লেখক পঙ্কজ সেন
জলপাইগুড়ি শহরের তিন নম্বর ওয়ার্ড হাকিম পাড়ায় পিডব্লিউডি মোড়ে টিনের শেড দেওয়া সুদৃশ্য কাঠের বাড়িটি কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ন ১৮৭৮ সালে নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য যে, ১৮৭৮ সালের ৬ই মার্চ নববিধান ব্রাহ্মসমাজের প্রবর্তক কেশবচন্দ্র সেনের জ্যেষ্ঠ কন্যা সুনীতি দেবীর সঙ্গে কোচ মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের বিবাহ সম্পন্ন হয়। জলপাইগুড়ি শহরে করলা নদীর পূর্ব দিকে অবস্থিত এই বাড়িটি বর্তমানে ‘আয়রন হাউস’ বা ‘মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ন হলঘর’ নামে পরিচিত। আবার অনেকের কাছে বেশি পরিচিত ‘নাচ ঘর’ নামে। এছাড়া বাড়িটি পূর্বে কোচবিহারের মহারাজার কুঠি নামেই পরিচিত ছিল। ভবনটির প্ল্যানকিং মজবুত শাল তক্তার। সিমেন্টের বেশ কিছু পাকা খুঁটির উপর এই ভবনটি প্রতিষ্ঠিত এবং তার দেওয়ালগুলি কাঠের। ২.০৭ একর জমির উপর গড়ে উঠেছে এই নৃপেন্দ্র নারায়ন হল। যে সব নকশা করা কাঁচ ভবনটিতে লাগানো হয়েছিল তা সুদূর বেলজিয়াম থেকে আনা। লোহার ফ্রেমের উপরে বাঁকানো টিনের ছাউনি রয়েছে যা আজও মরচে ধরেনি। ভবনটি লোহার পরিকাঠামোর উপর নির্মাণের জন্য ‘আয়রন হাউজ’ নামে পরিচিত লাভ করেছে।

কোচবিহারের রাজাদের জমিদারির অংশ ছিল বৈকুন্ঠপুর তথা জলপাইগুড়িতে। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়নের বিবাহ উপলক্ষে বৈকুণ্ঠপুর ও বোদা চাকলার নিমন্ত্রিত অতিথিদের আদর-আপ্যায়ন এবং আনন্দ-উৎসব করার জন্য এই সুসজ্জিত কাঠের বাড়িটি নির্মাণ করা হয় বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। মাত্র একদিনের জন্য মহারাজার বিবাহের শুভেচ্ছা বিনিময়কে ঘিরে এখানে নাচের আসর বসেছিল। সেখানে সাহেব এবং মেম সাহেব সহ আরো গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সেই থেকে এই ঐতিহ্য সম্পন্ন ভবনটি ‘নাচ ঘর’ নামেও পরিচিত। যদিও প্রবীনদের অনেকেই বাড়িটিকে ‘নৃপেন্দ্র নারায়ন হলঘর’ বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকেন। বিয়ে অনুষ্ঠানের পর এই বাড়িতে দ্বিতীয় বার মহারাজের পা পড়েনি।

১৮৮৫ সালে এই বাড়িতেই শুরু হয়েছিল জলপাইগুড়ি পুরসভার প্রথম কার্যালয়। সেই সময়ে পুরসভার নিজস্ব কোন ভবন ছিল না। পুরসভার কাজকর্ম সম্পাদন করার জন্য নির্দিষ্ট হলটির মাসিক ভাড়া ছিল মাত্র কুড়ি টাকা। ১৮৮৯ সালে পুরসভা তার বর্তমান স্থানে চলে আসে। আবার ১৮৮৭ সালে এখান থেকেই জেলা ইউনিয়ন বোর্ড বা জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের কাজের সূচনা হয়। ভারতের স্বাধীনতার পর বাড়িটি স্কুল বোর্ডের অধীনে চলে যায়। ১৯৬৮ সালের তিস্তা নদীর মহা বন্যায় জলপাইগুড়ি শহর বিধ্বস্ত হলেও নৃপেন্দ্র নারায়ন হলঘরের এতটুকু ক্ষতি হয়নি। বর্তমানে এই সুদৃশ্য কাঠের বাড়িটি জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শকের অফিস হিসেবে পরিচিত। যদিও অবহেলায় এখন তা পরিত্যক্ত বাড়ির চেহারা নিয়েছে।

অফিসের সময় কিছু মানুষের আনাগোনা থাকলেও অন্য সময় নিকষ কালো আঁধারে ডুবে থাকে। মনে করা হয় যে, এটাই জলপাইগুড়ি শহরের সব থেকে প্রাচীন সরকারী ভবন যা এখনো তার পূর্বের চেহারায় অক্ষত রয়েছে। ষাটের দশকে এই অফিস থেকেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন বই বিক্রি বা সরবরাহ করা হতো। ঐতিহ্য সম্পন্ন প্রাচীন এই সুসজ্জিত ভবনটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের আওতায় রয়েছে। জলপাইগুড়ি জেলা ও কোচবিহার জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত এই নৃপেন্দ্র নারায়ন হলঘর।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : উমেশ শর্মা।