পিনাকী রঞ্জন পাল : মাঠের কোণের বহু পুরনো বিশাল। বট গাছটিতে কালু কাক ও এক পায়রা দম্পতি বাস করত। একদিন পুরুষ পায়রাটি খাবারের খোঁজে বেরিয়েছিল, আর স্ত্রী পায়রাটি ডিমে তা দিচ্ছিল। তখন এক শিকারী গুলতি দিয়ে স্ত্রী পায়রাটিকে মারার জন্য নিশানা ঠিক করছিল। কালু কাক বটের অন্য ডালে বসে এ সব লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি সতর্ক করে দিলে প্রাণ বাঁচাতে স্ত্রী পায়রাটি উড়ে অন্যত্র লুকিয়ে পড়ে।
ব্যর্থ শিকারি সেখান থেকে চলে গেলে কালু কাক অন্য পাখিদের কাছে গর্ব করে বলতে থাকা যে আজ সে না থাকলে পায়রাটি নির্ঘাৎ মারা পড়ত। সন্ধের সময় পুরুষ পায়রা ফিরে এলে স্ত্রী পায়রা তাকে সব ঘটনা বলে।
“কত ভাল কালু ভাই, সব পাখিরা মিছেই ওকে খারাপ বলে”, পুরুষ পায়রা বলে।
তাদের এসব আলোচনার মধ্যেই কালু কাক এসে উপস্থিত হয়।
“এসো এসো, কালু ভাই, তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ জানাব, তুমি আমার স্ত্রীর প্রাণ বাঁচিয়ে অশেষ উপকার করেছ।” পুরুষ পায়রা বলল। “আরে, এতে উপকারের কি আছে, এতো আমার কর্তব্য, আমি তা পালন করেছি মাত্র। কিন্তু আমি চাই তুমিও তোমার কর্তব্য পালন কর”, কালু কাক লোলুপ দৃষ্টিতে পায়রাদের ডিমগুলির দিকে তাকিয়ে বলল।
“আচ্ছা বলো, তোমার কি চাই?” পুরুষ পায়রা জানতে চাইল। “বেশি কিছু নয়, শুধু তোমাদের ডিমগুলো চাই। ভীষণ জোর খিদে পেয়েছে।” কালু কাক বলল।
এ কথা শুনে স্ত্রী পায়রা মনে ভীষণ আঘাত পেল। সে উদাস আর চিন্তিত হয়ে স্বামীর কানে কানে বলল, “এবার কি হবে?” পুরুষ পায়রা স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে জানাল, “চিন্তা কর না, আমি ডিমগুলিকে বাঁচাবার কোন না কোন উপায় অবশ্যই বার করব।”
পুরুষ পায়রা কালু কাককে বলল, “ডিম তো আমি তোমাকে অবশ্যই দেব, কিন্তু তোমাকে যে নিজের ঠোঁট যে ধুয়ে আসতে হবে, কেন না নোংরা ঠোঁট দিয়ে ডিম খেতে স্বাদ ভালো লাগে না।”
“ঠিক আছে, আমি এখনই আসছি,” বলে কালু কাক নদীর দিকে উড়ে গেল। “নদী বোন, আমি এক পায়রার প্রাণ বাঁচিয়েছি। তার স্বামী মামাকে তাদের ডিম খাওয়াবার কথা দিয়েছে, কিন্তু খাবার আগে ঠোঁট ধুয়ে আসতে বলেছে। তা আমি কি তোমার জল দিয়ে নিজের ঠোঁট ধুতে পারব?” কালু কাক বলল।
“না-না, তুমি আমার জল নোংরা করে ফেলবে। বরং, তুমি একটা পাত্র নিয়ে এসো, তাতে আমি তোমাকে জল দেব”, নদী বলল।
কালু কাক পাত্র আনতে উড়ে গেল এক কুমোরের কাছে, “কুমোর কাকা, তুমি কি আমাকে একটা পাত্র দেবে? আমি এক পায়রার প্রাণ বাঁচিয়েছি। তার স্বামী কথা দিয়েছে তাদের ডিম আমাকে দেবার, তবে খাবার আগে ঠোঁট ধুয়ে আসতে বলেছে। কিন্তু নদী বলেছে যে, একটা পাত্র নিয়ে গেলে সে তাতে আমাকে জল দেবে ঠোঁট ধোয়ার জন্য”।
“তোমাকে এক শর্তে আমি আমি পাত্র দিতে পারি। যদি তুমি আমায় হরিণের শিং এনে দিতে পার। যা দিয়ে আমার অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা হবে।” কুমোর জানালো।
কালু কাক এবার কুকুরের পৌঁছে বেড়িয়ে পড়ল। কিছুদূর গিয়ে সে এক কুকুরের সাক্ষাৎ গেল। কুকুরের কাছে গিয়ে কালু কাক বলল, “আমাকে সাহায্য কর। আমার দরকার একটি হরিণের শিং। আমি তোমাকে হরিণের কাছে নিয়ে যাব। তুমি আমাকে শিং দিয়ে নিজে মাংস খেয়ে নিও।”
“কিন্তু আমি তো ভীষণ দুর্বল, অনেকদিন থেকে কিছুই খাইনি। আমি কি দ্রুত দৌড়াতে সক্ষম হরিণকে ধাওয়া করে ধরতে পারব?” কুকুর জানায়।
লোভী কাক এবার গরুর কাছে গিয়ে তাকে সব খুলে বলে সাহায্য চাইল। কাকের কথা শুনে গরু বলল, “অকৃতজ্ঞ কাক, তোর চালাকির কথা আমি অনেক শুনেছি। আমি মূর্খ নই যে তোকে এমনিই দুধ দিয়ে দেব। প্রথমে আমার জন্য ঘাস আন, তবেই তোকে আমি দুধ দেব।”
কালু কাক পাশের একটি বাড়ি থেকে খুরপি চুরি করে গেল ঘাস কাটতে। খুরপি খারাপ থাকায় সে ঘাস কাটতে পারল না। খুরপি ধার করতে কালু কাক এবার গেল কামারের কাছে। তাকে পুরো কাহিনী শুনিয়ে কথা দিল যে তাকে সে হরিণের মাসে দেবে সাহায্যের বিনিময়ে। কামার খুরপি ঠিক করার জন্য আগুনে ঢুকিয়ে দিল। কাক দেরী হচ্ছে দেখে অধৈর্য হয়ে পড়ল। সে তাড়াতাড়ি কামারকে খুরপি ধার করে দিতে বলতে লাগল। কাকের এই ব্যস্ততা কামারের পছন্দ হয়নি। সে রেগে গিয়ে আগুন থেকে খুরপি বার করে বলল, “নাও নিয়ে যাও।”
কাক খুরপি ঠোঁটে চেপে ধরতেই চিৎকার করে উঠল। কেন না, আগুনে তপ্ত খুরপিতে কাকের ঠোঁট পুড়ে গিয়েছিল।
এ ঘটনার পর কালু কাকের পায়রার ডিম খাবার ইচ্ছা পরিত্যাগ করতে হয়েছিল, কারণ লোভ করার ফল সে হাতে হাতে পেয়েছিল।
অপরদিকে পায়রা দম্পতিও সুখে বাস করতে থাকল।