পঙ্কজ সেন : উত্তরবঙ্গ তথা জলপাইগুড়ি জেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো শহরের বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির ৫১৪ বছরের ঐতিহ্যবাহী মনসা পূজো।

বৈকুণ্ঠপুর রাজপরিবারের ইতিহাসে মনসা পুজোর সর্বপ্রথম প্রচলন করেন রাজা শিষ্য সিংহ এবং তারপর থেকে বংশানুক্রমিকভাবে তা আজো চলে আসছে। এই পুজোর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো মন্দির প্রাঙ্গণে বিষহরি গানের আসর। দূর-দুরান্ত থেকে অগণিত শিল্পী এখানে উপস্থিত হন বিষহরি পালা গান গাইতে ও শুনতে। পুজোকে কেন্দ্র করে রাজবাড়ী প্রাঙ্গণে পাঁচ দিনের এক বড় মেলা বসে এবং অসংখ্য ভক্তের সমাগম হয়। মেলাটি বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে জীবিকার উৎস। খাবারের দোকান থেকে শুরু করে সকল রকম জিনিসের সম্ভার এই মেলাতে পাওয়া যায়। তবে অতিমারি করোনার জন্য ২০২০ এবং ২০২১ সালে যাতে অত্যাধিক জনসমাগম না হয় তাই মেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়ির বর্তমান রাজপ্রতিনিধি প্রণত কুমার বসুর (রাজকন্যা প্রতিভা দেবীর পুত্র) মতে, প্রতি বছর রথের উৎসবের দিন দেবী মনসার কাঠামো পুজো করা হয়ে থাকে। রাজবাড়ীতে মনসার নিত্য পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মা মনসার বিগ্রহ এখানে হংস বাহিনী, পদ্মাসনা। ঐতিহ্যবাহী রাজবংশী সংস্কৃতির এই পুজো মন্ডপে মনসা দেবীর পাশাপাশি অষ্টনাগ, মা পদ্মা, নেতি ধোপানি, জরৎকারু মুনি, বেহুলা-লক্ষিন্দর, এবং গদা-গদানির মূর্তি থাকে। জরৎকারু মুনির ডান দিকে বসে রক্তবর্ণা পদ্মা এবং বাঁদিকে অবস্থান করে গৌরবর্ণা নেতি। নেতিকে বড় মনসা হিসেবে এবং পদ্মাকে ছোট মনসা হিসেবে পুজো করা হয়। সহচর-সহচরী পরিবেষ্টিত হয়ে মা এখানে পূজিত হন।

এমনিতে দেবী মনসার ভোগ দুধ ও কলা হলেও বৈকুন্ঠপুর রাজবাড়িতে মাকে আমিষ ভোগ প্রদান করা হয়। পুজোতে মায়ের উদ্দেশ্যে পাঁঠা,পায়রার পাশাপাশি পঞ্চ ফল বলি হিসেবে নিবেদিত হয়। মায়ের ভোগ হিসাবে তিন দিন পোলাও, ভাত, বলির ছাগলের মেটে ভাজা, পাঁচ রকম মাছ (রুই, কাতলা, ইলিশ, চিতল ও পাবদা) আবশ্যক। এছাড়া পাঁচ রকম ভাজা, লাবড়া তরকারি, চাটনি, ঘিয়ে ভাজা লুচি, নানা রকম মিষ্টি, পায়েস ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। তবে রাজ ঐতিহ্য মেনে দেবীকে এই ভোগ সর্বসাধারণের সামনে দেওয়া হয় না।

পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য মনসা পূজা গুলির মধ্যে জলপাইগুড়ি জেলার বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়ির এই পুজো অত্যন্ত পুরনো। রাজপুরোহিত শিবু ঘোষাল অত্যন্ত নিয়ম নিষ্ঠা সহকারে এই পূজা পরিচালনা করে থাকেন। রাজ আমলের প্রথা মতই আজোও এই পুজো হয়ে আসছে। এছাড়া শহরের অন্যতম মৃৎশিল্পী সুভাষ পাল মন্দির প্রাঙ্গনেই দেবী মনসার মূর্তি তৈরির পাশাপাশি দেবী দুর্গার মূর্তি নির্মাণের দায়িত্বে থাকেন। পূজোর দুদিন পরে সংলগ্ন রাজবাড়ীর পদ্ম দিঘিতে মায়ের বিসর্জন পর্ব অনুষ্ঠিত হয়।

কথিত আছে এই জলাশয় খননের জন্য শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয় কড়িতে। জলপাইগুড়ি রাজবাড়ির এই মনসা পূজো শহরবাসী হিসেবে আমাদের সবার কাছে অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের।
ছবি লেখক