবনীয়।
এই প্রযুক্তির জন্য জ্বালানির প্রয়োজন নেই, মূলত বিদ্যুৎ ও চৌম্বক শক্তির সাহায্যে চলবে। তাই এটি পরিবেশবান্ধবও বটে।
হাইপারলুপ বনাম বুলেট ট্রেন: পার্থক্য কী?
বুলেট ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি প্রতি ঘণ্টায় ৪৫০ কিমি, যেখানে হাইপারলুপ ১১০০-১২০০ কিমি পর্যন্ত যেতে পারে। বুলেট ট্রেন চাকার মাধ্যমে রেলের উপর চলে, কিন্তু হাইপারলুপ চলে সম্পূর্ণ ভ্যাকুয়াম টানেলে চৌম্বক শক্তির সাহায্যে, যা এটিকে আরও দ্রুত ও কার্যকরী করে তোলে।
হাইপারলুপের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
বিশ্বজুড়ে হাইপারলুপ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চলছে। ইলন মাস্কের সংস্থা স্পেসএক্স প্রথম এই প্রযুক্তির ধারণা দেয়, আর এখন বিভিন্ন দেশ এই প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। ভারতে এটি বাস্তবায়িত হলে, শহরগুলোর মধ্যে যাতায়াতের সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে, যা অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে, এই প্রকল্পের খরচ, অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ এবং নিরাপত্তা বিষয়ক উদ্বেগ এখনো বড় বাধা। এছাড়া, এর টিকিটের দাম বিমানভাড়ার সমান হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভারতের পরিবহণ ব্যবস্থায় হাইপারলুপ হতে চলেছে এক বিপ্লবী পরিবর্তন। যদি সব পরিকল্পনা সফল হয়, তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারতীয় রেল বিশ্বের দ্রুততম ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। অপেক্ষা এখন শুধুমাত্র প্রযুক্তির সফল বাস্তবায়নের।