করলা নদী ও জলপাইগুড়ি

লেখক পঙ্কজ সেন

জলপাইগুড়ি জেলার শহর সংলগ্ন শিকারপুর অরন্যের মরিঙ্গাঝোড়া নামক জায়গা থেকে করলা নদীর উৎপত্তি। নদীটির দৈর্ঘ্য মাত্র ৪৫ কিলোমিটার। জঙ্গলের ছায়া বুকে মেখে করলা হয়ে উঠেছে আরো কৃষ্ণ কায়া। বনাঞ্চল, গ্রাম-গঞ্জকে অতিক্রম করে জল শহরের বুকের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অবশেষে করলা, তিস্তা নদীতে মিলিত হয়েছে। জনশ্রুতি আছে যে, কল-কল শব্দে নদীর জল প্রবাহিত হওয়ার জন্যই তার নাম হয়ে উঠেছে “করলা”।

১৯৬৮ সালের ৪ঠা অক্টোবর তিস্তার ভয়াবহ বন্যার পর পরবর্তী বন্যার হাত থেকে শহরকে বাঁচাতে তিস্তা ও করলা নদীর সংযোগস্থল নিয়ে যাওয়া হয় শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে ঝাড় সিংহেশ্বরে। জলপাইগুড়ি শহরের গর্ব মেয়েদের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় “সুনীতি বালা সদর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়” (১৮৭১) করলা নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে। সেই জন্য আজও জলপাইগুড়ি শহরের অনেক প্রবীণ, এই বিদ্যালয়কে “করলা গার্লস” বলে অভিহিত করেন। এই বিদ্যালয়ের পাশেই ধরধরা নদী, করলার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

করলা নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামী,কবিরাজ সতীশ চন্দ্র লাহিড়ী ও আরো কয়েকজনের নেতৃত্বে এশিয়া তথা ভারতের প্রথম নেতাজি সুভাষের পূর্ণাবয়ব মূর্তি ও মন্দির, যা জেলাবাসীর কাছে পরিচিত ছিল “অমর মন্দির” নামে। জলপাইগুড়ি জেলার চা নিলাম কেন্দ্র (আই টি পি এ ভবন) অবস্থিত এই নদীর তীরেই। ক্লাব রোডের বিখ্যাত কিং সাহেবের ঘাট এই করলা নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে।

১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে ছট পুজোর দিন বিকেলের শেষ দিকে সদর গার্লস স্কুলের পাশে অবস্থিত ইংরেজ আমলের দোলনা পুল পুর্ণার্থীদের অতিরিক্ত ভিড়ের চাপে এক পাশের রশি ছিঁড়ে কাত হয়ে গেলে, অনেক শিশু ও নারী সরাসরি করলা নদীর জলে পতিত হয়। এর ফলে প্রায় বার থেকে পনের জন নারী ও শিশুর সলীল সমাধি হয়।

সত্তর এর দশকের শেষ পর্যন্ত জলপাইগুড়ি শহরের দুর্গাপূজোর বিজয়া দশমীর দিন বিখ্যাত বাবুঘাটে বিভিন্ন পূজা কমিটির করলা নদীতে দুটি বা তিনটি নৌকা একত্র করে ঠাকুর বিসর্জনের স্মৃতি আজও শহরের অনেক প্রবীণকে নস্টালজিক করে তোলে। পরবর্তীতে এই প্রথা ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে যায়, শুধুমাত্র ৯০ দশকের শেষ পর্যন্ত শহরের বিখ্যাত বিগ বাজেটের পুজো ” কল্যাণী গ্রুপ “এই ধারা কিছুটা হলেও বজায় রেখেছিল।

একসময় করলা নদীতে অনেক বড় বড় মাছের সন্ধান পাওয়া গেলেও ২০১২ সালে কেউ বা কারা রাতের অন্ধকারে বিষাক্ত কীটনাশক এন্ডোসালফান প্রয়োগ করে, যার ফলে করলায় প্রচুর জলজ প্রাণী ও মাছের মৃত্যু ঘটে। বর্তমানে অবশ্য ধীরে ধীরে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, কিন্তু নদীতে যথেচ্ছ ভাবে আবর্জনা নিক্ষেপের ফলে করলা হারিয়েছে তার আপন চলার গতি ও ছন্দ।

জলপাইগুড়ি পুরসভা থেকে মাঝেমধ্যে নদী সাফাইয়ের কাজ করা হলেও, শহরবাসীকে এই বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন হতে হবে। তাহলেই আমাদের প্রিয় করলা পুনরায় আগের মত প্রাণবন্ত ও সজীব হয়ে উঠবে।

ছবি ইন্টারনেট ও ফেসবুকের সৌজন্যে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *