লেখক পঙ্কজ সেন
মাত্র ১৮ বছর বয়সে পিতৃহারা অবস্থায় ভাগ্য অম্বেষনে সুদূর ঢাকার বিক্রমপুর (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) থেকে চল্লিশের দশকে জলপাইগুড়ি শহরে এসেছিলেন রমেশ চন্দ্র দে। থাকতেন শহরের মহুরী পাড়ার এক ভাড়াবাড়িতে। প্রথমে তিনি ঢাকা থেকে খেলার সামগ্রী এনে তা জলপাইগুড়িতে বিক্রি করতেন। সেই সাথে তিনি সাইকেল মেরামতের কাজও করতেন। পরবর্তীতে রমেশ বাবু মা ও বোনকে জলপাইগুড়িতে নিয়ে আসেন। কিছুদিন পর তিনি শহরের কোতয়ালি থানা এলাকায় বর্তমান জাতীয় কংগ্রেস কার্যালয় রাজিব ভবনের সামনে একটি চায়ের দোকান দেন। ধীরে ধীরে রমেশ বাবুর কর্ম প্রচেষ্টায় দোকানটি যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এরপর তিনি ১৯৪৬ সালে ওই একই এলাকায় অবস্থিত কোহিনুর বিল্ডিং এর মালিক রামানন্দ দাগার থেকে ভাড়া নিয়ে একটি হোটেল গড়ে তোলেন আর নিজের বড় মেয়ে রুবির নামে হোটেলটির নাম রাখেন “রুবি বোর্ডিং”। উল্লেখ্য, রমেশ বাবুর মোট ৯ জন সন্তান, যার মধ্যে পাঁচ পুত্র ও চার কন্যা ছিল। রামানন্দ দাগার কাছে তৎকালীন মাসিক ৩৬০ টাকা ভাড়ার বিনিময়ে রমেশবাবুর “রুবি বোর্ডিং” এর পথ চলা শুরু হয়। স্বাধীনতার আগে জলপাইগুড়ি শহরে মাত্র গুটিকয়েক হোটেলের মধ্যে রুবি বোর্ডিং ছিল অন্যতম।

পঞ্চাশের দশকে শহরের শিশু নিকেতন বিদ্যালয়ে উদয়শংকর ও অমলাশঙ্করের ডান্সিং ট্রুপ পদার্পণ করলে তারা সেই সময় কোহিনুর বিল্ডিং এ ভাড়া থাকা “রুবি বোর্ডিং”র দোতলা লজে উঠেছিলেন। সেই সময় এই ভবনের তিনতলায় রুবি বোর্ডিং এর হোটেল এবং দোতলায় সাধারণ মানুষের ঘুমানোর ব্যবস্থা ছিল। ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত রুবি বোর্ডিং “কোহিনুর বিল্ডিং” এই স্থিত ছিল। ইতিমধ্যে জলপাইগুড়ি শহর ছাড়িয়ে রুবি বোডিং এর খ্যাতি ও সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল। রুবি বোর্ডিংয়ের একটি অন্যতম বিশেষত্ব হলো খাবার পরিবেশনের সময় এখানে সর্বদা কাঁসার বাসনপত্র ব্যবহার করা হয়। একসময় প্রায় দুই মণ চাল, ৪০ কেজি মাছ ও ৪০ কেজি মাংস রুবি বোর্ডিং এ দৈনন্দিন প্রয়োজন হতো। ৫ থেকে ৬ জন কর্মী প্রায় সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করত। ইতিমধ্যে রমেশ বাবুর আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলে তিনি জলপাইগুড়ি শহরের টেম্পল স্ট্রিট এলাকায় “জলপাইগুড়ি ডিস্ট্রিক্ট সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ কনজ্যুমার লিমিটেড” এর আড়াই কাঠার একটি জমি কেনার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। পূর্বে এই স্থানে কয়লার গোডাউন ছিল। ইতিমধ্যে এই জমিটি কেনার জন্য শহরের আরো কিছু মানুষ আগ্রহ প্রকাশ করলে, রমেশবাবু এই সংস্থার তৎকালীন প্রধান মনোরঞ্জন দাশগুপ্তের (বর্তমানে যেখানে মেরিনা নার্সিংহোম রয়েছে সেই স্থানে এনার বাড়ি ছিল) সঙ্গে যোগাযোগ করে জমিটি কেনার জন্য অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করেন। ফলস্বরূপ, মনোরঞ্জন বাবু বিড়ম্বনা এড়ানোর জন্য জমিটি বিক্রির জন্য একটি নিলাম ডাকেন। সেই বোর্ডে সর্বোচ্চ আঠারো হাজার টাকা মূল্য দিতে রাজি হয়ে আড়াই কাঠার জমিটি কিনে নেন স্বয়ং রমেশবাবু। ১৯৫৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত উক্ত স্থানেই বিরাজ করছে “রুবি বোর্ডিং”।

তৎকালীন জলপাইগুড়ি শহরের টিম্বার অকশন, চা বাগানের ম্যানেজার ও বড়বাবু, শহরের ফেরিঘাট এলাকায় কর্মসূত্রে আগত মানুষজন “রুবি বোর্ডিং” লজে রাত্রি যাপন করতেন। ষাট ও আশির দশক পর্যন্ত হোটেলের সামনে গাড়ির লম্বা লাইন থাকতো। এই সময়ে বাংলার সংস্কৃতি জগতের খ্যাতিমান তারকারা জলপাইগুড়িতে এলে এই হোটেলেই পদার্পণ করতেন। এই তালিকায় রয়েছেন গায়ক হেমন্ত মুখার্জী, মান্না দে, নির্মলেন্দু চৌধুরী, শ্যামল মিত্র, গায়িকা সন্ধ্যা মুখার্জী, আরতি মুখার্জী, তবলা বাদক রাধাকান্ত নন্দী , অভিনেতা সমিত ভঞ্জ, স্বরূপ দত্ত (অভিনেতা, বিখ্যাত বাংলা ছবি”আপনজন” এর ছেনো) সহ আরো অনেকেই। ষাটের দশকে জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তৎকালীন প্রায় সব ছাত্ররা মাঝেমধ্যেই এই সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানা হোটেলে খাওয়া দাওয়া করতেন। সেই সুবাদে আজও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পুনর্মিলন উৎসবে সেই সময়ের ছাত্ররা (ভারতে এবং বিদেশে কর্মরত) উপস্থিত হলে তারা একবার হলেও “রুবি বোর্ডিং” ঘুরে যান এবং সেই সঙ্গে তাদের সেই সময়ের প্রিয় “চিতল মাছের পেটি” সহকারে ভোজন করতে আসেন।
রুবি বোর্ডিংয়ের এই স্বর্ণযুগে রমেশ বাবু সুযোগ পেয়েছিলেন, ১৯৫৩-৫৪ সালে বর্তমান শিলিগুড়ির হিলকার্ট রোডে (হোটেল বিনায়ক ও রত্ন ভান্ডারের পাশে) রুবি বোর্ডিং এর দ্বিতীয় ব্রাঞ্চ “রুবি বোর্ডিং হাউজ” খোলার। এই হোটেলের দায়িত্ব তিনি প্রদান করেছিলেন নিজের বোন বীণাপাণি দে’র স্বামীকে। কিন্তু জলপাইগুড়ির মতো শিলিগুড়িতে রুবি বোর্ডিং সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি। পরিচর্যার অভাবে ১৯৬৯ সালের পর সেই হোটেল বন্ধ হয়ে যায়।
২০১৮ সালে রমেশ বাবু ৯৯ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেলে, রুবি বোর্ডিং এর দায়িত্ব বর্তায় তার পাঁচ পুত্রের হাতে। অবশ্য রমেশবাবু, বয়সের ভারে বহুদিন আগেই হোটেলের দায়িত্ব ছেলেদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। বর্তমানে হোটেলের সেই পূর্ব গরিমা আজ আর না থাকলেও, পরিবারের বড় সন্তান প্রণববাবু সহ অন্য চার ভাইয়েরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তাদের বাবার এই স্মৃতিকে অত্যন্ত যত্নের সাথে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। পূর্ব ঐতিহ্য বজায় রেখে আজও সম্পূর্ণ বাঙালিয়ানা খাবার পরিবেশন করে চলেছে জলপাইগুড়ির “রুবি বোর্ডিং”।