অরিগ্যামির গল্প

পিনাকী রঞ্জন পাল : মামাবাড়িতে ঢুকতেই গেটের পাশে দেখলাম ছোট সাইনবোর্ডটা, তাতে লেখা ‘ভলপাইগুড়ি অরিগ্যামি (Origami) আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্ট স্কুল, অভিনব জাপানী শিল্পকলা অরিগ্যামি শেখার একমাত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সাইনবোর্ডটা দেখে আমার মন আনন্দে নেচে উঠলো। কারণ এর টানেই তো মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হতেই মামাবাড়ি ছুটে এসেছি অতদুর থেকে। পরীক্ষার আগে ছোটমামা চিঠিতে লিখেছিল, ‘মন দিয়ে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দে। পরীক্ষা শেষে এখানে আসিস তোকে অরিগ্যামি শিখিয়ে দেব। কাগজ ভাঁজ করে সুন্দর সব মডেল তৈরি করে তুই বন্ধুদের উপহার দিতে পারবি। চিঠির সাথে একটা অরিগ্যামির টিয়াপাখি পাঠালাম।

মামার পাঠানো সেই টিয়াপাখিটা এখনো আমার ব্যাগে রয়েছে। বারবার টিয়াপাখিটা নেড়ে চেড়ে দেখেছি আর মনে মনে ভেবেছি একদিন আমিও এমনটা বানাতে পারবো। তাই আজ মামাবাড়িতে এসে আমার খুশির সীমা ছিল না।

রাতে খাবার টেবিলে ছোটমামার সাথে দেখা হল। চিঠির কথা মনে করিয়ে দিতেই বললো, ‘তুই আর আমি তো একই ঘরে শোব। তখনই তৈাকে অরিগ্যামি সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান দেব।’

আমি বললাম, ‘প্রাথমিক জ্ঞান দেবে, মানে?’

ছোটোমামা, ‘আরে ঘাবড়াবার কিছু নেই। এর অর্থ হল অরিগ্যামি কি? কিভাবে এর সৃষ্টি হল? ইত্যাদি অর্থাৎ অরিগ্যামি শেখার আগে তার ইতিহাসটা একটু জেনে নেওয়া।’

খাওয়া শেষ করে দু’জনে মামার ঘরে, এসে বসি। ছোটোমামা ড্রয়ার থেকে একটি সাদা কাগজ বার করে বলতে থাকে, ‘অরিগ্যামি জাপানের জনপ্রিয় শিল্পকলা। এদেশে এই শিল্পকলাটি তেমন প্রচলিত না হলেও জাপান ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকাতে অরিগ্যামি ব্যাপক প্রচলিত।’

আমি প্রশ্ন করি, ‘আচ্ছা মামা, অরিগ্যামি মানে কি ?

‘অরিগ্যামি শব্দটা জাপানী। এর মানে হল কাগজ ভাঁজ করা। যদিও কাগজ ভাঁজ করে হরেক রকম মডেল তৈরি প্রথম চীনে শুরু হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবেশী জাপানীদের হাতেই এই শিল্পটি সম্পূর্ণ নতুনভাবে বিকশিত হয়।’

