জলপাইগুড়ি : কুম্ভমেলায় মানুষের ঢল, তার মাঝেই ঘটে যায় অনেক ঘটনা। তেমনই এক হৃদয়স্পর্শী ঘটনার সাক্ষী থাকলো প্রয়াগরাজের কুম্ভস্নান। বন্ধুদের সঙ্গে পুণ্যস্নানে গিয়েছিলেন জলপাইগুড়ির সমাজসেবী নবেন্দু মৌলিক। আর সেখানেই এক অসহায় বাঙালি মহিলাকে সাহায্য করে মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তিনি।

গতকাল বুধবার, স্নান সেরে নিজের টেন্টে বসে ছিলেন নবেন্দু। হঠাৎ এক বাঙালি মহিলা এসে জানতে চাইলেন— “এখানে মুর্শিদাবাদের গাড়ি কোথায় আছে?” দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে নবেন্দু বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, মহিলা পরিবারের থেকে হারিয়ে গেছেন।

“আপনি কি হারিয়ে গেছেন?”— প্রশ্ন করতেই মহিলার চোখে জল। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি জানান, স্বামীর সঙ্গে মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ থেকে কুম্ভস্নানে এসেছিলেন। ভোর তিনটায় পৌঁছে সঙ্গমঘাট পর্যন্ত হেঁটে যান। সব ঠিকই ছিল, কিন্তু স্নান সেরে দেখেন স্বামী নেই! পরিচিত কাউকেই দেখতে পাচ্ছেন না।

কিলোমিটার পর কিলোমিটার খালি পায়ে হাঁটতে থাকেন তিনি, খুঁজতে থাকেন পরিবারের লোকজনকে। ভাষার সমস্যায় উত্তরপ্রদেশ পুলিশের কাছ থেকেও কোনো সাহায্য পাননি। সাধারণ মানুষের কাছে শুনে শুনে খুঁজছিলেন স্বামী ও পরিবারকে। ঠিক তখনই ভাগ্যের খেলায় নবেন্দুর কাছে এসে পড়েন।
মহিলার ফোন নেই, পরিবারের কারও নম্বরও মনে নেই। শুধু জানেন জিয়াগঞ্জে বাড়ি এবং নিজের অর্ধেক ঠিকানা। এইটুকু তথ্য নিয়েই মহিলাকে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার কঠিন কাজ শুরু করেন নবেন্দু।
প্রথমে মোবাইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন জিয়াগঞ্জ থানার ওসির সঙ্গে। এরপর বিষয়টি জানান মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপারকে। পাশাপাশি যোগাযোগ করেন পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অভিষেক কুমার তিওয়ারির সঙ্গে, যিনি দ্রুত জেলা প্রশাসনকে বিষয়টি জানান।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিডিও জিয়াগঞ্জ নবেন্দুকে ফোন করেন এবং মহিলার স্বামী ও ছেলের ফোন নম্বর পাঠান। প্রশাসন বাসের চালকের সঙ্গেও যোগাযোগ করে জানতে পারে, বাস ছেড়ে চলে গেছে এবং স্বামীও চলে গেছেন!
প্রশাসন নবেন্দুকে অনুরোধ করে মহিলাকে যেন একা ছেড়ে না দেন। নবেন্দু তাঁদের আশ্বস্ত করেন—”আমি ওনাকে কোনোভাবেই একা ছাড়বো না। প্রয়োজনে আমি নিজেই বাড়ি পৌঁছে দেবো।”
বাসের লোকেশন ট্র্যাক করে সেটি থামানো হয়। এরপর নবেন্দু এবং তাঁর সঙ্গীরা মহিলাকে খাইয়ে-দাইয়ে সেই বাসেই তুলে দেন, যাতে তিনি নিরাপদে ফিরে যেতে পারেন।
স্থানীয় ধাবার মালিক রাহুল বিশ্বকর্মাকে সঙ্গে নিয়ে নবেন্দু ও তাঁর টিমের সদস্যরা সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ মহিলাকে তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দেন।
এই মানবিক উদ্যোগে মুর্শিদাবাদের প্রশাসন থেকে শুরু করে কুম্ভমেলায় উপস্থিত মানুষজন নবেন্দুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাঁর প্রচেষ্টায় এক হারিয়ে যাওয়া মহিলা পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পেরেছেন, যা সত্যিই প্রশংসনীয়।
এই ঘটনাই প্রমাণ করে— মানবতা এখনও বেঁচে আছে, এবং সঠিক সময়ে সহজাত মানবিকতাই পারে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে ঘরে ফেরাতে।