জনশ্রুতি আছে যে, আগে এলাকার কোন দুঃস্থ পরিবারের বিয়ে বা কোন অনুষ্ঠানের সময় চালনকুলা সহ শুদ্ধাচারে মন্দির সংলগ্ন পুকুর পাড়ে এসে শুধু থালা-বাসন সহ প্রয়োজনীয় পাত্র চাইতে হত। পরদিন সকালে আশ্চর্যজনকভাবে সকল কিছুই মিলতো পুকুরপাড়ে।
পঙ্কজ সেন : জলপাইগুড়ি শহর সংলগ্ন অরবিন্দ গ্রাম পঞ্চায়েতের মোহিতনগর করলা ভ্যালী চা বাগানের মাঝে এক সুন্দর মনোরম পরিবেশে করলা নদীর তীরে অবস্থান লোটা দেবী কালী মন্দিরের। মায়ের গায়ের রং মূলতঃ হালকা নীল। প্রতিবছর মাঘী পূর্ণিমায় লোটা দেবীর বাৎসরিক কালী পূজা অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে অনুষ্ঠিত হয়। সেইসঙ্গে মন্দিরের পার্শ্ববর্তী খোলা মাঠে চার পাঁচ দিনের এক বড় মেলার আয়োজন করে থাকে পূজা কমিটি। বাৎসরিক পুজোতে প্রতিবছর সুদূর চন্দননগর থেকে আলোর ব্যবস্থা করা হয়।

জাতীয় সড়ক থেকে নেমে মন্দিরে যাওয়ার রাস্তাটা ক্রমশ নিচের দিকে নেমেছে। বাৎসরিক পুজোর সময় জনসাধারণের যাতায়াতের জন্য করলা নদীর উপর বাঁশ ও কাঠের এক অস্থায়ী সেতু নির্মাণ করা হয়। লোকমুখে প্রচারের ফলে এবং মায়ের পূজায় উপস্থিত থাকার জন্য এখন দূর দূরান্ত থেকে অসংখ্য পূর্ণার্থী এখানে উপস্থিত হন। বাৎসরিক পুজোতে আগত পুণ্যার্থীরা অসংখ্য পায়রা মন্দির প্রাঙ্গনে ছেড়ে দেয়। বাৎসরিক পুজো শেষে শিবরাত্রির পরে এই অস্থায়ী বাঁশের সেতু তুলে দেওয়া হয়। এই সময় পরবর্তীতে ভক্তেরা মায়ের পূজো দিতে চাইলে তাকে করলা ভ্যালি বাগানের ভিতর দিয়ে ঢুকে আসতে হয়।

করোনার জন্য দু’বছর অত্যন্ত সাধারণভাবে পুজো হলেও ২০২৩ সালে লোটা দেবীর পূজার ৬৬ তম বর্ষ পালিত হয়েছে। জনশ্রুতি আছে যে, আগে এলাকার কোন দুঃস্থ পরিবারের বিয়ে বা কোন অনুষ্ঠানের সময় চালনকুলা সহ শুদ্ধাচারে মন্দির সংলগ্ন পুকুর পাড়ে এসে শুধু থালা-বাসন সহ প্রয়োজনীয় পাত্র চাইতে হত। পরদিন সকালে আশ্চর্যজনকভাবে সকল কিছুই মিলতো পুকুরপাড়ে। উল্লেখ্য যে, এই বাসনের সঙ্গে একটি করে ঘটি থাকতো। বিহারী ভাষায় ঘটি’কে লোটা বলে। সেই থেকেই মায়ের মন্দিরের নামকরণ হয়, “লোটা দেবীর মন্দির”।

দুধ-কলা ও বাতাসা হল মায়ের আসল প্রসাদ। অবশ্য পুজোর সময় দেবীকে খিচুড়ির সাথে বোয়াল মাছ ভাজা ভোগ হিসেবে নিবেদিত হয়। সেইসঙ্গে পুজোর সময় পাঁঠা বলি দিয়ে তার নিরামিষ মাংস (পেঁয়াজ ও রসুন ছাড়া) মাকে ভোগ দেওয়া হয়। পূর্বের মতো বাৎসরিক পূজোয় মায়ের ভোগের রান্নার সম্পূর্ণ আয়োজন আজও দেবেন্দ্র মোহন করের বাড়িতেই করা হয়। বর্তমানে মন্দিরটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজানো থাকলেও পঞ্চাশের দশকে কিন্তু আজকের মত কংক্রিটের মন্দির ও পরিবেশ ছিল না। ১৯৫৭ সালে মায়ের পুজো হতো মাটির থানে বাঁশ ও ছনের চালাতে। স্বর্গীয় দেবেন্দ্র মোহন কর, বাঞ্ছারাম দত্ত সহ আরোও কয়েকজন ছিলেন এই পুজোর অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। মন্দিরটি গড়ে ওঠার পূর্ব সময়ে দেবেন্দ্র বাবু এখানকার পুকুরে মাছ ধরতেন এবং সেই সময় একটি ছোট মেয়ে প্রতিদিন এসে তার সাথে দেখা করতেন। কিন্তু দেবেন্দ্র বাবু তাকে বিশেষ পাত্তা দিতেন না।
আরো পড়ুন : সংবর্ধনায় আপ্লুত জলপাইগুড়ির নবম শ্রেণীর ছাত্রী মণিকা রাহা
অবশেষে চতুর্থ দিনে দেবেন্দ্রবাবু রাত্রে মায়ের স্বপ্নাদেশ পান, যে এই স্থানে তার মন্দির গড়ে পুজো করতে হবে। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় লোটা দেবীর মাহাত্ম্য। তখন হ্যাজাক দিয়ে কলার ভেলায় সাঁকো বানিয়ে পুজো হতো। প্রথম থেকেই এই মন্দিরে মানুষের জনসমাগম ছিল। মন্দির লাগোয়া পুকুরটিতে বেশ কিছু বিরল প্রজাতির কচ্ছপ ও মাছ রয়েছে। পূর্বে পুকুরটিতে শাল, বোয়াল, কালবস, টাকি, শরপুটি, রুই ইত্যাদি মাছ দেখা গেলেও বর্তমানে মাছের সংখ্যা পূর্বাপেক্ষা অনেক কম। মাছগুলির মাথায় সিঁদুরে আভা দেখা যায়। সেটা দেখতেও ভিড় করেন দর্শনার্থীরা। এই পুকুরটির একটি অন্যতম বিশেষত্ব হলো, এখানে যতই দুধ ঢালা হোক না কেন, তা কখনোই জলের সাথে একসঙ্গে মিশবে না এবং ধীরে ধীরে দুধ পুকুরের একদম নিচে নেমে যায়।
আরো পড়ুন : সফল চন্দ্রযান ৩ অভিযানে সামিল জলপাইগুড়ির কৌশিক, খুশির হাওয়া শহর জুড়ে
প্রথমে পূর্ণাথীরা সংলগ্ন পুকুর পাড়েই মোম ও ধুপকাঠি প্রজ্বলন করতো, এবং পুকুরের জলে দুধ ও ঘি ঢালা হত। কয়েক বছর আগে একটি পরিবেশপ্রেমী সংগঠন এই পুকুরটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেয়। মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে ভক্তদের ধুপকাঠি ও মোমবাতি জ্বালানোর জন্য একটি পৃথক ব্যবস্থা করা হয়েছে।

উপাসনা স্থান, তা সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, মানুষের বিশ্বাস, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা মিলিয়ে একটা সুন্দর পবিত্র পরিবেশ রচনা করে। এখানে নদী পার হয়ে মন্দিরে প্রবেশের সময় মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখবেন চারিপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সম্ভার তার অনুপম ডালি নিয়ে আপনার সামনে উজাড় করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে মায়ের শ্রীমুখ দর্শন করে আপনার সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। মন ভরে উঠবে শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে।
ছবি লেখক