রহস্যময় ভয়ের গল্প : তুলিন পাহাড়ের তেইশ নম্বর খোঁপা

পিনাকী রঞ্জন পাল

অধ্যায় ১: পাহাড়ের পেছনের ছায়া

পূর্ব ভারতের জনমানবহীন প্রান্তে, নেপালের সীমান্ত ঘেঁষা এক অখ্যাত পাহাড়ি অঞ্চল, যার নাম তুলিন পাহাড়। লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এই স্থানটি যেন নিজেই এক জীবন্ত কিংবদন্তি, যার প্রতিটি বাঁকে লুকিয়ে আছে না বলা গল্প, না দেখা রহস্য। এখানে পৌঁছানো যায় এক দুঃসাহসিক ট্রেকিংয়ের মাধ্যমে, আর শীতকালে এই অঞ্চলে নাকি এক অশুভ প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটে, যা স্থানীয়দের কাছে “গোঙানির হাওয়া” নামে পরিচিত। হিমশীতল বাতাস যখন পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে প্রবেশ করে এক গভীর গোঙানির শব্দ সৃষ্টি করে, তখন মনে হয় যেন অসংখ্য অতৃপ্ত আত্মা তাদের শেষ আর্তনাদ জানাচ্ছে প্রকৃতির কাছে। এই পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটি গ্রাম, মাহালডিহি, যার লোকসংখ্যা মাত্র ৫৪ জন, তবুও প্রতিটি মুখের গভীর রেখায় আর চোখের তারায় যেন চাপা পড়ে আছে শত বছরের ভয় আর অলৌকিক বিশ্বাসের ছাপ। লোকমুখে প্রচলিত আছে, এই পাহাড়ে এক জাদুকরী বাস করত, যে মানুষের জীবনকে তার চুলের বিনিময়ে কিনে নিত—এক অশুভ চুক্তি, যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অসম্ভব।

কলকাতার কোলাহল আর কংক্রিটের জঙ্গল ছেড়ে এই নির্জন, রহস্যময় পরিবেশে এসে পৌঁছেছে ঈশিতা সেন, ৩৩ বছরের এক তরুণী চলচ্চিত্র পরিচালক। তার উদ্দেশ্য তুলিন পাহাড়ের এই অজানা লোকবিশ্বাস আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করা। ক্যামেরা তার জন্য শুধু একটি যন্ত্র নয়, এটি তার চোখ, তার শ্রবণশক্তি, যার মাধ্যমে সে অদেখা জগৎকে ধরতে চায়, যুক্তি আর বাস্তবের সীমানাকে অতিক্রম করতে চায়। ঈশিতার মনে সবসময়ই এক অনুসন্ধিৎসু কৌতূহল, এক অজানা আকর্ষণ, যা তাকে অলৌকিকতার গভীরে ডুব দিতে উৎসাহিত করে।

তুলিন পাহাড়ের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে, ঈশিতা কলকাতার ন্যাশনাল আর্কাইভের এক ধুলোমাখা কোণে বসে একটি পুরোনো ইংরেজ কনসাল অফিসারের লেখা রিপোর্ট ঘাঁটছিল। রিপোর্টটি ছিল শতবর্ষ পুরোনো, তার পাতাগুলো ছিল হলদেটে আর ভঙ্গুর, যেন সময়ের নীরব সাক্ষী। সেখানেই তার চোখে পড়ে এক অদ্ভুত তথ্য: তুলিন পাহাড়ে নাকি একসময় একটি “চুলকাটা শ্মশান” ছিল। রিপোর্টে লেখা ছিল, এই শ্মশানে নাকি মানুষের চুল ফেলে তাদের আত্মাকে বন্দী করা হতো, যা ছিল এক প্রাচীন এবং নিষিদ্ধ তান্ত্রিক প্রথা। চুলের প্রতিটি গোঁছা যেন এক একটি আত্মার প্রতিচ্ছবি, যা শ্মশানের মাটিকে পবিত্রতার বদলে এক অশুভ শক্তিতে ভরিয়ে তুলতো। এই তথ্য ঈশিতার মনকে এক নতুন রহস্যের দিকে ঠেলে দিল। চুল এবং আত্মার এই সংযোগ তার কাছে প্রামাণ্যচিত্রের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল।

তুলিন পাহাড়ে পৌঁছে ঈশিতা তার ক্যামেরাম্যান শুভ আর স্থানীয় গাইড বিনয়কে নিয়ে মাহালডিহি গ্রামে আশ্রয় নেয়। গ্রামটি যেন প্রাচীনতার এক নীরব নিদর্শন; কাঁচা মাটির বাড়িগুলো, ধুলোমাখা পথ, আর হিমেল বাতাসে ভেসে আসা প্রাচীন লোককথার ফিসফিসানি—সবকিছু মিলে এক অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা ছিল আরও রহস্যময়। ঈশিতা এবং শুভ তাদের বেস ক্যাম্প স্থাপন করে, ক্যামেরাগুলো সেট আপ করে। বিনয় তাদের আশেপাশে পাহাড়ের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য আর স্থানীয় কিছু লোককথা বলতে শুরু করে, যদিও তার চোখে ছিল এক চাপা ভয়। রাত গভীর হতে শুরু করে, বাইরে নিস্তব্ধতা নেমে আসে, শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে ডাক শোনা যায়।

ঠিক তখনই, শুভর ক্যামেরায় ধরা পড়ে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। মনিটরের স্ক্রিনে একটি ছোট্ট মেয়েকে দেখা যায়, অন্ধকারে তার আবছা আকৃতি, সে তাদের বেস ক্যাম্পের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির লম্বা, কালো চুলগুলো খোলা, বাতাসের সাথে উড়ছে, আর তার মুখে ছিল এক অদ্ভুত, শীতল হাসি। হাসিটা এতটাই রহস্যময় ছিল যে, তা শুভ আর ঈশিতাকে মুহূর্তের জন্য বাক্যহারা করে দিল। শুভ দ্রুত ক্যামেরা জুম করে, কিন্তু পরের মুহূর্তেই মেয়েটি যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়। তার চলে যাওয়ার পর বাতাসে যেন এক ধরণের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে, যা সাধারণ ফুলের গন্ধ নয়, বরং পুরোনো, শুকিয়ে যাওয়া ফুলের মতো। ঈশিতার মনে পড়লো সেই রিপোর্ট, “চুলকাটা শ্মশান”, আর সেই জাদুকরীর কথা, যে মানুষের জীবন চুলের বিনিময়ে কিনতো। এই ছোট্ট মেয়েটি কি তারই ছায়া? প্রথম রাতেই এমন অশুভ ঘটনার সাক্ষী হয়ে ঈশিতা বুঝতে পারে, তুলিন পাহাড় কেবল একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, এটি এক জীবন্ত রহস্য, যার প্রতিটি কোণায় লুকিয়ে আছে মানুষের আত্মার এক অন্ধকার ইতিহাস। তার প্রামাণ্যচিত্রের কাহিনি যে কেবল তথ্যভিত্তিক হবে না, তা এখন স্পষ্ট। এটি হতে চলেছে এক অস্তিত্বের লড়াই, বাস্তব আর বিভ্রমের মধ্যকার এক ভয়াবহ টানাপোড়েন।

অধ্যায় ২: তেইশ নম্বর খোঁপা

প্রথম রাতের সেই লোমহর্ষক অভিজ্ঞতার পরদিন সকালে ঈশিতা আর শুভ নিজেদের বেস ক্যাম্প গুছিয়ে নেয়। শুভর চোখে তখনো সেই ছোট্ট মেয়েটির অস্পষ্ট হাসিটা লেগে আছে, যা ক্যামেরার মনিটরে ধরা পড়েছিল। তাদের দুজনের মনেই এক চাপা উত্তেজনা, যা ভয়ের সাথে মিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করছিল। এই পাহাড়ের রহস্য যে শুধুমাত্র লোককথা নয়, বরং এক জীবন্ত বাস্তবতা, তা এখন তাদের কাছে স্পষ্ট। তাদের প্রামাণ্যচিত্রের যে উপাদান তারা খুঁজছিল, তার চেয়েও অনেক গভীরে কিছু যেন তুলিন পাহাড়ের প্রতিটি ধুলোকণায় লুকিয়ে আছে।

মাহালডিহি গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ধরে তারা প্রধানের বাড়ির দিকে রওনা হয়। গ্রামটি যেন শত শত বছরের পুরোনো এক ক্যানভাস, যেখানে প্রতিটি মাটির বাড়ি, প্রতিটি বাঁশের ঝোপ, আর প্রতিটি পাথরের টুকরোয় লুকিয়ে আছে এক অদেখা ইতিহাস। গ্রামের প্রধান, নাম তার দোর্জি লামা, ছিলেন একজন বয়স্ক ব্যক্তি। তার মুখে ছিল গভীর রেখা, চোখে এক নিবিড় শান্ত দৃষ্টি, যা একইসাথে রহস্যময় আর অভিজ্ঞতার চিহ্ন বহন করছিল। তার সাদা চুলগুলো বাতাসের সাথে উড়ছিল, যেন নিজেই এক চলমান লোককথা। দোর্জি লামা তাদের আগ্রহ দেখে হাসলেন, কিন্তু তার হাসিটা যেন ছিল এক গভীর বিষাদের প্রতিচ্ছবি।

ঈশিতা সরাসরি তুলিন পাহাড়ের অলৌকিক ঘটনা এবং চুলকাটা শ্মশানের কথা জানতে চাইল। দোর্জি লামা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন, তার কণ্ঠস্বর ছিল ভারি, যেন প্রতিটি শব্দেই জড়িয়ে আছে শত বছরের চাপা ভয় আর বেদনা। তিনি জানালেন, প্রতি শীতের রাতে পাহাড়ে একটা গুনগুন আওয়াজ শোনা যায়। আওয়াজটা এতটাই মৃদু, যেন কোনো নারী তার দীর্ঘ চুল আঁচড়াচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। কিন্তু সেই গান আনন্দের নয়, বরং এক গভীর, অতৃপ্ত আর্তনাদ, যা মানুষের মনে ভয়ের সৃষ্টি করে। দোর্জি লামা ব্যাখ্যা করলেন, এই আওয়াজটি “সোঙ্গমা” নামের এক পাহাড়ি জাদুকরীর, যে মানুষের চুল কেটে তাদের আত্মাকে বন্দী করে।

সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে সকালে: গ্রামের কেউ না কেউ দেখতে পায়, তার চুল কাটা – একদম জোড়া দিয়ে, গোঁড়া থেকে নিপুণভাবে ছেঁড়া, যেন কোনো ধারালো ছুরি দিয়ে নয়, বরং এক অদৃশ্য শক্তি দিয়ে টেনে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে। এই কাটা চুলগুলো কখনোই এলোমেলোভাবে পড়ে থাকে না, বরং সেগুলো বিশেষ একটি বিন্যাসে রাখা হয়, যেন কোনো অলৌকিক হাতের কারুকার্য। গ্রামের মানুষ এই ঘটনাকে “খোঁপা কাটা” বলে।

দোর্জি লামা ঈশিতা আর শুভকে গ্রামের এক পরিত্যক্ত পাথরের মন্দিরের দিকে নিয়ে গেলেন। মন্দিরটি ছিল পাথরের তৈরি, তার দেয়ালগুলো শেওলা আর আগাছায় ঢাকা, যেন প্রকৃতির হাতেই তা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মন্দিরের ভেতরে ছিল এক গভীর নিস্তব্ধতা, যা যেন প্রতিটি শব্দকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। দোর্জি লামা জানালেন, এই মন্দিরের নিচে নাকি “তামা আর নুন দিয়ে” তৈরি সেই কাটা খোঁপাগুলো রাখা হয়। তামা নাকি আত্মাকে ধরে রাখে আর নুন নাকি অশুভ শক্তিকে দুর্বল করে। এই প্রথাটি বংশপরম্পরায় চলে আসছে, যাতে বন্দী আত্মাগুলি মন্দিরের বাইরে বেরোতে না পারে। মন্দিরের ভেতরে ঢুকতেই এক স্যাঁতসেঁতে, মাটির গন্ধ নাকে এলো, যা এক গভীর রহস্যের ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

দোর্জি লামা এক জীর্ণ ঝুলি থেকে কিছু ছোট ছোট, শুকিয়ে যাওয়া খোঁপা বের করে দেখালেন। প্রতিটি খোঁপা যেন এক একটি মানুষের জীবন, তাদের হারানো স্মৃতির নীরব সাক্ষী। প্রতিটি খোপায় ছিল তামা আর নুনের সাদা দানা, যা তাদেরকে অলৌকিকভাবে অক্ষত রেখেছিল। ঈশিতা ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। এই খোঁপাগুলো কি তাহলে সেই মানুষদের আত্মা, যারা সোঙ্গমার শিকার হয়েছিল?

দোর্জি লামা জানালেন, এখনো পর্যন্ত ২২টি খোঁপা সেই মন্দিরে আছে। তার কণ্ঠস্বরে এক গভীর বিষণ্ণতা। “বাইশটি প্রাণ, বাইশটি গল্প,” তিনি ফিসফিস করে বললেন, “কিন্তু সোঙ্গমা এখনও তৃপ্ত নয়।” ঈশিতা বুঝতে পারল, তাহলে তেইশ নম্বর খোঁপাটি এখনও বাকি। সোঙ্গমা কি আরও এক শিকার খুঁজছে? সেই শিকার কে হবে? প্রশ্নটা তার মনের গভীরে এক শীতল অনুভূতি সৃষ্টি করলো। তার প্রামাণ্যচিত্রের কাহিনি এখন কেবল লোককথা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এটি এখন জীবন আর মৃত্যুর এক ভয়ংকর খেলায় পরিণত হয়েছে। ঈশিতা অনুভব করতে পারছিল, তুলিন পাহাড়ের এই রহস্য তার ধারণার চেয়েও অনেক বেশি গভীর আর ভয়ঙ্কর।

অধ্যায় ৩: কুয়াশার গায়ে মুখ

দোর্জি লামার মুখে ২২টি খোঁপা জমা হওয়ার কাহিনি শুনে ঈশিতার মন আরও অস্থির হয়ে উঠেছিল। সে অনুভব করছিল, তেইশ নম্বর খোঁপার জন্য সোঙ্গমার অপেক্ষা, আর তার অশরীরী উপস্থিতি যেন তুলিন পাহাড়ের প্রতিটি বাতাসে মিশে আছে। প্রামাণ্যচিত্রের কাজ চালিয়ে যেতে সে আরও গভীরভাবে পাহাড়ের ভেতর ঢোকার সিদ্ধান্ত নিল। শুভ তার ক্যামেরা নিয়ে প্রস্তুত, আর বিনয় তাদের পথ দেখাচ্ছে। কিন্তু এবারের যাত্রা যেন তাদের পূর্বের অভিজ্ঞতার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর কিছু নিয়ে আসছিল।

এক সকালে, তারা তিনজন তুলিন পাহাড়ের আরও দুর্গম অংশে ট্রেকিং শুরু করল। সূর্য তখনো ভালোভাবে ওঠেনি, আর পাহাড়ের উপত্যকাগুলোতে ঘন কুয়াশা চাদরের মতো বিছিয়ে ছিল, যা সবকিছুকে এক রহস্যময় আবরণে ঢেকে রেখেছিল। বিনয় বারবার সতর্ক করছিল, “এই পথে বেশি দূর যাওয়া ভালো নয়, দিদি। এখানে দিনের বেলাতেও পথ হারানো সহজ।” কিন্তু ঈশিতার মনে তখন শুধু সেই ২২টি খোঁপা আর সোঙ্গমার রহস্য উন্মোচনের নেশা। সে ভাবছিল, হয়তো এই কুয়াশার গভীরে লুকিয়ে আছে সেই জাদুকরীর কোনো গোপন স্থান, অথবা তার শিকারদের ফেলে যাওয়া কোনো চিহ্ন।

তারা যত এগোচ্ছিল, কুয়াশা তত ঘন হচ্ছিল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই চারপাশ এমনভাবে ঢেকে গেল যে, সামনে থাকা শুভর আবছা অবয়বও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। পায়ের নিচের পাথুরে পথ পিচ্ছিল মনে হচ্ছিল, আর প্রতিটি পদক্ষেপে যেন এক অজানা আশঙ্কা তাদের গ্রাস করছিল। হঠাৎই, ঈশিতা অনুভব করলো, সে পথ হারিয়ে ফেলেছে। শুভ আর বিনয়কে আর দেখা যাচ্ছে না। তার কানে শুধু নিজের হৃদস্পন্দনের শব্দ আর কুয়াশার মধ্যে এক চাপা গোঙানির আওয়াজ। এই গোঙানির হাওয়া কি তবে শুরু হয়ে গেছে? সে উচ্চস্বরে শুভ আর বিনয়ের নাম ধরে ডাকল, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর কুয়াশার গভীরে হারিয়ে গেল।

অসহায়ভাবে ঈশিতা চারপাশে তাকিয়ে দেখল। কুয়াশার দেয়াল এতটাই ঘন ছিল যে, মনে হচ্ছিল যেন সে এক সাদা, অস্বচ্ছ কাঁচের বাক্সের ভেতর আটকা পড়েছে। হঠাৎই, কুয়াশার মধ্যেই একটা আবছা আকৃতি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। প্রথমে সে ভাবল, এটা হয়তো বিনয় বা শুভ। কিন্তু আকৃতিটা যত স্পষ্ট হতে লাগল, ঈশিতা তত বুঝতে পারল, এটা কোনো মানুষ নয়। কুয়াশার গভীরে একটা মুখ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল – একটি নারীর মুখ। মুখটি ছিল ফ্যাকাশে, তার চোখগুলো গভীর, আর তার দৃষ্টিতে ছিল এক অদ্ভুত আকর্ষণ, যা ঈশিতাকে নিজের দিকে টেনে নিচ্ছিল। সেই মুখটি তাকে ডাকতে লাগল, তার কণ্ঠস্বর ছিল অদ্ভুতভাবে সুরেলা, অথচ তাতে মিশে ছিল এক গভীর বিষাদ, যা ঈশিতাকে এক অজানা গহ্বরের দিকে টেনে নিচ্ছিল। “এসো… আমার কাছে এসো…”, কণ্ঠস্বর যেন বাতাসেই ভেসে আসছিল, তার মস্তিষ্কের ভেতরে অনুরণিত হচ্ছিল।

ঈশিতা ভয়ে জমে গেল, কিন্তু সে পালাতে পারল না। তার পা যেন মাটিতে গেঁথে গেছে। মুখটি আরও কাছে আসতেই ঈশিতা অনুভব করল, এক শীতল স্পর্শ তার গা ছুঁয়ে যাচ্ছে, যেন অদৃশ্য কোনো হাত তার চুল স্পর্শ করছে। তার মনে হলো, এই মুখটি যেন তার চেনা, কিন্তু সে তাকে চিনতে পারছে না।

ঠিক সেই মুহূর্তে, কুয়াশার গভীরে এক অদ্ভুত আলোর ঝলকানি ঘটল। আলোর মধ্যে ঈশিতা দেখতে পেল, তার সামনে একটা আয়না ভেসে উঠছে। কিন্তু আয়নাটি ছিল অদ্ভুত; তার কাঁচ ছিল ঘোলাটে, যেন শত শত বছর ধরে ধুলো জমে আছে। আয়নার দিকে তাকাতেই ঈশিতা নিজেকে দেখে চমকে উঠল – তার নিজের ছায়া আয়নায় উল্টোভাবে কথা বলছে! তার নিজের মুখটা আয়নার ভেতরে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল, চোখগুলো ছিল শূন্য, আর তার ঠোঁট থেকে ভেসে আসছিল সেই একই সুরেলা, বিষাদময় কণ্ঠস্বর, যা কুয়াশার মধ্যে থেকে তাকে ডাকছিল। “আমি মুক্ত হতে চাই… আমার মুক্তি দাও…” তার নিজের ছায়া যেন এক ভিন্ন সত্তা হয়ে কথা বলছে, যা ঈশিতার বাস্তবতার ধারণাকে ভেঙে দিচ্ছিল।

এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে ঈশিতার মস্তিষ্ক আর কাজ করছিল না। তার শরীর অবশ হয়ে গেল, পায়ের নিচে মাটি সরে যাচ্ছিল। সে প্রাণপণে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। এক তীব্র ঘূর্ণি তার মাথা ঘুরিয়ে দিল, চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল। সে জ্ঞান হারিয়ে পাহাড়ে পড়ে গেল। তার ক্যামেরা তার হাত থেকে ছিটকে পড়ল, আর ভাঙা কাঁচের আওয়াজ কুয়াশার গভীরে মিলিয়ে গেল। তার চেতনা হারানোর শেষ মুহূর্তে, সে অনুভব করল, তার চুলের গোঁড়া থেকে কিছু একটা টেনে ছিঁড়ে নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সে কিছুতেই তা আটকাতে পারল না। কুয়াশা তাকে গ্রাস করে নিল, আর তুলিন পাহাড়ের সেই অংশে নেমে এল এক গভীর নিস্তব্ধতা, যা যেন এক নতুন রহস্যের সূচনা করছিল।

