লেখক : পিনাকী রঞ্জন পাল
জলপাইগুড়ি শহরের শান্তি পাড়ার নকুলের চায়ের দোকানে প্রতিদিনের মতো আজও সকালে আড্ডা জমেছে। যার মধ্যমনি গদাধর বাড়ুই, এই এলাকায় যিনি গদাধর দাদু নামে পরিচিত, যিনি নিজেকে সবজান্তা বলে প্রমাণ করতে সর্বদা ব্যস্ত থাকেন। এতটা বয়স হলেও কথার গুল ছাড়তে কোনরকম দ্বিধা বোধ করেন না। আর এরজন্য বারবার সমস্যায় তাকে পড়তে হয়, কিন্তু তাতেও গদাধর দাদু দমবার পাত্র নন। আর এসব মজার কান্ডকারখানার জন্য সবাই দাদুকে খেপিয়ে দিয়ে মজা করে।
আজ দাদু ধোঁয়া উঠা চায়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে গভীর আলোচনা করছেন মোবাইল ফোনের ক্ষতিকারক দিক নিয়ে। দাদুর একটাই দাবি— “আমাদের সময় এগুলো ছিল না। তাই আমরা অনেক ভালো ছিলাম। এখনকার ছেলেমেয়েদের অবস্থা শোচনীয়!”
সামনেই চুপচাপ বসে আছে বখাটে রবি, গদাধর দাদুর পাশের বাড়িতেই সে থাকে। সে গদাধর দাদুর কথা শুনে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে মনে মনে। কারণ, দাদু যাই বলুক, এই কিছুদিন আগেই তিনিই নিজের প্রথম স্মার্টফোন কিনেছেন এবং ফেসবুকে অ্যাকাউন্টও খুলেছেন। কিন্তু কথার পিঠে কথা চাপিয়ে দাদু মোবাইলের থেকে নিজেকে অনেক দূরে রাখতে চান। আসলে জ্ঞান দিতে গদাধর দাদুর জুড়ি মেলা ভার।
এমন সময় দোকানের সামনে গড়গড় শব্দে এসে দাঁড়াল একদম ঝকঝকে নতুন মোটরসাইকেল নিয়ে রবির বন্ধু রোহিত। একেবারে চকচকে! চারিদিকে আলো কেমন ঝিকমিক করছে। দোকানের সবাই মুগ্ধ হয়ে বাইকটার দিকে তাকিয়ে রইল।
দাদু সবার মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে একটু গম্ভীর হলেন। চোখ একটু কুঁচকে বাইকের দিকে তাকিয়ে নিজের স্বভাবমতই ফোড়ন দিয়ে বললেন, “এ আবার কিসের বাহাদুরি? আমাদের সময়ও আমরা রাস্তায় সাইকেল নিয়ে হুশ্ করে চলে যেতাম। এই বাইক চালানো কোনো ব্যাপার না!”
রবি সঙ্গে সঙ্গে মুখ টিপে হাসল। সে জানে, দাদুর বাহাদুরির গল্পগুলো এমনই অদ্ভুত। কিন্তু আজ রবি একটু অন্যরকম কিছু করতে চাইল। সে মৃদু হেসে বলল, “দাদু, আপনি তো কতকিছু পারেন। এই বাইক চালাবেন নাকি?”
এই কথায় দাদু থমকালেন। চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, “মোটরসাইকেল! আমি চালাতে পারব না, সে কি হয়?” তাঁর স্বরে আত্মবিশ্বাস ঝরে পড়ল। চায়ের দোকানের সবাই থমথমে মুখে দাদুর দিকে তাকিয়ে রইল।
রোহিত সঙ্গে সঙ্গে চাবিটা এগিয়ে দিল, “দাদু, যদি চালাতে পারেন তো দেখিয়ে দিন। আমরা সবাই দেখি, আপনার চালানো।”
রবি তো মনে মনে হাততালি দিতে লাগল। কারণ সে জানে, দাদু একবার চ্যালেঞ্জ নিলে, সেটাকে যে করেই হোক, করেই ছাড়বে।
দাদু একটু গম্ভীর মুখে বাইকের দিকে এগোলেন। মাথার মধ্যে নানান হিসাব করতে করতে বাইকের সিটে বসলেন। রবি সতর্ক চোখে লক্ষ করছিল, কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে দাদুকে ধরতে হবে। দোকানের সামনে ভিড় জমে গেছে। সবাই এমন একটা ঘটনা দেখার জন্য উদগ্রীব। দাদু বাইকের হ্যান্ডেল ধরে, একবার ঘাড় নেড়ে বললেন, “আমার সময় এইসব গাড়ি ছিল না। কিন্তু মানুষ যদি একবার সাইকেল চালাতে পারে, তাহলে মোটরসাইকেলও পারবে।”
রোহিত হেসে বলল, “দাদু, আপনি গিয়ারটা চেপে ক্লাচ ছাড়ুন, আর অ্যাক্সিলেটর ঘোরান। ব্যস!”