‘অর্থাৎ চীনে জন্ম, কিন্তু বেড়ে ওঠে জাপানে’ আমি জানতে চাই।

‘অনেকটা তাই। চীনারা প্রথম যুগ থেকেই কাগজের স্বাভাবিক ব্যবহারের সাথে কাগজ ভাঁজ করে চীনা লণ্ঠন, চীনা পুতুল বানাতো। প্রতিবেশী জাপানীরা তাদের কাছ থেকে এই কায়দাটা আয়ত্ত করেছিল। জাপানে প্রতি বছর ১৫ নভেম্বর ‘শিচি-গো-সান’ উৎসব অর্থাৎ সাত-পাঁচ তিন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। উৎসবের দিন সকালে শহরের সমস্ত মানুষ মন্দিরে জমায়েত হয়। আর গোটা শহরে যেসব শিশু ঐদিন সাত-পাঁচ আর তিন বয়সে পা দিল, তারা তিনটি সারিতে গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে মন্দিরের সামনে। উৎসব শেষে বড়রা শিশুদের আশীর্বাদ করেন ও উপহার দেন। পরিচিত-অপরিচিত, আত্মীয় অনাত্মীয় কোনো বাছ-বিচার নেই। প্রায় দেড়-দুশো উপহার দিতে হত। প্রথমে উপহার হিসাবে দেওয়া হত একটা করে মিঠাই বিস্কুট। কিন্তু একজন শিশু যদি দেড়-দুশো মিঠাই বা বিস্কুট পায় তবে তো মুস্কিল। এই সমস্যার থেকে মুক্তি পেতে জাপানীরা মিঠাইয়ের পরিবর্তে কাগজের ভাঁজ করা খেলনা উপহার দিতে শুরু করে।’ লক্ষ্য করলাম এসব বলার ফাঁকে মামার দু’হাত ব্যস্ত রয়েছে সেই সাদা কাগজটাকে নিয়ে। বিভিন্ন ধরনের ভাঁজ খেয়ে সেই কাগজটি এক বিচিত্র আকার নিয়েছে।

আমার কৌতূহল বেড়েই চললো, ‘এটা কি বানাচ্ছো মামা?’

অরিগ্যামি কি?
অরিগ্যামি কারুশিল্প
অরিগ্যামি সমাচার
অরিগ্যামি কাগুজে বিস্ময়
অরিগ্যামি থেকে শিল্পকর্ম
অরিগ্যামি পেপার ক্রাফটিং
অরিগ্যামি কাগজের ভাঁজে মোহনীয় শিল্প
অরিগ্যামি কাগজ ভাঁজের খেলা

‘আর একটু ধৈর্য ধর দেখতে পাবি।’ মামা আবার বলা শুরু করলো, ‘প্রথম কয়েক শতাব্দী ধরে মাত্র কয়েক রকমের বাদে বারে বানানো হয়েছে। তারপর ‘মেইজী যুগে অরিগ্যামি শিল্প একেবারে নতুন রূপে বিস্তার লাভ করলো জাপানে। যার হাত ধরে এই শিল্প বিশ্বনন্দিত হল তিনি হলেন আকিরা যোশিযাওয়া।’

‘আকিরা যোশিযাওয়া—তিনি কে?’ আমার জিজ্ঞাসু মন প্রশ্ন করে।

‘আকিরা যোশিযাওয়া হলেন অরিগ্যামি শিল্পের জনক। তিনি ১৯১১ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোট থেকেই অরিগ্যামির প্রতি যোশিযাওয়ার একটা আলাদা টান ছিল। স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি অরিগ্যামি শিখতে শুরু করেন। তবে সিরিয়াসভাবে অরিগ্যামি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা আরম্ভ করেন ১৯৩৮ সালে একটি স্টিল মিলে কাজ পাবার পরে। তিনি নতুন ‘বেস’ আবিষ্কার করে নতুন নতুন মডেল বানাতে থাকলেন। তার অসংখ্য ছাত্র হল। অরিগ্যামি শিল্পের প্রচারের জন্য যোশিযাওয়া প্রদর্শনী ও প্রচার মাধ্যমে লেখালেখি আরম্ভ করেন। ১৯৫৪ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইন্টারন্যাশনাল অরিগ্যামি সোসাইটি। যা বিশ্বব্যাপী অরিগ্যামি প্রেমীদের একসূত্রে বাঁধার কাজ করে থাকে। যোশিযাওয়ার হাতে এই শিল্প এত উন্নত হল যে তিনি কাগজ ভাঁজ করে মানুষের প্রতিকৃতি পর্যন্ত বানাতে শুরু করলেন। অরিগ্যামি নিয়ে যোশিয়াওয়া বেশ কিছু পুস্তক লিখেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রদর্শনী ও বক্তব্য রেখেছেন। জাপানের টোকিও শহরে তার অরিগ্যামি কেন্দ্রে প্রতিদিন নতুন নতুন মডেল তৈরি হচ্ছে।’ ছোটমামা অরিগ্যামির গল্প শোনাচ্ছে আর দু’হাত ব্যস্ত কাগজ ভাঁজ করতে। মডেলটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। মনে হয় এটাও কোন পাখিই হবে।

একটু থেমে একটা ভাঁজকে আঙ্গুল দিয়ে আরো দু-চার বার চেপে ছোটমামা বলতে শুরু করে, তুই দেখলে অবাক হয়ে যাবি যে একটা সাধারণ কাগজকে ভাঁজ করে অসাধারণ সব মডেল তৈরি করা যায়। কুকুর, তিমি, ষাঁড়, মোরগ, সিংহ, ময়ূর আরো অনেক কিছু।’

মামাকে বাধা দিয়ে বলি, ‘আচ্ছা হরিণ বানানো যাবে। তারপর ব্যাঙ বা ছাগল?’

মামা কাগজ ভাঁজ দেওয়া বন্ধ করে। বলে, ‘হ্যাঁ সব বানানো যায়। আমি যে এখন বানাচ্ছি, এটা কি বলতো?

আমি বলি, ‘কি?’

“এটা হচ্ছে মোরগের মডেল। কাজ হলেই স্পষ্ট বুঝতে পারবি। আচ্ছা তুই যে ছেলেবেলায় বর্ষাকালে কাগজের নৌকা বানিয়ে জলে ভাসিয়ে দিতি, মনে আছে ওটাও অরিগ্যামি, তবে সেটা প্রাথমিক স্তরের একটা সহজ মডেল।’ বলতে বলতে ছোটমামার দুই হাতের মাঝে ছোট্ট একটা মোরগ উঠে দাঁড়ায়। আমার মনে হয় যেন মোরগটি এখনই ডাক দিয়ে উঠবে।

ছোটমামা মোরগটিকে আমার হাতে দিয়ে বললো, ‘অরিগ্যামি শিল্পে আঠার ব্যবহার প্রায় নিষিদ্ধ। বিশ্বের কয়েকজন অরিগ্যামি বিশারদ হলেন কবি শেলী, সাহিত্যিক লুই ক্যারল, স্প্যানিশ দার্শনিক মিওয়েল-ডি-উনামুনো, চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, যাদুকর হুডিনি প্রভৃতি।

‘অ্যালিসেস্ অ্যাডভেঞ্চার ইন ওয়ান্ডার ল্যান্ডের লেখক লুই ক্যারলও অরিগ্যামি বানাতেন।’ আমার জিজ্ঞাসা শান্ত করতে মামা বলেন, ‘লুই ক্যারল শুধু লেখক বা গণিতজ্ঞ নন, তিনি ছিলেন পাকা অরিগ্যামি মাস্টার। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘ডাচেস্ অব আলবানিয় শিশুদের আনন্দ দিতে আমি অবসর সময়ে কাগজ ভাঁজ করে নৌকা অথবা পিস্তল বানাতাম। জাপানের যোশিয়াওয়ার মতোই অরিগ্যামিকে সমৃদ্ধ করেছেন আমেরিকার ফ্রেড জি রোজ্ম, জর্জ রোডস্, ফাদার রবার্ট নীল, আর্জেন্টিনার সিনোরিনা লিগিয়া মণ্টায়া, দঃ আফ্রিকার রবার্ট হারবিন প্রমুখ। আমেরিকায় অরিগ্যামিকে জনপ্রিয় করেছিলেন শ্রীমতী লিলিয়ান ওপেনহাইমার। তিনি একটি স্কুল ও ‘দি অরিগ্যামিয়ান’ নামে একটি পত্রিকা বার করেছিলেন।

‘আর ভারতে অরিগ্যামিকে জনপ্রিয় করতে তুমি স্কুল খুলেছ, তাই না ছোটমামা.’ আমি হেসে বলি।

‘তুই তো বেশ ফাজিল হয়েছিস দেখছি। যাক আজ আর নয়। রাত অনেক হল। এখন শুয়ে পড়। গুড নাইট।’ বলে মামা ঘুমোবার প্রস্তুতি নেয়।

Photo source- Pixabay.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *