পিনাকী রঞ্জন পাল
বহু পুরনো দিনের কথা। নারদ ত্রিলোক ভ্রমণের সময় পৃথিবীতে ভ্রমণ করছিলেন। সেই সময় তাঁর ভীষণ ক্ষিদে পায়। কিন্তু তাঁর আহার করার সময় ছিল না। আলাদা করে অন্ন আর আলাদা জল পান করাটা তাঁর পছন্দ ছিল না এবং এতে সময়ও বেশি লাগার সম্ভাবনা। তিনি এক পথিককে জিজ্ঞেস করেন, ‘ভাই, আমাকে এমন আহার করাতে পারবে যাতে জল আর অন্ন একত্রে থাকবে। আলাদা আলাদা অন্ন জল গ্রহণ করে আমি অমূল্য সময় নষ্ট করতে চাই না।”
যে ব্যক্তির নিকটে নারদমুনি একত্রে অন্ন-জলের কথা বলেছিলেন তিনি ছিলেন ছত্তিশগড়ের বাসিন্দা আর নারদমুনি তখন ছত্তিশগড় দিয়েই যাচ্ছিলেন। নারদমুনির কথা শুনে সেই ব্যক্তি বলেন, ‘এরকম আহার তো এখানকার ঘরে ঘরে পাওয়া যাবে। এখানকার লোকেরা অন্ন আর জল, অর্থাৎ ভাত আর জল একত্রে মিলিয়ে বাসি করে খায়। আপনি কি এই পান্তা ভাত খাওয়া পছন্দ করবেন?
ক্ষিদের জ্বালায় অস্থির নারদমুনি বিনা দ্বিধায় এই পান্তা আহারে রাজি হয়ে যান। ছত্তিশগড়ের সেই কৃষক নারদমুনিকে বড়ই আদরের সঙ্গে নিজের বাড়ি নিয়ে যান। হাত-পা ধুইয়ে দিয়ে তাঁর বীণাটিকে ঘরের এক কোণায় রেখে দেন। এরপর বসার স্থান গোবর দিয়ে লেপে নারদমুনিকে বসার আসন দেন। তারপরে পান্তা ভাতের সঙ্গে ধনে, লঙ্কা আর টম্যাটোর চাটনি দিয়ে পরিবেশন করেন।
নারদমুনি পান্তা খেতে থাকেন। এরকম সুস্বাদু অন্ন-জল তিনি আগে কোন দিনও খাননি। পান্তা খেতে খেতে তিনি জিজ্ঞেস করেন—’কৃষক ভাই, তোমরা কি এই খাবারই খাও?’
কৃষক ‘হ্যাঁ’ বললে নারদমুনি চিন্তা করেন, ‘এমন সুস্বাদু অন্ন-জল তো স্বর্গেও পাওয়া যায় না। দেবতারাও এর সংবাদ জানেন না, তবে নমুনা হিসাবে এই পান্তা খানিকটা স্বর্গে নিয়ে গেলে কেমন হয়!’ যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। তিনি কৃষককে বলেন, ‘কৃষক ভাই, কষ্ট করে এক হাঁড়ি পান্তা তৈরি করে দেবে, আমি সেটা স্বর্গে নিয়ে দেবতাদের খাওয়াব। দেবতারা তাঁদের অমৃতকে নিয়ে ভীষণ গর্ব করেন। যদি পান্তা আর চাটনি খেয়ে তাঁরা নিজেদের অমৃতের গর্ব ভুলে না যান তবে আমার নাম নারদ নয়।’
ছত্তিশগড়ের সহজ-সরল কৃষক পান্তার গুণগান নারদমুনির মুখে শুনে দারুণ খুশি হন। তিনি ভাবেন পান্তার হাঁড়ি নিয়ে স্বর্গ পর্যন্ত যেতে নারদমুনির ভীষণ কষ্ট হবে, এই জন্য তাঁর সাহায্যের দরকার আছে। তিনি বলেন, ‘মহাপ্রভু, আপনি ছত্তিশগড়ের পান্তা খেয়ে আমাদের ধন্য করেছেন। এতদূর স্বর্গ পর্যন্ত এক হাঁড়ি পান্তা আর চাটনি নিয়ে যেতে আপনার কষ্ট হবে। এমন কষ্ট দেওয়া আমার অপরাধ হবে, এইজন্য প্রভু এই অপরাধ থেকে আমাকে বাঁচান আর সেবা করার অনুমতি দিন।’
“ঠিক আছে, পান্তা আর চাটনি তুমি নিয়ে চল। আমি নিজের বীণা নিয়েই যাব।’ নারদমুনি সেই কৃষককে পান্তা আর চাটনি নিয়ে যাবার অনুমতি দেওয়ার সময় ভুলেই গিয়েছিলেন যে, পৃথিবীর কোন জীবিত ব্যক্তি স্বর্গে যেতে পারে না। পান্তা আহার করে নারদমুনি এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি ছত্তিশগড় আর স্বর্গের মধ্যেকার পার্থক্য ভুলে গিয়েছিলেন।
ছত্তিশগড়ের সেই কৃষক হাঁড়ি ভরা পান্তা আর বাটি ভরা চাটনি নিয়ে রওনা হলেন নারদমুনির সঙ্গে। আকাশ পথে তাঁরা স্বর্গ অভিমুখে যাচ্ছিলেন। পথে ছিল না কোন রকম শোরগোল, ভিড়, না কোন রকম কষ্ট অনুভব হচ্ছিল। কৃষক এই অভিনব যাত্রা ভীষণভাবে উপভোগ করছিলেন।
স্বর্গে পৌঁছে নারদমুনি ইন্দ্রের দরবারে সর্বপ্রথম উপস্থিত হন। নারদমুনির সঙ্গে সেই কৃষককে প্রত্যক্ষ করে দেবরাজ ইন্দ্ৰ শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘দেবর্ষি, আপনার সঙ্গে এই মানব কেন? আপনি তো স্বর্গের নিয়মকানুন ভাল করেই। জানেন যে এখানে কোন জীবিত মানুষ আসতে পারে না।
তখন দেবর্ষি নারদ নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলেন, ‘দেবরাজ, দারণ ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু আপনি যখন ছত্তিশগড়ের পান্তা আর টম্যাটো, লঙ্কা এবং ধনের চাটনি খাবেন তখন আপনিও এই ভুল করবেন।”
নারদমুনি সোনার পাত্র আনিয়ে ইন্দ্ৰ সহ দরবারে উপস্থিত সকল দেবতাকে ছত্তিশগড়ের পান্তা আর চাটনি পরিবেশন করেন। এই বিচিত্র আহার সকলেই তারিয়ে তারিয়ে ভক্ষণ করেন। আহার শেষে সকলেই আমাকে আরও দাও, আমাকে আর একটু…. বলে ছত্তিশগড়ের সেই কৃষকের নিকট চাইতে থাকেন। কিন্তু পান্তা শেষ হয়ে গিয়েছিল। কেউই ভরপেট পান্তা পাননি। দেবরাজ ইন্দ্র সকলকে অসন্তুষ্ট দেখে বলেন, ‘আপনারা চিন্তা করবেন না, আমরা সকলে স্বয়ং ছত্তিশগড়ের পান্তা ভক্ষণ করতে যাব।”
দেবরাজের কথা শুনে ছত্তিশগড়ের কৃষক জোড়হাত করে পান্তা খাবার আমন্ত্রণ জানান আর ফিরে আসার ইচ্ছা প্রকট করলে দেবরাজ ইন্দ্র তাকে অমৃত পান করে যাবার কথা বলেন। কিন্তু কৃষক বলেন, ‘অমৃত পান করলে তো অমর হতে হবে আর আমাকে এখন পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে। কৃষকের কথা শুনে দেবরাজ ইন্দ্ৰ হেসে ওঠেন।
তখন থেকেই এমনটা মনে করা হয়। যে প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসে অন্নপূর্ণা লক্ষ্মী, ভগবান বিষ্ণু সহ স্বর্গের সমস্ত দেবগণ ছত্তিশগড়ের পান্তা আর চাটনি খেতে বৃহস্পতিবার করে আসেন। কেননা শীতের রৌদ্রে বসে পান্তা আর ধনে, লঙ্কা এবং টম্যাটোর চাটনি খাবার মজাই আলাদা।
Photo credit by Nikhil Das (courtesy of Dainik Basumati)