অধ্যায় ৪: ক্যামেরার ভিতরে শব

জ্ঞান হারানোর পরের সকালটা ঈশিতার জন্য এক নতুন, অদেখা ভয়ের দ্বার উন্মোচন করলো। যখন তার জ্ঞান ফিরলো, সে নিজেকে শুভর আর বিনয়ের সাহায্যে বেস ক্যাম্পে ফিরে আসতে দেখল। মাথার ব্যথা ছিল তীব্র, যেন কোনো অদৃশ্য হাত তার মস্তিষ্কের ভেতরটা পিষে ফেলছে। কুয়াশার গভীরে দেখা সেই মুখ, আয়নার উল্টো প্রতিবিম্ব আর নিজের ছায়ার সেই ভয়ংকর কথোপকথন—সবকিছু যেন এক দুঃস্বপ্ন ছিল, যার রেশ তার মনে এখনো তাজা। বিনয় চিন্তিত মুখে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে চাইল, আর শুভ ছিল অস্বাভাবিক নীরব।

সেদিন দুপুরে, ঈশিতা তার ক্যামেরাগুলো দেখতে বসল। গতকালের ঘটনাগুলো তার মনের গভীরে এক অস্থিরতা তৈরি করেছিল। সে জানত, হয়তো ক্যামেরায় ধরা পড়েছে এমন কিছু, যা তার প্রামাণ্যচিত্রের সীমানাকে ছাপিয়ে যাবে, যা বাস্তবতার ধারণাকেই ভেঙে দেবে। শুভর ক্যামেরাটি অক্ষত ছিল, শুধু লেন্সে কিছু কুয়াশার জলীয় বাষ্প লেগেছিল। ঈশিতা দ্রুত ফুটেজগুলো কম্পিউটারে লোড করলো। তার হাত কাঁপছিল, এক অজানা আশঙ্কায় তার বুক ধুকপুক করছিল।

প্রথমেই সে শুভর জ্ঞান হারানোর মুহূর্তের ফুটেজগুলো দেখল। সেই কুয়াশা, সেই মুখ, আর আয়নার বিভীষিকা—সবকিছুই ক্যামেরায় পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে। ঈশিতা শ্বাসরুদ্ধ করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরই, তার জ্ঞান হারানোর ঠিক পরের মুহূর্ত থেকে যা শুরু হলো, তা দেখে তার শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল স্রোত নেমে গেল। ক্যামেরায় দেখা গেল, ঈশিতা মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর, কুয়াশার মধ্য থেকে ধীরে ধীরে এক বৃদ্ধা মহিলা বেরিয়ে এলো। তার শরীরটা ছিল শীর্ণ, মুখটা বলিরেখায় ভরা, আর চোখগুলো ছিল কেমন যেন গভীর শূন্য। সেই চোখের দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত আদিম শক্তি খেলা করছিল, যা দেখে ঈশিতার গা কাঁটা দিয়ে উঠলো।

বৃদ্ধা মহিলাটি ঈশিতার দিকে এগিয়ে এলো, তার পদক্ষেপ ছিল অদ্ভুত রকমের নীরব, যেন সে মাটিকে স্পর্শ করছে না। সে নিচু হয়ে ঈশিতার অচৈতন্য শরীরের পাশে বসল। তারপর, তার লম্বা, রোগাটে আঙ্গুলগুলো ঈশিতার চুলের গোঁড়ার দিকে চলে গেল। মহিলাটি কোনো ধারালো বস্তু ব্যবহার করল না, বরং এক অদৃশ্য শক্তি দিয়ে, যেন বাতাসের ওপর দিয়ে, তার চুলের গোঁড়া থেকে এক গোছা চুল ছিঁড়ে নিল। ছিঁড়ে নেওয়ার সময় ঈশিতার অচৈতন্য শরীর যেন একটু কেঁপে উঠলো, যদিও সে তখন কিছু অনুভব করতে পারেনি। সেই ছেঁড়া চুলের গোছাটি নিয়ে বৃদ্ধা মহিলাটি উঠে দাঁড়াল, তার মুখে ছিল এক তৃপ্তির হাসি। তারপর সে অদৃশ্য হয়ে গেল, কিন্তু যাওয়ার আগে পাথরের নিচে চুলগুলো সযত্নে রেখে গেল, যেন কোনো গোপন আচারের অংশ। ক্যামেরা তার প্রতিটি নড়াচড়া নিখুঁতভাবে ধারণ করছিল।

ফুটেজ দেখে ঈশিতা ভয়ে জমে গেল। তার মনে পড়লো দোর্জি লামার বলা সেই “চুলকাটা”র কথা, আর সোঙ্গমা নামের সেই জাদুকরীর কথা, যে মানুষের জীবন চুলের বিনিময়ে কিনতো। তাহলে কি এই বৃদ্ধা মহিলাটিই সোঙ্গমা? কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার ছিল, যখন ঈশিতা তার চুলের দিকে হাত দিল, সে দেখল, তার মাথার চুল একটুও কাটেনি। তার লম্বা, কালো চুলগুলো আগের মতোই অক্ষত ছিল। তাহলে ক্যামেরায় যা দেখা গেছে, সেটা কি শুধুই বিভ্রম? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো রহস্য?

ঠিক তখনই ঈশিতা শুভর দিকে তাকাল। গতকালের ঘটনার পর থেকে শুভ হঠাৎ করে নীরব হয়ে গেছে। সে কারও সঙ্গে আর কথা বলছে না, এমনকি ঈশিতার দিকেও তাকাচ্ছে না। তার চোখগুলো ছিল উদাস, যেন সে কোনো গভীর ঘোরের মধ্যে আছে। সে শুধু জানালার বাইরে, তুলিন পাহাড়ের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকে, আর অস্ফুটে গুনগুন করে পুরোনো নেপালি লোকসংগীত গায়। গানগুলো ছিল বিষাদময়, যার সুর যেন পাহাড়ের হিমেল বাতাসের সাথে মিশে এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করছিল। শুভর এই অস্বাভাবিক আচরণ ঈশিতাকে আরও চিন্তায় ফেলে দিল।

ঈশিতা শুভর হাতে স্পর্শ করলো, কিন্তু শুভ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। তার চোখগুলো ছিল শূন্য, যেন তার আত্মা শরীর ছেড়ে চলে গেছে। ঈশিতা বুঝতে পারল, শুভ কোনো এক অশুভ শক্তির প্রভাবে আছে। হয়তো সেই বৃদ্ধা মহিলা, বা সোঙ্গমা, শুভর ওপর কোনো প্রভাব ফেলেছে। হয়তো শুভ সেই “চুলকাটা”র পরবর্তী শিকার। তার মনে পড়লো দোর্জি লামার কথা – “বাইশটি প্রাণ, বাইশটি গল্প।” তাহলে কি শুভর এই অস্বাভাবিকতা তেইশ নম্বর খোঁপার ইঙ্গিত? এই প্রশ্ন ঈশিতার মনে এক গভীর আতঙ্ক সৃষ্টি করলো। তুলিন পাহাড়ের রহস্য এখন কেবল তার প্রামাণ্যচিত্রের অংশ নয়, এটি এখন তার জীবনেরই এক অপরিহার্য, এবং ভয়ঙ্কর অংশ হয়ে উঠেছে।

অধ্যায় ৫: খোঁপার কাহিনি

শুভর অস্বাভাবিক নীরবতা আর তার অলৌকিক নেপালি লোকসংগীতের গুনগুনানি ঈশিতার মনে এক গভীর আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। সে বুঝতে পারছিল, শুভ আর তার পুরোনো শুভ নেই; তার মন যেন এক অদৃশ্য ঘোরের মধ্যে আচ্ছন্ন। চতুর্থ অধ্যায়ের বিভীষিকা তাকে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুললো। সোঙ্গমার রহস্য উন্মোচন করতেই হবে, শুভর জীবন বাঁচাতে এবং নিজেকে রক্ষা করতে। একমাত্র উপায় হলো সেই পরিত্যক্ত পাথরের মন্দির, যেখানে ২২টি খোঁপা রাখা আছে। ঈশিতা জানত, সেই মন্দিরেই লুকিয়ে আছে সোঙ্গমা আর তার ক্ষমতার গোপন সূত্র।

পরদিন সকালে, ঈশিতা বিনয়কে নিয়ে মন্দিরের দিকে রওনা হলো। শুভকে বেস ক্যাম্পেই রেখে এসেছিল, কারণ তার মানসিক অবস্থা এমন ছিল না যে সে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে। মন্দিরটি ছিল পাহাড়ের এক নির্জন প্রান্তে, ঘন ঝোপঝাড় আর প্রাচীন গাছের আড়ালে ঢাকা, যেন সময়ের সাথে সাথে তা প্রকৃতির অংশ হয়ে গেছে। মন্দিরের প্রবেশপথ ছিল স্যাঁতসেঁতে আর অন্ধকার, ভেতরে ঢুকতেই পুরোনো পাথরের গন্ধ আর এক অদ্ভুত শীতলতা তাদের ঘিরে ধরল। মন্দিরের ভেতরে ছিল এক গভীর নিস্তব্ধতা, যা কেবল তাদের পায়ের শব্দে আর শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজে ভঙ্গ হচ্ছিল।

মন্দিরের মূল বেদিতে, যেখানে দোর্জি লামা খোঁপাগুলো রেখেছিলেন, তার পাশেই একটি পাথরের সিন্দুক দেখা গেল। সিন্দুকটি ছিল শ্যাওলা পড়া, আর তার গায়ে খোদাই করা ছিল কিছু অদ্ভুত, প্রাচীন প্রতীক। ঈশিতার মনে হলো, এই সিন্দুক হয়তো মন্দিরের সবচেয়ে গোপন রহস্য ধারণ করে আছে। বিনয়ের সাহায্যে ঈশিতা সিন্দুকটি খুললো। ভেতরে ছিল না কোনো ধনরত্ন, ছিল শুধু একটি জীর্ণ পাণ্ডুলিপি। পাণ্ডুলিপিটি ছিল গাছের ছাল দিয়ে তৈরি, তার পাতাগুলো ছিল হলদেটে আর ভঙ্গুর। পাতায় পাতায় লেখা ছিল প্রাচীন নেপালি ভাষায় কিছু অজানা মন্ত্র আর চিত্র।
ঈশিতা দ্রুত হাতে পাণ্ডুলিপিটির পাতা উল্টাল। বিনয়, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও, ঈশিতাকে সেগুলোর অর্থ ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করলো। পাণ্ডুলিপিটির শিরোনাম ছিল: “সোঙ্গমা রাক্ষসীর” ইতিহাস। সেখানেই লিপিবদ্ধ ছিল সেই অশরীরী জাদুকরীর ভয়ঙ্কর কাহিনি, যা এতদিন কেবল লোককথা হিসেবেই পরিচিত ছিল।

পাণ্ডুলিপিটিতে লেখা ছিল: “প্রাচীনকালে, তুলিন পাহাড়ের গভীরে বাস করত এক অসাধারণ সুন্দরী পাহাড়ি রমণী, যার নাম সোঙ্গমা। তার রূপ ছিল মায়াবী, কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল তার দীর্ঘ, কালো, রেশমি চুল। সেই চুল ছিল তার অহংকার, তার শক্তি। সে তার চুলের সৌন্দর্যে পুরুষদের আকৃষ্ট করত। পুরুষরা তার চুলে মুখ গুঁজে দিত, তার গন্ধ নিত, আর সেই সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে সবকিছু ভুলে যেত। তাদের কাছে সোঙ্গমা ছিল দেবীসম, সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি।

কিন্তু এই সৌন্দর্য ছিল এক মায়াজাল, এক ফাঁদ। যখন পুরুষরা তার চুলে মুখ গুঁজে দিত, তখনই সে তাদের আত্মা কেটে চুলের গাঁটে বাঁধত। চুলের প্রতিটি গোছা ছিল এক একটি আত্মার কারাগার। সেই কাটা চুলগুলোকে সে বিশেষ পদ্ধতিতে খোঁপা হিসেবে তৈরি করত, আর সেই খোঁপাগুলোই ছিল তার ‘প্রিয়দের দল’। এই খোঁপাগুলোর মাধ্যমে সে সেই আত্মাগুলোকে নিজের অধীনে রাখত, তাদের শক্তি শোষণ করত এবং নিজের অলৌকিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করত। প্রতিটি খোঁপা যেন এক একটি মানুষের জীবনের নির্যাস ধারণ করে থাকত, যা সোঙ্গমাকে অমরত্ব আর অসীম শক্তি প্রদান করত।”

পাণ্ডুলিপিটি আরও বর্ণনা করছিল, সোঙ্গমার প্রিয়তম প্রেমিক ছিল এক যুবক, যার চুল ছিল সবচেয়ে লম্বা এবং সুন্দর। সেই যুবকের আত্মাকে সে তার নিজের চুলের গোঁড়ায় বেঁধে রাখতো, যা ছিল তার ক্ষমতার উৎস। যার খোঁপা সবচেয়ে লম্বা, সে ছিল তার প্রিয়তম। এই লাইনটি পড়ে ঈশিতার মনে পড়লো শুভর গুনগুন করা লোকসংগীত আর তার অস্বাভাবিক নীরবতার কথা। তাহলে কি সোঙ্গমা শুভর আত্মাকেও তার চুলের গাঁটে বাঁধার চেষ্টা করছে? এই ভাবনা ঈশিতার রক্ত হিম করে দিল।

পাণ্ডুলিপির শেষ অংশে লেখা ছিল, “সোঙ্গমা এখনও তৃপ্ত নয়। তার তেইশতম খোঁপাটি এখনো বাকি।” এই বাক্যটি ঈশিতার মনে এক তীব্র আতঙ্কের সৃষ্টি করলো। ২২টি খোঁপা মন্দিরে আছে, কিন্তু তেইশতম খোঁপাটি কে হবে? শুভর অস্বাভাবিকতা কি তবে এই তেইশতম খোঁপারই ইঙ্গিত? নাকি সোঙ্গমার চোখ এখন তার দিকে? ঈশিতার মনে পড়লো, সে জ্ঞান হারানোর পর বৃদ্ধা মহিলাটি তার চুলের গোঁড়া ছিঁড়ে নিয়েছিল, যদিও তার মাথার চুল অক্ষত ছিল। তাহলে কি সেই ছেঁড়া চুল তেইশতম খোঁপার অংশ ছিল?
মন্দিরের ভেতরে এক হিমশীতল বাতাস বয়ে গেল, যেন সোঙ্গমার অশরীরী উপস্থিতি তাদের খুব কাছেই রয়েছে। ঈশিতা বুঝতে পারল, তার প্রামাণ্যচিত্র এখন আর শুধু একটি গবেষণা নয়, এটি তার নিজের অস্তিত্বের জন্য এক লড়াই। সোঙ্গমা কেবল লোককথার জাদুকরী নয়, সে এক জীবন্ত অভিশাপ, যা তুলিন পাহাড়কে গ্রাস করে রেখেছে। ঈশিতা জানত, তাকে এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতে হবে, সোঙ্গমার দুর্বলতা খুঁজে বের করতে হবে, তার নিজের জীবন বাঁচাতে এবং শুভর আত্মাকে মুক্ত করতে।

অধ্যায় ৬: নিঃশব্দ পিশাচ

মন্দির থেকে ফিরে আসার পর, মাহালডিহি গ্রামে এক নতুন আতঙ্ক জেঁকে বসল। একের পর এক মানুষ নিখোঁজ হতে থাকল। প্রথমে একজন কৃষক, তারপর গ্রামের এক বৃদ্ধা, তারপর আরও কয়েকজন যুবক। তাদের কোনো চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছিল না। শুধু তাদের ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকত, যা দেখে মনে হত যেন তাদের হঠাৎ করেই মাটি গ্রাস করে নিয়েছে। গ্রামের মানুষ ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল, তাদের মুখে ছিল এক গভীর আতঙ্ক। দোর্জি লামা এক অস্ফুট আর্তনাদ করে বলেছিলেন, “সোঙ্গমা তৃপ্ত নয়… সে তার প্রিয়তমের জন্য ক্ষুধার্ত।” তার চোখে ছিল এক গভীর হতাশা, যেন তিনি জানেন এই পরিণতি অনিবার্য।

ঈশিতা তার ক্যামেরায় নিখোঁজ হওয়া মানুষদের ছবি তোলার চেষ্টা করল। কিন্তু যা দেখল, তা দেখে তার গা ছমছম করে উঠলো। ক্যামেরার স্ক্রিনে দেখা যায়, সেই সব জায়গায় যেখানে নিখোঁজ হওয়া মানুষগুলো শেষবার ছিল, সেখানে শুধু তাদের চুল বাতাসে উড়ছে, যেন তাদের উপস্থিতি কেবল তাদের কেশদামেই আটকে আছে। মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই, শুধু চুলের অগোছালো গোছা বাতাসে ভাসছে, যেন এক অদৃশ্য সত্তা তাদের প্রাণশক্তি শুষে নিয়ে শুধু চুলের নির্যাসটুকু ফেলে গেছে। এই দৃশ্য দেখে ঈশিতার মনে হল, সোঙ্গমা যেন শুধু তাদের আত্মাকেই নয়, তাদের শরীরকেও অদৃশ্য করে দিচ্ছে, যেন তারা এই পৃথিবীতে কখনোই ছিল না। এই অলৌকিক ঘটনা ঈশিতাকে আরও নিশ্চিত করলো যে, তার সামনে এক এমন শক্তি আছে, যা মানুষের ধারণার বাইরে।

দিনের পর দিন শুভর অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল। সে সম্পূর্ণভাবে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছিল। তার চোখগুলো আরও শূন্য হয়ে গেছে, যেন তার ভেতরের আলো নিভে গেছে। সে কেবল পাহাড়ের দিকে স্থির তাকিয়ে থাকে, আর তার ঠোঁটে লেগে থাকে সেই অস্ফুট নেপালি গান। তার শরীরটা ক্রমশ ফ্যাকাসে হয়ে আসছিল, যেন তার রক্ত ​​শুষে নেওয়া হচ্ছে। ঈশিতা তার হাত ধরেছিল, কিন্তু শুভর শরীরে কোনো উষ্ণতা ছিল না, কেবল এক হিমশীতল স্পর্শ, যা যেন এক মৃতদেহের মতো।

এক রাতে, বেস ক্যাম্পের তাঁবুর ভেতরে যখন গভীর ঘুম নেমে এসেছে, ঈশিতা এক অদ্ভুত শব্দে জেগে উঠলো। শব্দটা ছিল মৃদু, যেন সুমদ্রের ঢেউয়ের মতো মৃদু গোঙানি। সে ধীর পায়ে শুভর দিকে এগিয়ে গেল। চাঁদের আবছা আলোয় যা দেখল, তা দেখে তার হৃৎপিণ্ড থেমে যাওয়ার উপক্রম হলো। শুভ ঘুমন্ত অবস্থায় মারা গেছে। তার চোখ খোলা, কিন্তু সেখানে কোনো জীবন নেই। তার শরীরটা ছিল অদ্ভুতভাবে বাঁকানো, আর তার ঘাড়টা উল্টো হয়ে গেছে, যেন মেরুদণ্ড ভেঙে দুমড়ে দেওয়া হয়েছে। আর সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য ছিল—তার মাথায় বাঁধা হয়েছে একটি খোঁপা, নিপুণভাবে বিন্যস্ত, যেন কোনো শিল্পী নিজের হাতে বেঁধেছে। এই খোঁপাটি ছিল শুভর নিজের চুল, যা তার মাথার গোঁড়া থেকে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছিল। খোঁপাটি দেখে ঈশিতার মনে পড়লো সেই পাণ্ডুলিপির কথা, যেখানে লেখা ছিল, যার খোঁপা সবচেয়ে লম্বা, সে তার প্রিয়তম।

ঈশিতা ভয়ে চিৎকার করতে পারল না। তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। তার মনে হলো, ঘরের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে, এক অশুভ উপস্থিতি তাকে ঘিরে রেখেছে। সে বুঝতে পারল, শুভই ছিল সেই তেইশ নম্বর খোঁপা। সোঙ্গমা তার প্রিয়তমের জন্য অপেক্ষা করছিল, আর শুভই ছিল তার শেষ শিকার। শুভর মৃত্যু ঈশিতাকে এক চরম বাস্তবতার মুখোমুখি করলো। সোঙ্গমা এখন সম্পূর্ণ, তার প্রিয়তমের খোঁপা সে পেয়েছে।

অধ্যায় ৭: শেষ প্রতিরোধ

শুভর মর্মন্তুদ মৃত্যু ঈশিতাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিলেও, তার ভেতরের চলচ্চিত্র পরিচালক সত্তাটি এক নতুন প্রেরণা খুঁজে পেল। সে বুঝতে পারছিল, এই গল্প কেবল ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করার মতো নয়, এটি তার নিজের জীবনের লড়াই। সোঙ্গমা এখন সম্পূর্ণ, তার তেইশতম খোঁপা, শুভকে সে গ্রাস করেছে। এখন হয়তো ঈশিতা নিজেই তার পরবর্তী শিকার। কিন্তু ঈশিতা হাল ছাড়তে রাজি ছিল না। তার মনে পাণ্ডুলিপির কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল, যেখানে সোঙ্গমার ক্ষমতার বর্ণনা ছিল, তার দুর্বলতা হয়তো সেখানেই লুকিয়ে আছে।

হতাশা আর ভয়ের মেঘ যখন তার মনকে গ্রাস করছিল, ঠিক তখনই ঈশিতার মনে পড়লো মাহালডিহি গ্রামের প্রবীণতম এক পাহাড়ি সাধুর কথা, যার সম্পর্কে দোর্জি লামা একবার অস্ফুটে উল্লেখ করেছিলেন। সাধুটি নাকি তুলিন পাহাড়ের গভীরে, লোকচক্ষুর অন্তরালে এক গুহায় বাস করতেন। তার কাছে নাকি পাহাড়ি অলৌকিক শক্তির অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে। শেষ আশার আলো হিসেবে ঈশিতা একা সেই সাধুর খোঁজে বের হলো। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে, ভয়ের এক অদৃশ্য ছায়াকে সঙ্গী করে, সে চলল সেই গুহার দিকে।

অনেক খোঁজার পর, ঈশিতা এক সরু গুহার মুখে সাধুটিকে খুঁজে পেল। সাধুর শরীর ছিল শীর্ণ, তার মুখমণ্ডল বলিরেখায় ভরা, আর চোখগুলো ছিল গভীর, যেন তিনি প্রকৃতির প্রতিটি রহস্যকে ধারণ করে আছেন। ঈশিতা তাকে তার অভিজ্ঞতার কথা, সোঙ্গমার অত্যাচার, শুভর মৃত্যু আর নিজের আশঙ্কার কথা খুলে বলল। সাধু তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তার চোখে ছিল এক গভীর বিষাদ। সব শুনে সাধু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার কণ্ঠস্বর ছিল শান্ত, কিন্তু তাতে ছিল এক আদিম জ্ঞান:

“সোঙ্গমার শক্তি তার খোঁপাগুলোতে নিহিত, আর তার প্রিয়তমের খোঁপা তাকে অমরত্ব এনে দেয়। সে এই খোঁপাগুলোর মাধ্যমে আত্মার শক্তি শোষণ করে। তাকে দুর্বল করার একমাত্র উপায় হলো সেই ২২টি খোঁপা, যা মন্দিরের নিচে রাখা আছে, সেগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া।” সাধু একটানা বলে চললেন, “এই খোঁপাগুলো পুড়ে গেলে তার শক্তির উৎস শুকিয়ে যাবে। কিন্তু শুধু পুড়িয়ে দিলেই হবে না, সেই পবিত্র আগুনে জীবন্ত চুলের গুচ্ছ রাখতে হবে, একেবারে পবিত্র চুল। এই পবিত্র চুল হবে এক নতুন উৎস, যা অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করবে।”

ঈশিতা চমকে উঠলো। পবিত্র চুল? কার চুল? সাধু ঈশিতার মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন, “এই পবিত্র চুল এমন কারো হতে হবে, যে সোঙ্গমার প্রভাবের বাইরে। যে তার নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে এই অভিশাপকে প্রতিহত করতে পারে। সেই পবিত্র চুলই হবে সোঙ্গমার বিনাশের শেষ অস্ত্র।”

সাধুর কথাগুলো ঈশিতার মনে এক নতুন সাহস এনে দিল। সে জানত, এই কাজটা তাকে একা করতে হবে। এই লড়াইটা তার একার, কারণ সে এখন সোঙ্গমার পরবর্তী লক্ষ্য। কোনো দ্বিধা না করে, ঈশিতা নিজেই নিজের মাথার কিছু চুল কেটে রাখল। তার চুল ছিল লম্বা আর কালো, যেন প্রকৃতিরই অংশ। এই চুলগুলো ছিল পবিত্র, কারণ তারা সোঙ্গমার স্পর্শ থেকে মুক্ত।

রাত গভীর হলো। মাহালডিহি গ্রাম তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঈশিতা তার হাতে নিজের কাটা চুলের গুচ্ছ আর একটি দেশলাই বাক্স নিয়ে একাই চলে গেল পাহাড়ের পাথরের নিচে – সেই স্থানে, যেখানে ২২টি খোঁপা বাঁধা ছিল। চাঁদ তখন আকাশে মেঘের আড়ালে লুকানো, কেবল তার আবছা আলো পথ দেখাচ্ছিল। বাতাসের সাথে এক হিমশীতল গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছিল, যেন সোঙ্গমা তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।

সেই পাথরের বেদিটি খুঁজে পেতে ঈশিতার বেশি সময় লাগলো না। সেখানে সারি সারি করে সাজানো ছিল ২২টি খোঁপা, প্রতিটিই ছিল প্রাচীন, ফীর্ণ, যেন শত বছরের অন্ধকারকে ধারণ করে আছে। ঈশিতার বুক ধুকপুক করছিল, কিন্তু তার মনের দৃঢ়তা তাকে সাহস যোগাচ্ছিল। সে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে, কাঁপতে কাঁপতে খোঁপাগুলোতে আগুন ধরাল। শুকনো চুল আর তামার তারগুলো মুহূর্তেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো, এক অদ্ভুত মিষ্টি-তিক্ত গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। আগুনের শিখা আকাশে উঠে যাচ্ছিল, যা অন্ধকারে এক অদ্ভুত আলোর সৃষ্টি করছিল।

ঠিক তখনই, বাতাসের মধ্যে এক তীব্র ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল, আর পরিবেশ যেন মুহূর্তে পাল্টে গেল। আগুনের আলোয় দেখা গেল, দূরে পাহাড়ের আঁকা-বাঁকা পথে একটি আবছা আকৃতি ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সেই আকৃতিটি যত কাছে এলো, ঈশিতা তত স্পষ্ট দেখতে পেল—সেটা ছিল সোঙ্গমা। এক লালপাড় শাড়ি পরা লম্বাচুল মহিলা। তার চুলগুলো এতটাই লম্বা ছিল যে, তা দিয়ে তার মুখ সম্পূর্ণ ঢাকা পড়েছিল, যেন তার চোখ নেই, শুধু চুলের গুচ্ছ তার মুখ লুকানোর জন্য যথেষ্ট। তার চুলগুলো বাতাসের সাথে উড়ছিল, যেন প্রতিটি লোমকূপ থেকে এক অশুভ শক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সোঙ্গমার আগমন ছিল এক নীরব, ভয়ঙ্কর ঘোষণা। ঈশিতা জানত, লড়াই এখন শুরু।

অধ্যায় ৮: পাহাড় নেমে আসে

আগুনের শিখা দাউদাউ করে জ্বলে উঠতেই, সেই লালপাড় শাড়ি পরা, লম্বাচুল, মুখ ঢাকা সোঙ্গমা যেন বাতাসের রূপ নিয়ে ঈশিতার সামনে এসে দাঁড়ালো। তার উপস্থিতি এতটাই তীব্র ছিল যে, পাহাড়ের বাতাস যেন ভারি হয়ে উঠলো। আগুনের আলোয় সোঙ্গমার সেই আবছা অবয়ব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো। তার লম্বা চুলগুলো বাতাসে ঢেউ খেলছিল, আর ঈশিতা বুঝতে পারছিল, সেই চুলের প্রতিটি গাঁট ছিল এক একটি মৃত আত্মার কান্না, তাদের অতৃপ্ত যন্ত্রণা আর চাপা আর্তনাদ যেন সোঙ্গমার প্রতিটি কেশদাম থেকে নির্গত হচ্ছিল। সেই কান্নার শব্দ ছিল হাড়হিম করা, যা ঈশিতার শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল স্রোত নামিয়ে দিল। সোঙ্গমা ছিল এক নীরব বিভীষিকা, তার চোখ দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু তার চুলের আড়াল থেকে যেন এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঈশিতাকে বিঁধে দিচ্ছিল।

ভয়ে ঈশিতার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলেও, তার চলচ্চিত্র পরিচালকের মন তাকে এক নতুন শক্তি দিল। এই মুহূর্তটিই তার প্রামাণ্যচিত্রের ক্লাইম্যাক্স, বাস্তব আর অলৌকিকের মধ্যে এক চূড়ান্ত সংঘাত। দ্রুত হাতে ঈশিতা তার ক্যামেরা চালু রাখে। তার ক্যামেরা এখন শুধু একটি যন্ত্র নয়, এটি তার সাক্ষী, তার শেষ আশ্রয়, যা এই ভয়াবহ বাস্তবতাকে ধারণ করবে। ক্যামেরার লাল বিন্দুর আলো জ্বলতে লাগলো, আর ঈশিতা সোঙ্গমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

সোঙ্গমা ধীরে ধীরে আগুনের দিকে এগিয়ে আসছিল। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল নীরব, কিন্তু তার উপস্থিতি যেন পাথর আর মাটির প্রতিটি কণাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। তার লম্বা চুলগুলো বাতাসের সাথে ঢেউ খেলছিল, যেন শত শত সর্পিল আত্মা তার চারপাশ ঘিরে নাচছে। ঈশিতা তার হাতে রাখা নিজের কাটা চুলের গুচ্ছটি শক্ত করে ধরলো। সাধুর কথা তার মনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল: “জীবন্ত চুলের গুচ্ছ, একেবারে পবিত্র চুল।”

সোঙ্গমা আগুনের খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। তার চুলের প্রতিটি গাঁট থেকে মৃত আত্মাদের কান্না আরও তীব্র হচ্ছিল, যেন তারা তাদের মুক্তির জন্য ছটফট করছে। সোঙ্গমা তার লম্বা, অদৃশ্য হাত বাড়িয়ে দিল আগুনের শিখার দিকে, যেন সে আগুনকে গ্রাস করতে চাইছে। ঠিক সেই মুহূর্তে, ঈশিতা নির্ভয়ে তার হাতে থাকা জীবন্ত চুলের গুচ্ছটি জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে ছুঁড়ে দিল।

আগুন মুহূর্তেই এক নতুন রূপে জ্বলে উঠলো। চুলের গুচ্ছ আগুনের স্পর্শে ঝলসে উঠলো না, বরং এক উজ্জ্বল, পবিত্র আলোয় রূপান্তরিত হলো, যা সোঙ্গমার কালো আভাকে প্রতিহত করতে লাগলো। আগুনের শিখা যেন নৃত্য করতে লাগলো, আর সেই পবিত্র চুলের আলোয় সোঙ্গমার চুলের গাঁটগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো অগণিত আত্মা। আত্মারা যেন মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল, তারা কান্নার বদলে এক নীরব শান্তিতে মিলিয়ে যাচ্ছিল বাতাসে। সোঙ্গমার রূপ বিকৃত হতে লাগলো। তার চুলের গাঁটগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছিল, তার শক্তি যেন ধীরে ধীরে কমে আসছিল।

সে এক বিকট শব্দ করে উঠলো, যা মানুষের কণ্ঠস্বর ছিল না, যেন প্রকৃতিরই এক ভয়ঙ্কর গর্জন। তার লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেল, মুখ থেকে সেই অদৃশ্য আবরণ সরে গেল, কিন্তু তার চোখে কোনো চোখ ছিল না, শুধু দুটি গভীর, কালো গহ্বর। সে ঈশিতার দিকে এক তীব্র ক্রোধ নিয়ে এগিয়ে এলো, যেন তার শেষ শক্তি দিয়ে ঈশিতাকে গ্রাস করতে চাইছে।

কিন্তু ঈশিতা প্রস্তুত ছিল। তার ক্যামেরা তখনো চালু। ক্যামেরায় ধরা পড়ল এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য: লড়াই শুরু হলো বাস্তব আর অশরীরী শক্তির মধ্যে। সোঙ্গমার চুলগুলো যেন সাপ হয়ে ঈশিতাকে আক্রমণ করছিল, কিন্তু ঈশিতা পবিত্র আগুনের শক্তি দিয়ে নিজেকে রক্ষা করছিল। আগুনের শিখা যেন তার চারপাশে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করেছিল।

ক্যামেরায় শেষ দৃশ্যটি ছিল ভয়ঙ্কর এবং একইসাথে মর্মস্পর্শী: ঈশিতা জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাসছে। তার হাসিটা ছিল অদ্ভুত, তাতে কোনো ভয় ছিল না, ছিল এক গভীর তৃপ্তি, এক অসীম শান্তি। তার মুখে সেই বিভীষিকা বা আতঙ্ক ছিল না, যা কিছু আগে তাকে গ্রাস করছিল। তার চোখগুলো ছিল শান্ত, যেন সে এক নতুন জগতের দিকে তাকিয়ে আছে। আর তার মাথায় বাঁধা হয়ে গেছে তুলিন পাহাড়ের তেইশ নম্বর খোঁপা। খোঁপাটি ছিল শুভ্র, পবিত্র, যেন তা সোঙ্গমার অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে নতুন রূপ পেয়েছে।

কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ছিল, ঈশিতার শরীর সেখানে ছিল না। ক্যামেরায় শুধু দেখা যাচ্ছিল তার সেই বাঁধা খোঁপা, তার দীর্ঘ চুল… বাতাসে ভাসছে, যেন সে নিজেই এক অদৃশ্য সত্তা হয়ে গেছে। তার দেহ হয়তো সোঙ্গমার সাথে একীভূত হয়ে গিয়েছিল, অথবা সেও এক নতুন ধরনের অশরীরী সত্তায় রূপান্তরিত হয়েছিল, যে এখন তুলিন পাহাড়ের আত্মা হয়ে গেছে। ক্যামেরাটি মাটিতে পড়ে যায়, আর তার স্ক্রিনে সেই চুলের খোঁপাটি শেষবারের মতো দেখা যায়, যা বাতাসে ভাসছিল। তুলিন পাহাড়ের আকাশে তখন এক নতুন নীরবতা নেমে আসে, যা ছিল ভয় আর শান্তির এক অদ্ভুত মিশ্রণ। সোঙ্গমা হয়তো পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু তুলিন পাহাড় তার নতুন এক অভিভাবক পেয়েছিল, এক অশরীরী, যার চুল এখন পাহাড়ের বাতাস হয়ে চিরকাল ভাসতে থাকবে।

শেষ

© পিনাকী রঞ্জন পাল

ছবি এআই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *