পিনাকী রঞ্জন পাল : ফুটবল যে কেবল একটি খেলা নয়, বরং জীবন বদলে দেওয়ার হাতিয়ার হতে পারে, তার অনন্য উদাহরণ রবি হাঁসদা। পূর্ব বর্ধমানের ভাতার থানার মশারু গ্রামের এই আদিবাসী তরুণের জীবন কাহিনি কেবল অনুপ্রেরণার নয়, এটি সামাজিক বৈষম্য এবং সংকট জয় করার গল্পও। যেখানে কঠিন সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, এবং অবিচল সংকল্পের মিশেলে তৈরি হয়েছে তাঁর ফুটবল জীবন। আর্থিক টানাপোড়েন, পারিবারিক বিপর্যয়, এমনকি গুরুতর চোট—সবকিছুর মধ্যেও রবির লক্ষ্যে অবিচল থাকা কেবল বাংলার ফুটবলকেই নয়, বরং সমস্ত ক্রীড়া প্রেমিকদের প্রেরণা জোগাবে।
সংগ্রামের মাটিতে পা রেখে স্বপ্নের পথে যাত্রা
রবি হাঁসদার গল্প শুরু হয় এক আদিবাসী পরিবারে, অভাবের সংসার। যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। বাবা কৃষিকাজ করতেন, মা সামান্য যা চাষবাস করতেন, তাই দিয়ে চলত হাঁসদা পরিবারের দিনযাপন। এই প্রেক্ষাপটে ফুটবল খেলার স্বপ্ন দেখা ছিল একপ্রকার বিলাসিতা। তবুও গ্রামের মাটির খেলার মাঠেই রবির ফুটবলের হাতেখড়ি।
জনাইয়ের ফুটবল কর্তা অসিত রায়ের হাত ধরে কাশীপুর সরস্বতী ক্লাবে খেলার সুযোগ পান। সেখান থেকেই শুরু হয় রবির পেশাদার ফুটবল ক্যারিয়ার। রেনবো ক্লাব এবং কাস্টমসের হয়ে তাঁর অসাধারণ খেলার সুবাদে জাতীয় গেমসে বাংলার প্রতিনিধিত্বের সুযোগ মেলে।
সংগ্রামের শিকড়
২০২৩ সালে হাঁটুতে গুরুতর চোট পাওয়ার পর যখন মাঠ থেকে ছিটকে যেতে হয়েছিল, তখন রবির জীবন এক অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছিল। ‘খেপ’ খেলেই তখন তাঁর রোজগারের মূল পথ। চোটের কারণে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বাবার আকস্মিক মৃত্যু যেন তাঁকে আরও বিপর্যস্ত করে তোলে। একসময় ফুটবল ছেড়ে টোটো চালানো কিংবা চাষবাস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি।
আলো দেখালেন পরামর্শদাতারা
কাস্টমস ক্লাবের কর্মকর্তারা তখন তাঁর পাশে দাঁড়ান। তাঁকে মাঠে ফেরানোর জন্য মানসিক ও আর্থিক সাহায্য দেন। এই সহযোগিতাই তাঁকে তাঁর স্বপ্নপথে ফিরিয়ে আনে। চোট সারিয়ে ফিরে আসার পর কলকাতা লিগে ৯টি গোল করে ফের নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন রবি।
সন্তোষ ট্রফিতে রবির ম্যাজিক
চলতি সন্তোষ ট্রফি রবির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। কল্যাণীতে বাছাই পর্ব থেকে হায়দরাবাদে মূলপর্ব—রবি হাঁসদার ঝুলিতে ইতিমধ্যে ১১টি গোল, যা তাঁকে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্কোরার করেছে। তাঁর ফুটবল নৈপুণ্য সঞ্জয় সেনের প্রশিক্ষণাধীন বাংলার দলকে ফাইনালে তোলে। এখন রবির একমাত্র লক্ষ্য সন্তোষ ট্রফি জিতে বাংলাকে চ্যাম্পিয়ন করা এবং নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারের নতুন দিগন্ত খুলে দেওয়া।
লক্ষ্যের দিশায় রবি
রবি হাঁসদার সামনে এখন তিনটি বড় লক্ষ্য। প্রথমত, সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা দলকে চ্যাম্পিয়ন করা। দ্বিতীয়ত, আইএসএলে জায়গা করে নেওয়া এবং সফল স্ট্রাইকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। আর তৃতীয়ত, জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলা। এই স্বপ্নগুলির জন্য তিনি লড়াই করে চলেছেন শুধু নিজের জন্য নয়, তাঁর মা, স্ত্রী, এবং ছোট্ট মেয়ে রিমির জন্যও।
বাংলার ফুটবলের নতুন ভোর
রবির উত্থান বাংলার ফুটবলের জন্য এক আলোকবর্তিকা। সুনীল ছেত্রীর মতো খেলোয়াড়দের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ে নিজের জায়গা তৈরি করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। তাঁর গল্প একদিকে যেমন ফুটবলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশার আলো দেখাচ্ছে, অন্যদিকে সমাজকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে প্রতিভা কখনও প্রতিকূলতার কাছে হার মানে না।
শেষ কথা
রবি হাঁসদা কেবল একজন ফুটবলার নন, তিনি সংগ্রাম আর সাফল্যের প্রতীক। তাঁর গল্প আমাদের শেখায় যে জীবন কতই না কঠিন হোক, স্বপ্ন যদি দৃঢ় হয় আর লড়াই যদি অবিরাম হয়, তবে সাফল্যের দরজা খুলবেই। ২০২৫ সালে বাংলার ফুটবল রবির আলোয় উদ্ভাসিত হবে—এটাই সকলের প্রত্যাশা।