দাদু কিছুই বুঝলেন না, কিন্তু একবার চেষ্টা করতে পিছপা হলেন না। হাত দিয়ে ক্লাচ ধরলেন, পা দিয়ে গিয়ার চাপলেন, আর অ্যাক্সিলেটর ঘুরিয়ে দিলেন পুরো জোরে।
বাইকের ইঞ্জিন হঠাৎ করে গর্জে উঠল, আর দাদু প্রায় উড়ে চললেন সামনে! চায়ের দোকানের সবাই চিৎকার করতে লাগল, “দাদু! দাদু! সামলে যান!” কিন্তু ততক্ষণে দাদু বাইক নিয়ে রাস্তায় ঝড়ের মতো দৌড়াচ্ছেন।
রাস্তায় যে যেমন ছিল, থমকে দাঁড়িয়ে গেল। দাদুর মাথার সাদা চুল হাওয়ায় উড়ছে। বাইকটি এমন গতিতে ছুটছে যে মনে হচ্ছে দাদু যেন একেবারে আকাশে উড়ে চলে যাবেন!
রবি আর রোহিত হতভম্ব হয়ে দৌড় দিল। “এই বয়সে দাদু এমন বাইক চালাচ্ছেন!”
দাদু তো বাইকের ওপর একেবারে ধাতস্থ নেই। সামনে গিয়ে হঠাৎ দেখলেন, শান্তি পাড়ার মোড়ের সামনে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। দাদু চিৎকার করে বললেন, “সাবধানে! আমি আসছি!” কিন্তু তাঁরা যে শুনবে, তার সময় নেই। দাদু ব্রেক ধরার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ক্লাচের বদলে অ্যাক্সিলেটর চাপলেন আরও জোরে।
সবাই চমকে সরে গেল। দাদু বাইক নিয়ে একটা পানের দোকানের সামনে এমন ধাক্কা মারলেন যে বাইক উলটে দোকানের মাঝখানে গিয়ে পড়ল। দোকানের পান, বিড়ি, সিগারেট— সব কিছু চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আর দাদু পুরো ফাঁকায় গিয়ে পড়ে রইলেন দোকানের সিলিং ফ্যানের তলায়।
সবাই একসঙ্গে ছুটে এল। পানের দোকানদার তো প্রায় কাঁদো কাঁদো। দাদুকে দেখে মনে হচ্ছে, যেন কোন সাইকেল-দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে পড়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দাদু প্রায় অক্ষত। তিনি ধুলো ঝেড়ে উঠে বললেন, “এই বাইক ঠিক নেই! এর সব যন্ত্রপাতি ভুলভাল আছে!”
রোহিত তো হেসে অস্থির। বলল, “দাদু, যন্ত্রপাতির কোনো ভুল নেই। ভুল আপনার ক্লাচ ধরার।”
দাদু মুখ গম্ভীর করে বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি বুঝেছি। তবে তোমরা জানো তো, এই সব আধুনিক যন্ত্র নিয়ে এত খেলতে নেই। আমাদের সময়…”
রোহিত মাঝখানেই বলে উঠল, “দাদু, আপনার সময়টা তো একটু বেশিই আধুনিক হয়ে গেল!”
সবাই হাসির রোল তুলল।
আর দাদু, সেই চিরাচরিত গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন, “হাসো, হাসো। আমি তো বলছি, একদিন না একদিন তোমাদের দেখাব, কিভাবে চালাতে হয়!”
সেই দিন থেকে পাড়ার মোড়ে নতুন গল্প চালু হয়েছে— দাদুর বাইক চালানোর কাহিনি। যতই দাদু নিজের গাম্ভীর্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন, পাড়ার কেউ তাঁর মুখের হাসি আর থামাতে পারে না।
© পিনাকী রঞ্জন পাল