পাকিস্তান নামা : পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে শেহবাজ শরিফ, দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক এবার কোন পথে?

অরুণ কুমার : প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক পালাবদলের পেক্ষাপটে বেশ কিছু বিষয় সামনে এসেছে। ইমরান খানের বিদায়ের পর উজিরে আজম হয়েছেন শেহবাজ শরীফ। স্বাভাবিক কারণে এই প্রশ্নটা দেখা দিয়েছে এর ফলে ভারতের কী লাভ হতে পারে? বা এর ফলে ভারতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক কোন পথে এগোতে পারে?

যদিও একথা ঠিক যে, দেশের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পরে শেহবাজ শরিফ বলেন, “আমরা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। কাশ্মীর সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত স্থায়ী শান্তি সম্ভব নয়। পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ সোমবার একথা বলেছেন।

আমরা যদি একটু ইতিহাসের পাতায় ফিরে দেখি, তাহলে দেখতে পাবো, ২০১৯ -এর আগস্ট মাসে ভারত যখন সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করে দিল তখন ‘আন্তরিক কূটনৈতিক উদ্যোগ’ না নেওয়ার জন্য ইমরান খানকে আক্রমণ করেন শেহবাজ শরিফ। সেই সময় পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রচন্ড সমালোচনার মুখে পড়েন।

এরপর সিন্ধু বিতস্তা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। কিছু কথা নতুন মোড়কে বলার চেষ্টা করেছেন শেহবাজ শরিফ। দু’টো দেশ যাতে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও ওষুধপত্র -সংকটের মোকাবিলা এবং সীমান্তের দুই দিকের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে নজর দিতে পারে তার জন্য কাশ্মীর বিষয়টি সমাধান করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নতুন পাক প্রধানমন্ত্রী।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০১৯ -এর আগস্ট মাসে জম্মু- কাশ্মীরের বিশেষ ক্ষমতা প্রত্যাহার এবং রাজ্যকে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করা সংক্রান্ত দিল্লির ঘোষণার পর থেকেই ভারত- পাকিস্তান সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছে।

এদিকে পাকিস্তানকে ভারত বার বার বলেছে, জম্মু- কাশ্মীর ভারতের অচ্ছেদ্য অঙ্গ “ছিল, আছে এবং চিরকাল থাকবে”। ভারত পাকিস্তানকে এও বলেছে, তারা সন্ত্রাস, শত্রুতা এবং হিংসামুক্ত পরিবেশে দু’ দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক চায়।

এই রকম অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আঁচ করাই যাচ্ছে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন ভারতের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। এর একটি কারণ হল পাকিস্তান এমন একটি প্রতিবেশী দেশ যারা মুখে শান্তির কথা বলে, কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে না। ভারত স্পষ্ট জানিয়েছে, সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোচনা না হলে কাশ্মীর নিয়েও কোনও আলোচনা হবে না। তবে শাহবাজ শরিফের কথায়, পাকিস্তানের কোনও নেতাই সন্ত্রাস ইস্যুতে কথা বলতে চান না।

গত ২০১৪-র ফেব্রুয়ারিতে, শাহবাজ বলেছিলেন যে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থাগুলিই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তিতে সবচেয়ে বড় বাধা। দুই দেশের মধ্যে ‘অর্থনৈতিক নিরাপত্তা’ না থাকলে সাধারণ নিরাপত্তা হতে পারে না।

তাঁর পুরনো বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক চান, কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে তাঁর মনোভাব বিশেষ ভালো নয়। ইমরান খানের সরকারের অধীনে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছিল, কারণ ইমরান ক্রমাগত কাশ্মীর ইস্যু উত্থাপন করেন। শাহবাজও একই পথের পথিক। কাশ্মীর ইস্যু উত্থাপনের কোনও সুযোগ তিনি হাতছাড়া করবেন না কিম্বা বলা যায় করতে চাইবেন না।

প্রসঙ্গত, উল্লেখ করতে হয় যে, ২০১৮-র জুনে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন সিঙ্গাপুরে বৈঠক করেন। শাহবাজ শরিফও এই বৈঠককে ভারত- পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। সে সময় শাহবাজ ট্যুইট করেন, “আমেরিকা ও উত্তর কোরিয়া যদি পারমাণবিক হামলার দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে আসতে পারে, তাহলে ভারত ও পাকিস্তান না পারার কোনও কারণ নেই।” সেইসময় ও তিনি কাশ্মীরের আলোচনার প্রসঙ্গ তুলে ধরেছিলেন।

এটা পরিষ্কার যে পাকিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসবাদীরা অবাধে বসবাস করছে। ভারত প্রায়ই আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি তুলে ধরেছে যে পাকিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসবাদ রয়েছে এবং সেগুলি ভারতের বিরুদ্ধে কাজ করে। পাকিস্তানের কোনও নেতা এটা মেনে নেয় না, শাহবাজ শরিফ উল্টে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) নাম নিয়ে শরিফ বলেন, RSS বরাবরই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। শরিফ আরও অভিযোগ করেছিলেন যে ভারত বেলুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন করে এবং তার কাছে এর জন্য শক্ত প্রমাণ রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, উভয় দেশেরই দোষারোপের খেলা বন্ধ করা উচিত এবং একটি পরিষ্কার এজেন্ডা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত।

পাকিস্তানে ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চিনেরও সুর পাল্টেছে। চিনের সরকারি সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমস বলছে, ইমরান খানের চেয়ে শাহবাজ শরিফের আমলে চিন ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো হতে পারে। গ্লোবাল টাইমস বলছে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার পরিবর্তন চিন ও পাকিস্তানের সম্পর্কের ওপর কোনও প্রভাব ফেলবে না। ইমরান খানের আমলে যেভাবে দু’দেশের সম্পর্ক ছিল, শরিফের আমলে তা আরও ভালো হতে পারে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলের ধারণা।

শাহবাজ শরিফ তিনবার পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি প্রায়ই পাকিস্তানি পঞ্জাব এবং ভারতীয় পঞ্জাবকে একসঙ্গে কাজ করার কথা বলেছেন। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে শাহবাজ শরিফ ভারত সফরে আসেন। এরপর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গেও দেখা করেন তিনি।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিদায়ের পর ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অর্থাৎ পার্লামেন্টের ৩৪২ জন সদস্যের মধ্যে মি. শরিফের পক্ষে ভোট দেন ১৭৪ জন – জানান ভারপ্রাপ্ত স্পিকার আইয়ায সাদিক। শাহবাজ শরিফ হচ্ছেন পাকিস্তানের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী। তিনি ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন। এই ঘো্ষণার পর পার্লামেন্টে উপস্থিত এমপিরা শাহবাজ শরিফের নামে শ্লোগান দিতে থাকেন। শাহবাজ শরিফ এরপর পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রীর আসনে গিয়ে বসেন । তিনি তার ভাষণে বলেন, ‘অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয় হয়েছে’, এবং তিনি তার ভাষায় ‘পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য’ আল্লাহকে ধন্যবাদ দেন।

এতো কথা বলার পাশাপাশি এখন দেখার বিষয় হলো দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক জল কতদূর যায়। এজন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

Photo source- ANI official FB page.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *