কাকতাড়ুয়ার ইতিকথা

কাকতাড়ুয়া’কে তোমরা নিশ্চয়ই চেনো ? কি বললে, তোমাদের অনেকেই চেনো না ! আচ্ছা ঠিক আছে, আজ তোমাদের কাকতাড়ুয়ার কথাই শোনাবো।

কাকতাড়ুয়া হল জমিতে ফসলের পাহারাদারি করা এক ধরনের পুতুল। আমাদের দেশের হিন্দিভাষী অঞ্চলে এটি ‘বিজুকা’ নামেও পরিচিত। জমিতে বীজ বপনের পর ছোট ছোট চারাগাছ বার হতেই কাকতাড়ুয়ার প্রয়োজন দেখা দেয় কৃষকের। কাকতাড়ুয়া তৈরি করা ভীষণ সোজা। এরজন্য কৃষক নিজের জমির মধ্যবর্তী স্থানে দুটি বাঁশকে ক্রসের আকারে বেঁধে মাটির মধ্যে গেড়ে দেয়। মাটির ওপর খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বাঁশের নিচের দিকে কিছুটা খড় লাগিয়ে পা আর উপরে বাঁশের মাথায় একটা মাটির হাঁড়ি উল্টে দিয়ে কাকতাড়ুয়ার মাথা তৈরি করে। মাটির সমান্তরাল বাঁধা বাঁশটি দুই হাতের কাজ করে। এবার এই কাঠামোটিকে পুরোনো ছেঁড়া পোশাক পরিয়ে কিছুটা সাজিয়ে দেওয়া হয়। ব্যাস, তৈরি হয়ে গেল কাকতাড়ুয়া।

চাষের জমির আন্তর্জাতিক পাহারাদার হল কাকতাড়ুয়া। ভারত ছাড়াও চীন, জাপান, গ্রীস, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশেও প্রাচীনকাল থেকে কাকতাড়ুয়ার ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রাচীন গ্রীসে পাখিদের থেকে ফসলকে বাঁচাবার জন্য কৃষির দেবতা পেরিয়াপসের মূর্তিকে জমির মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। আমেরিকাতে আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে চাষের জমিতে ফসল পাহারা দেওয়ার জন্য রেড ইন্ডিয়ানরা কোট, প্যান্ট আর টুপি পরা কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করতো। স্পেন, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, পর্তুগাল, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ব্রাজিল, হাঙ্গেরি তথা আফ্রিকা মহাদেশের বহু দেশে আজও কাকতাড়ুয়ারা পশু-পাখির থেকে জমির ফসলকে রক্ষা করার কাজে বহাল রয়েছে।

কাকতাড়ুয়াদের উৎপত্তি কবে আর কিভাবে হয়েছিল ? এই সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের অনুমান, মানুষ যখন যাযাবর জীবন ত্যাগ করে একস্থানে বসবাস আর চাষবাস করা আরম্ভ করে, সেই সময় থেকেই সম্ভবত কাকতাড়ুয়াদের প্রচলন হয়েছিল।

উত্তরপ্রদেশের এক প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে এক বৃদ্ধ কৃষক ছিল। তার কেউ ছিল না, না স্ত্রী না সন্তান। কৃষকের ছিল চাষের উপযোগী সামান্য জমি। একবার কৃষকের জমিতে দারুণ ভালো ফসল হয়েছিল। কৃষক ভীষণ খুশি ছিল।

গ্রাম জুড়ে কৃষকের ফসলের চর্চা ছিল। এক রাতে কৃষকের জমির ফসল চুরি করতে এক চোর হাজির হল। চোর ফসল কাটতেই যাচ্ছিল এমন সময় সে কিছুটা দূরে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। চোরের মনে হল ব্যক্তিটি তাকেই দেখছে। চোর তাকে জমির পাহারাদার ভেবে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে এটা কোনো মানুষ ছিল না, ছিল একটি শুষ্ক বৃক্ষ, যাতে কৃষক তার টুপি আর জামা ভুলে ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে দূর থেকে সেটাকে দেখেই চোর পাহারাদার ভেবে পালিয়ে গিয়েছিল। পরদিন গ্রামময় এই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে বৃদ্ধ কৃষকের জমিতে কোনো ব্যক্তি পাহারা দেয়। গ্রামবাসী এই খবরে ভীষণ আশ্চর্যচকিত হয়। সকলে মিলে জমিতে গিয়ে অবশ্য কারো দেখা পেলো না, তবে সেই শুষ্ক গাছে কৃষকের টুপি আর জামাকে ঝুলতে দেখা গেল। দূর থেকে যাকে কোনো মানুষের মতোই লাগছিল। | গ্রামবাসীর কাছে রহস্যের কারণ পরিষ্কার হয়ে গেল। আর তখন থেকেই সব | কৃষকেরা নিজের নিজের জমির ফসল পাহারা দেওয়ার জন্য কাকতাড়ুয়া বানাতে শুরু করে।

কাকতাড়ুয়া সম্বন্ধে কৃষকদের মধ্যে দু’রকম মত প্রচলিত আছে। একদল শুধুমাত্র মানুষের আকারের পুতুল জমিতে দাঁড় করিয়ে রাখে। এই পুতুলকে দেখে পশু-পাখিরা জমিতে ঢোকে না। এরা কাকতাড়ুয়ার মাথা তো বানায় কিন্তু তাতে চোখ, নাক, মুখ ইত্যাদি আঁকে না। অন্য দল মনে করে কাকতাড়ুয়ার মুখশ্রী ভয়ানক হওয়া আবশ্যক। কেননা কাকতাড়ুয়ার ভয়ানক মুখশ্রী দেখে ক্ষতিকর পশু-পাখিরা জমিতে ঢুকতে ভয় পায়। পশু-পাখির থেকে জমির ফসলকে বাঁচাবার জন্য অনেক কৃষক কাকতাড়ুয়ার হাতে কাঠ বা বাঁশের ছড়ি ধরিয়ে দেয়। কারো কারো মতে পশু-পাখিরা আওয়াজ শুনে পালিয়ে যায়-তাই তারা কাকতাড়ুয়ার হাতে ঘন্টি, টিনের কৌটা বেঁধে দেয়। জোরে হাওয়া চললে সেসব থেকে বিভিন্ন ধরনের শব্দ বার হয়।

সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কাকতাড়ুয়া তৈরিতেও নানা পরিবর্তন এসেছে। চীন, জাপান, জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স তথা অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশে আকর্ষণীয় কাকতাড়ুয়া তৈরি আরম্ভ হয়েছে। আজকাল কাকতাড়ুয়ারা শুধু ছড়ি হাতে দাঁড়িয়েই থাকে না। জমির মাঝে তাদের দেখা যায়। সাইকেল কিংবা মোটর সাইকেলে বসে থাকতেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *