জানা-অজানা নজরুল

পিনাকী রঞ্জন পাল

আজ থেকে একশো তেইশ বছর আগে ১৩০৬ এর ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে যে শিশুটির জন্ম হয়েছিল তিনি হলেন নজরুল ইসলাম। আগামী ২৬ মে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলী হিসাবে এই লেখায় রইল তার জীবনের কিছু জানা-অজানা তথ্য।

দুখু মিঞা : নজরুলের শৈশবের ডাক নাম ‘দুখু মিঞা’ ছিল। আসলে শৈশবকালটা তাঁর খুব দুঃখ- কষ্টের মধ্য দিয়ে কেটেছিল। তাঁকে রুটির কারখানায় কাজ করতে হয়েছিল, গৃহভৃত্য রূপে কাজ করতে হয়েছিল। আরও অনেক কিছুই করতে হয়েছিল বালক নজরুলকে। তাই শৈশবেই তাঁর ডাক নাম হয়েছিল ‘দুখু মিঞা’। শৈশবে নজরুলকে গ্রামের লোকেরা আদর করে ডাকতো ‘তারাখেপা’ ও ‘নজর আলি’ বলেও।

দুষ্টু সর্দার : ছেলেবেলায় নজরুল ছিলেন দুষ্টুমিতে সেরা। তাঁর জ্বালায় গ্রামের সকলে অস্থির হয়ে যেত। দুখু কখনো গাছের ফল চুরি করে খেত, কখনো চুরি করতো বাগানের ফুল, ধরতো পুকুরের মাছ, গাছ থেকে পেড়ে আনতো পাখির বাসা। আবার স্কুলে যাবার নাম করে বেরিয়ে গাছের কোটরে বই খাতা লুকিয়ে রেখে ঘুরে বেড়াত মাঠে-ঘাটে। পাড়ার লোকের পেঁপে গাছের বড়-বড় পেঁপেগুলোকে দুখু গুলতি দিয়ে মেরে ফুটে করে দিত এবং তারপর সে কি আনন্দ। কারণ তিনি মনে মনে ওই পেঁপেগুলোকে ভাবতেন অত্যাচারী ইংরেজদের ন্যাড়া মাথা।

শৈশব কবি : শৈশব থেকেই নজরুলের কবি প্রতিভার আলো দেখা গিয়েছিল। কত কবিতা লিখেছেন তার অন্ত নেই। প্রতিটি কবিতাতেই নতুন ভাব, নতুন শব্দ চয়ন, স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি। ছোট্টবেলাতেই শেখ চাকর গোদা আর কাকা ফজলে করিমের প্রেরণায় দুখু আরবি, ফারসি, ইংরাজি শব্দ মিলিয়ে ‘লেটো’ গান লিখতেন। গান রচনা করে সুর দিয়ে গাইতেন। তোমাদের জন্য নজরুলের ছাত্রজীবনে লেখা একটি অপ্রকাশিত কবিতার কিছু অংশ তুলে দিলাম। কবিতাটি প্রয়াত কথাশিল্পী শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাছে পাওয়া গেছে। কবিতাটি একটি চড়ুই পাখিকে নিয়ে লেখা। ‘স্কুল ঘরের প্রথম শ্রেণীর উইলাগা ওই কড়ির ফাঁকে/ছোট্ট একটি চড়ুই ছানা কেঁদে কেঁদে ডাকছে মাকে/চুঁচুঁ রবের আকুল কাঁদন যাচ্ছিলরে বসন বায়ে/মায়ের পরাণ ভাবলে বুঝি দুষ্টু ছেলে নিচ্ছে ছা-য়ে/অমনি কাছের মাঠটি হতে ছুটলো মাতা ফড়িং মুখে/স্নেহের আশীষ আকুল জোয়ার উথলে উঠে মার সে বুকে’ ইত্যাদি।

ফুটবলার নজরুল : ফুটবল খেলায় নজরুলের খুব ঝোঁক ছিল। বর্ধমানের শিয়ারশোল হাইস্কুলের যখন ছাত্র ছিলেন, তখন থেকেই ভাল ফুটবল ব্যাক খেলতেন। যৌবনে ৪৯ নং বাঙালি পল্টনের করাচি শিবিরেও ফুটবল খেলেছেন। হুগলিতে বসবাসকালে চুঁচুড়া ময়দানে চুঁচুড়া টাউন ক্লাব ও চিনসুরা স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে খেলাধূলার জন্য যুক্ত ছিলেন। সে যুগের বিশিষ্ট ফুটবলার দেবেন্দ্রনাথ মন্ডল ও সুবল চন্দ্র পালের সাথে মধুর সম্পর্ক ছিল নজরুলের।

অহিংস কবি : নজরুল তখন গীতিকার হিসাবে সবার শীর্ষে। তার অভ্যাস ছিল বাড়িতে যাবার সময় গানের খাতাটি গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল রুমে রেখে যেতেন। তখন কোনও কোনও গীতিকার তার রচনার ভাবধারা অবলম্বন করে কিংবা তারই গানের রচিত কয়েকটি লাইন নিজের গানের সাথে সংযোজন করে দিতেন। কবির সেদিকে কোনও হুঁশ ছিল। না। একদিন কমল দাশগুপ্ত তাকে বললেন ঘটনাটি। শুনে তিনি কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে, বসে থেকে পরে হাসতে হাসতে বললেন, ‘আরে পাগল, মহাসমুদ্র থেকে কত কলসী আর নেবে।”

গোলাম মোস্তাফার সাথে কবির আদর্শগত বিরাট পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দু’জনের মধ্যে দেখা হলেই কবি আগে থেকে তাকে সস্নেহে আলিঙ্গন করতেন। কারো প্রতি কবি হিংসা করতেন না, এটা ছিল তার নীতিবিরুদ্ধ এবং কাউকে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী শত্রু মনে করতেন না।

নজরুলের রবীন্দ্রপ্রেম: নজরুল কবিগুরুকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন, আবার রবীন্দ্রনাথও নজরুলকে স্নেহ করতেন দারুণ। বিশ্বকবির প্রতি ভক্তি যে কতখানি অবিচল ছিল নজরুলের তা জানা যায়। বিদ্রোহী কবির জীবনী থেকে।

নজরুল নিজেই বলেছেন, “গুরুদেব, আমার খেলার মাঠে আপনার নামে এক বন্ধু নিন্দে করেছিল বলে আমি বাঁশের গোলপোস্ট উপড়ে তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছি।

শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, যাক, দুষ্টজনের হাত থেকে বাঁচার ভরসা পেলাম। আমার আর ভয় নেই।

১৯২২ সালে কবিগুরু নজরুলকে তাঁর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার জন্য যে আশীর্বাণী লিখেছিলেন, তাতে কবিগুরু নজরুলকে দেশের অর্ধচেতন জনগণকে তাদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলার জন্য বলেন :

‘জাগিয়ে দে-রে চমক মেরে,
আছে যা’রা অর্ধচেতন।

Photo Credit- google.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *