জল্পেশ মন্দির ও জলপাইগুড়ি

লেখক পঙ্কজ সেন

জলপাইগুড়িকে তিন ঈশ্বরের দেশ বলা হয়, এই তিনটি ঈশ্বর হলো জেলার ময়নাগুড়ি ব্লক অঞ্চলের জল্পেশ্বর, জটিলেশ্বর এবং বটেশ্বর। ময়নাগুড়ি থেকে প্রায় ৭ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে জর্দা নদীর তীরে উত্তর-পূর্ব ভারতের সর্ববৃহৎ শিব মন্দির জল্পেশ অবস্থিত। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতায় যথাক্রমে – ১০২৪, ১০০ ও ১২৭ ফুট। এই মন্দিরের মতো এমন বৃহৎ গম্বুজ ভূভারতে আর দ্বিতীয়টি নেই বলে জানা যায়। আদি মন্দির ধ্বংস হয়ে গেলে কোচ রাজা প্রাননারায়ন মন্দিরটি সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৬৬৫ সালে উত্তর ভারত বা দিল্লি থেকে মুসলমান শিল্পীদের এই স্থানে নিয়ে আসেন। প্রাণনারায়ন মন্দিরের সংস্কার কার্য শুরু করলেও শেষ হয় তার পৌত্র মোদনারায়নের সময়ে। ১৮৩৭ সালের এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে মন্দিরটি খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়,পরবর্তীতে অবশ্য তার সংস্কার করা হয়েছিল। উল্লেখ্য জল্পেশে বছরে মোট তিনটি মেলা বসে, যথা শিব চতুর্দশীতে জল্পেশ মেলা, শ্রাবণ মাসের শ্রাবণী মেলা এবং বৈশাখ মাসে বৈশাখী মেলা। এখানে প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের শিব চতুর্দশীতে একটি বিরাট মেলা বসে। “জল্পেশ মেলা” উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম গ্রামীণ মেলা। ১৯৮১ সাল থেকে জলপাইগুড়ি জেলাশাসকের তত্ত্বাবধানে ও ব্যবস্থাপনায় এই মেলা পরিচালিত হয়ে আসছে। এক সময় এই মেলায় নানাপ্রকার জন্তু-জানোয়ার ক্রয়-বিক্রয় হত। শ্রাবণ মাসের প্রতি সোমবার বহু পুণ্যার্থী “বোলে বোম “ধ্বনি দিতে দিতে এখানে সমাগত হয়। এই মন্দিরের “শ্রাবণী মেলা ” বিশেষ আকর্ষণীয়। দেশীয় পুণ্যার্থীর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান এমনকি সুদূর শ্রীলংকা থেকেও হিন্দু পুণ্যার্থীরা এখানে বাবার দর্শন করতে আসেন। মাটি থেকে অনেকটা নিচে নেমে মন্দিরের গর্ভগৃহে যে শিব ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত, তার কোনও মূর্তি নেই, তিনি অনাদি লিঙ্গ। উত্তরবঙ্গ ও নিম্ন আসামের শিব মন্দির গুলির মত এই মন্দিরেও খাসি ও পায়রা বলি দেওয়া হয় “ঝিটকা” পদ্ধতিতে। জল্পেশ মহাপীঠ সম্বন্ধে স্কন্দপুরান ও কালিকা পুরাণে বিস্তারিত উল্লেখ আছে।

কথিত আছে একবার কোচবিহার রাজ এই শিবলিঙ্গ মাটি থেকে তুলে নিজ রাজধানীতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুটো হাতি দিয়ে টেনেও শিবলিঙ্গটি মাটি থেকে তোলা সম্ভব হয়নি। তাই মন্দিরের মূল দুয়ারের সামনে এখনো এই দুই হাতির পাথরের মূর্তি বর্তমান রয়েছে। উল্লেখ্য এই হাতিগেট নির্মাণ করেছেন রামসাই নিবাসী স্বর্গীয় ভোলানাথ ঘোষ। এই মন্দিরে আছে ভুটান রাজার দেওয়া বিশালাকৃতির এক ঘন্টা। জল্পেশ মন্দির পরিচালন কমিটির প্রথম ট্রাস্ট কমিটির (৪ঠা জুন,১৮৯৪) সম্পাদক নিযুক্ত হন জলপাইগুড়ির বৈকুন্ঠপুর রাজপরিবারের সদস্য কুমার জগদিন্দ্র দেব রায়কত।

Jalpesh Temple and Jalpaiguri

কুমার জগদিন্দ্রদেব রায়কত অত্যন্ত পরিশ্রম ও যত্ন সহকারে ১৩০৩ বঙ্গাব্দে জল্পেশ মন্দিরের ইতিহাস সংগ্রহ করে, একটি বই রচনা করেন “জল্পেশ মন্দিরের ইতিবৃত্ত” নামে। জল্পেশ মন্দির কমিটির দ্বিতীয় সম্পাদক স্বর্গীয় গোবিন্দ শঙ্কর সর্বাধ্যক্ষ এর সময় (১৯৩২-১৯৬৩) জল্পেশ মন্দিরের গর্ভগৃহ সংস্কার করা হয় এবং এই কাজে জলপাইগুড়ি জেলা বোর্ডের তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ার স্বর্গীয় কালীচরণ গুই যথেষ্ট সাহায্য করেন। ১৯৬৫ সালে তিস্তা সেতু নির্মিত হলে, তিস্তা নদীর ঐ পাড়ের দিকে সেতুটির নাম রাখা হয় “জল্পেশ সেতু”। জল্পেশ মন্দিরকে কেন্দ্র করে বহু জনকল্যাণমূলক কাজ এখানে হয়ে আসছে। জল্পেশ মন্দিরের অপর নাম “ভিমেশ্বর মন্দির”। শোনা যায় একবার প্রচন্ড ঝড়ে মন্দিরের চূড়া উড়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী কোন এক স্থানে পতিত হয় এবং সেই জায়গাটির নাম দেওয়া হয় চুড়া ভান্ডার।

(তথ্যে সামান্য ভুল ত্রুটি হতে পারে। তাই পাঠকদের কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনারা কমেন্ট বক্সে আপনাদের সুচিন্তিত মতামত প্রদান করতে পারেন।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *