অরুণ কুমার
ডুয়ার্স, অপরূপা ডুয়ার্স ভারত ভুটান সীমান্ত লাগোয়া নদী আর পাহাড় ঘেরা নতুন গ্রাম ‘বনছায়া’। ভুটান পাহাড় থেকে নেমে আসা রাইমাটাং ও গিয়ালটং নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঘেরা এই গ্রাম। আলিপুরদুয়ার জেলার কালচিনি ব্লকের এই সুন্দর গ্রামটি গড়ে উঠেছে বিগত প্রায় দুই বছরে। জানা গেছে মোট ৬৫ টি পরিবারের আড়াই শতাধিক জনসংখ্যা নিয়ে এই গ্রাম সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। যার ৯৯% মানুষ স্বাক্ষর। ৯০ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত।

আত্মনির্ভরতা, সংস্কৃতি চর্চা, পরিবেশ সংরক্ষণ সহ নানান দিক থেকে তারা এগিয়ে আছে। স্থানীয় সমাজসেবী প্রকৃতির উপাসক আর্ট অফ লিভিং এর মেন্টর সমাজসেবী ও প্রাক্তন জেলা পরিষদ সদস্য রামকুমার লামা এই গ্রামকে অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে আগামী দিনের বিভিন্ন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করেছেন।

ইতিমধ্যে এখানে অনেকগুলি হোমস্টে তৈরি হয়ে গেছে আতিথেয়তা ও অন্যান্য দিক থেকে। এগুলি সরকারি অনুমোদন লাভ করেছে এবং তাদেরকে আতিথেয়তার ক্ষেত্রে দক্ষ করে তোলা হয়েছে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে।

পর্যটকরা এখানে এলে থাকতে পারবেন, উপভোগ করতে পারবেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত খাদ্য সামগ্রী। স্থানীয় মানুষের আতিথেয়তায় আন্তরিকতা যেমন রয়েছে তেমনি তুলে ধরার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে।
এই বনছায়া গ্রামের মাঝে কয়েক দিন থাকলে আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করার এক আদর্শ জায়গা হল এটি।

ভারত ভুটান সীমান্ত লাগোয়া আলিপুরদুয়ারের কালচিনির “বনছায়া” গ্রামের মহিলারা ব্যস্ত রবীন্দ্র লোক সঙ্গীত চর্চায় পর্যটকদের মনোরঞ্জনের লক্ষ্যে।
এই গ্রামে আপনাকে প্রভাতী শুভেচ্ছা জানাবে মোরগ ময়ূর আর বুলবুল পাখির ডাক।
রাতে ভুটান পাহাড় থেকে নেমে আসা ঠান্ডা বাতাস আপনাকে অনাবিল আনন্দ দেবে। রাতের বৃষ্টি আপনাকে অনুভব করাবে কবিতার ছন্দ।
নানান ধরনের ফুল আপনাকে তরতাজা করে রাখবে। জনজাতি মানুষের শিশুদের নিষ্পাপ হাসি আপনাকে দেবে এক অসাধারণ অনুভূতি।
মাত্র আঠারো মাসে গড়ে উঠেছে এই বনছায়া গ্রাম নানাভাবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রাকৃতিক সম্পদকে উপলক্ষ করে। নানান ধরনের সবুজ সতেজ জৈব পদ্ধতির উৎপাদিত শাকসবজি তারা চাষ করছে, বিভিন্ন ফলের গাছ লাগিয়েছে। আগামী দিনে সেগুলো ফল দেবে, সেই সঙ্গে রয়েছে ব্যবহার করা ফুলের গাছ যার মধ্যে রয়েছে নানান রঙের জবা, গোলাপ, সহ নানান রং বেরঙের ফুল ও অর্কিড।
এই গ্রামের আশেপাশের যে জায়গাগুলি রয়েছে সেগুলি হল ভাটপাড়া চা বাগান, মেচ পাড়া চা বাগান হয়ে সোজা রায়মাটাং নদী পেরিয়ে রায়মাটাং বস্তি এবং তারপর বক্সা পাহাড় যাওয়ার রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। অপরদিকে আলিপুরদুয়ার থেকে রাজাভাতখাওয়া এলে সেখানে প্রজাপতি পার্ক, রাস্তায় পড়বে ‘বইগ্রাম’, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র ছাড়াও বক্সা যাওয়ার রাস্তা এখান দিয়েও রয়েছে। সরকারি অনুমতি নিয়ে সেখানে যাওয়া যায়। বক্সায় একসময়ের জেলখানা ছিল ব্রিটিশ জমানায়, যেখানে পালিত হয়েছিল কবিগুরুর জন্মদিন এবং তাকে কেন্দ্র করে যে কবিতা কবিগুরু রচিত রচনা করেছিলেন সেই কবিতার ফলক অন্যতম স্মারক হিসেবে রয়েছে, বক্সায় গেলে সেটা দেখা যাবে। সেখান থেকে আদমা, সিন্চুলা হয়ে ঘুরে এসে ক্লান্ত হয়ে যখন বসবেন এই বনছায়া গ্রামের কোন এক জায়গায়, রাতে ভুটান পাহাড় থেকে নেমে আসা শীতল বাতাস আপনাকে এনে দেবে অনাবিল অনুভূতি। রাতে বৃষ্টির থেমে থেমে আসা শব্দ আপনাকে অনুভব করাবে কবিতার ছন্দ প্রকৃতির অপরূপ শব্দমালা।
পূর্ব ডুয়ার্সের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য নদীর যার মধ্যে অন্যতম হলো রাইমাটাং ও গিয়েলটং। ভুটান পাহাড় থেকে নেমে আসা এই নদীর সৌন্দর্য অপরূপ যা বর্ষার দিনগুলিতে আপনাকে মোহিত করে রাখবে সব সময়। ডুয়ার্সের ভূপ্রাকৃতিক সাংস্কৃতিক লোকসংস্কৃতিক পরিবেশে আপনাকে এনে দেবে এক সাংস্কৃতিক স্বাচ্ছন্দ
এই অঞ্চলের অনেক লোককথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নদীকে কেন্দ্র করে। নদীর জনজীবন মাছ ধরার কাহিনী পাহাড় থেকে নেমে আসা ভেসে আসা কাঠ গাছের গুড়ি সংগ্রহ করার অনেক গল্প রয়েছে।
এমন এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা রায়মাটাং এবং
গিয়েলটং নদীর ধারে অবস্থিত সুন্দর ছবির মত সাজানো ‘বনছায়া’ গ্রাম নতুন ভাবে গড়ে উঠেছে আলিপুরদুয়ার জেলার কালচিনি ব্লকের ভারত ভুটান সীমান্ত ঘেঁষা এই জায়গায়।
জানা গেছে এখানকার জনসংখ্যা ৬৫ টি পরিবারের মধ্যে সীমিত এবং জনসংখ্যা ২৫০ এর একটু বেশি। আগে তারা বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের অধীনে ছিল। সরকারি নির্দেশ নামার ফলে তাদেরকে সরিয়ে এনে এই নতুন জায়গায় ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং এই গ্রামটির নাম দেওয়া হয়েছে বনছায়া।
আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে ৪২ কিঃমিঃ ও কালচিনি স্টেশন থেকে মাত্র ৮ কি:মি: দূরত্বে রয়েছে এই গ্রাম। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই উন্নত।
সরকারিভাবে যদিও এই এখানে বসবাসকারী মানুষদের পর্যাপ্ত জমি ও অর্থ প্রদান করা হয়েছে সেই সঙ্গে এখানকার পরিকাঠামোগত সুবিধা উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে জল নিকাশি ব্যবস্থা পাশাপাশি বিদ্যুৎ পানীয় জল এসব যেমন দেওয়া হয়েছে সেই সঙ্গে খেলার মাঠ কমিউনিটি হল তৈরির প্রস্তুতি চলেছে। স্বাস্থ্য কেন্দ্র, স্কুল এগুলো সব কাছাকাছি থাকায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা পাকা রাস্তা হওয়ার কারণে অটো, টোটো এবং নিজস্ব বাইক, স্কুটি থাকায় কোন অসুবিধা নেই বলে আদিবাসীদের কাছ থেকে জানা গেছে। এখানকার বসবাসকারী অধিকাংশই তামাংরাই সম্প্রদায়ের, যারা সংস্কৃতিগতভাবে খুবই সমৃদ্ধ এবং তার ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর।
এখানে এলে প্রতিদিন সকালে আপনার ঘুম ভাঙবে ময়ূর মোরগ এর ডাকে। সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে আপনি আকাশে উড়ে উড়ে যেতে দেখতে পাবেন এক ঝাঁক পায়রা, টিয়া পাখি সহ শুনতে পাবেন ধনেশ পাখির ডাক বুলবুল পাখির ডাক এবং মাঝে মাঝে কোয়েল কোকিলের ডাক। দূরের জঙ্গলে থাকা ময়ূর এর দল মাঝে মাঝে দেখা দেবে, আবার হরিণের দল দেখা মিলবে রায়মাটাং নদীর মাঝে।
যা আপনাকে প্রকৃতির মাঝে সম্পৃক্ত হতে সাহায্য করবে। আপনি হারিয়ে যাবেন এক অদ্ভুত জগতে।
স্থানীয় মানুষের আতিথেয়তা তাদের জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত শাকসবজি তৈরি খাদ্য সামগ্রী আপনাকে তৃপ্তি দেবে। এখানকার জল স্বাস্থ্যকর হওয়ায় আপনি স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে সমর্থ হবেন। অপরদিকে যোগা প্রাণায়াম যদি আপনি করেন তাহলে সেটা হবে উপযুক্ত জায়গা এখানে এলে। স্থানীয় অধিবাসীদের শিশুদের মিষ্টি হাসি আপনাকে আনন্দ দেবে।
পরিশ্রমী মহিলারা তাদের হাতের কাজ বুনন নিয়ে ব্যস্ত থাকে সেটা দেখেও স্বয়ংভরতার এক আলাদা ছবি ফুটে উঠবে আপনাদের সামনে। তামাং ও রাই মহিলারা সমবেত কন্ঠে তাদের লোকসংগীত লোকনৃত্য পরিবেশন করার পাশাপাশি বাংলায় রবীন্দ্র সংগীত স্বাগতম নৃত্য তারা রপ্ত করেছে ইতিমধ্যেই যা বলতে গেলে এক নতুন দিগন্ত সূচনা হতে চলেছে এই গ্রামকে কেন্দ্রকে করে আর এটাই হলো এই দ্রুত গড়ে ওঠা গ্রামের বৈশিষ্ট্য।
আর এভাবেই এখানকার প্রাকৃতিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আগামী দিনে পর্যটকদের সামনে এক নতুন দিশা বা পর্যটকদের জন্য ডেস্টিনেশন তৈরি হতে চলেছে এই বনছায়া গ্রাম।