লেখক পঙ্কজ সেন
জলপাইগুড়ি শহরের তিন নম্বর ওয়ার্ডে আজ যেখানে তিস্তা উদ্যান অবস্থান করছে আশির দশকের প্রথম পর্যন্ত শহরবাসীর কাছে তা লোকমুখে পরিচিত ছিল “আমবাগানের মাঠ” নামে। এই এলাকায় রাস্তার ধার ঘেষে কিছু বড় বড় আম গাছ ছিল জন্যই তা “আম বাগানের মাঠ” নামে জনমানষে পরিচিতি পায়। তারও পূর্বে এই মাঠ পরিচিত ছিল “শিবাজী ময়দান”(১৯৪৮) ও “স্পুটনিকের মাঠ”(১৯৬৩) নামে। অবশ্য আম গাছের সাথে সাথে অন্যান্য গাছও ছিল। করলা নদী সংলগ্ন ঢালু ও জলা এই স্থানে ব্যাপক নদিয়ালি মাছের উপস্থিতি ছিল, সেই সাথে ছিল সাপের উপদ্রব। বছরের অন্যান্য সময় প্রায় শুষ্ক থাকলেও বর্ষাকালে এই এলাকা জলে টইটম্বুর থাকায় বৃদ্ধি পেত অসংখ্য নদিয়ালি মাছের আনাগোনা। তাই বর্ষাকালসহ অন্যান্য সময়েও শহরের স্থানীয় জনগণ এখানে মাছ মারতো। জলাশয়ের সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী জায়গায় গরু, মহিষসহ ইত্যাদি গবাদি পশু চড়ে বেড়াতো। এই এলাকায় গারুয়া নামক এক প্রকার লম্বা ঘাস দেখা যেত, যা মহিষের অত্যন্ত পছন্দের খাদ্য ছিল। এই ঘাসের ভেতরের সাদা নরম অংশ দিয়ে সেই সময়ে স্থানীয় কিছু মানুষজন ঠাকুর ঘরে প্রদীপের শলতে তৈরির কাজে লাগাতো। আমবাগানের জলাশয়গুলি কচুরিপানায় আবৃত ছিল।
১৯৬৮ সালের ৪ঠা অক্টোবর তিস্তার মহা বন্যায় শহরবাসীকে রক্ষা করার জন্য আর্মি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের (ভারত সরকার) পক্ষ থেকে জলপাইগুড়ি শহরে অনেকগুলি নৌকো (লম্বায় প্রায় ২০ ফিট) আনা হয়েছিল, তার মধ্যে তিনটি লোহার পাতের নৌকা আম বাগানে মাঠে দীর্ঘদিন ধরে ছিল। বন্যা হয়ে যাবার অনেক পরেও এই নৌকাগুলি সেখান থেকে সরানোর কোন ব্যবস্থা হয়নি। নদী ও বৃষ্টির জলে এই নৌকা গুলি প্রায় ভর্তি হয়ে থাকতো। স্থানীয় কম বয়সী ছেলেরা এই নৌকা গুলিতে জমে থাকা জলে মাছ মারত।
শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির অংশ হিসেবে পরিত্যক্ত এই খানাখন্দময় জলা স্থানটিকে একটি মনোমুগ্ধকর পার্ক হিসেবে গড়ে তোলার চিন্তা ভাবনা শুরু করে জলপাইগুড়ি বন বিভাগ। এক্ষেত্রে তৎকালীন বনদপ্তরের মন্ত্রী পরিমল মিত্রের অবদান অনস্বীকার্য। সেই পরিকল্পনা মতো ১৯৮২-৮৩ সালে ট্রাকে করে এই জায়গায় মাটি ফেলার কাজ শুরু হয়। দুই-তিন বছর ধরে অনেক শ্রমিকের কঠোর পরিশ্রমের ফসল হিসেবে গড়ে ওঠে আজকের তিস্তা উদ্যান। তিস্তা নদী সংলগ্ন এলাকায় এই উদ্যান গড়ে উঠেছিল জন্য তার নাম রাখা হয় “তিস্তা উদ্যান”। সম্ভবত ১৯৮৫-৮৬ সালে এই উদ্যান সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ১৯৯৪ সালে টলিউড অভিনেতা চিরঞ্জিত ও শতাব্দী রায় অভিনীত “সংসার সংগ্রাম” নামে একটি বাংলা সিনেমার গানের শুটিং এখানে হয়েছিল। ১৯৮৯ সালে তিস্তা উদ্যানের ভেতরে হঠাৎ করে চিতা বাঘের আগমন হয়। এই ঘটনা নিয়ে সেদিন সারা শহরে তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল। প্রতিবছর নিয়ম মেনে শীতকালে বনদপ্তরের পক্ষ থেকে পুষ্প মেলার আয়োজন করা হয় এখানে। শহরের শিশুসহ অন্যান্য সকল বয়সী মানুষের কাছে আজ তিস্তা উদ্যান একটি অতি পরিচিত নাম। বর্তমানে এই উদ্যানের সবকিছুই পরিচালনা করে থাকে জলপাইগুড়ি বন বিভাগ।
(লেখকের সংযোজন : তিস্তা উদ্যান সংক্রান্ত বিবরণীতে কোন ভুল বা ত্রুটি থাকলে তা একেবারেই অনিচ্ছাকৃত। সম্পূর্ণ বিবরণীটি স্থানীয় জনগণের মুখ থেকে শুনে তা লিপিবদ্ধ করা। তাই ভুল ত্রুটি হলে তা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)