ফুলে ফুলে ভরা “পেলিং”

পিনাকী রঞ্জন পাল : ভ্রমণের কথা উঠলেই আমার পাহাড়ের কথা মনে পড়ে। পাহাড় আমায় ভীষণ টানে। তাই দেবাশিস বেড়াতে যাবার কথা বলতেই ঠিক করলাম এবার কাঞ্চনজঙ্ঘার পূর্বঢালে ফুলে ফুলে ভরা ‘হিমালয়ের উদ্যান’ সিকিমের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র পেলিং যাব।

পেলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা

শিলিগুড়ি থেকে পেলিং-এর দূরত্ব ১৩০ কিলোমিটার, আর গ্যাংটক থেকে ১১৭ কিমি। পশ্চিম সিকিমের ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার গেজিং থেকে ১১ কিমি উত্তর-পশ্চিমে ৬৮০০ ফুট উচ্চতায় এই জনপদ অবস্থিত। পেলিং জায়গাটি সিমলা, মানালি বা দার্জিলিং প্রভৃতি শৈলশহরগুলির মত জমজমাট বা ঘিঞ্জি হিল স্টেশন নয়। এটি খাজিয়ার বা ডালহৌসির মত একটু কম জাঁকজমকপূর্ণ। যারা একটু নিরিবিলি পছন্দ করেন বা যাঁরা কিছুটা একান্ত প্রকৃতির কোলে নিজেকে সঁপে দিতে চান, তাঁদের পক্ষে শান্তির জায়গা হচ্ছে পেলিং।

খেচিপেরি লেকের মনাস্ট্রি

এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ‘বাক্স-প্যাটরা’ গুছিয়ে আমরা চারমূর্তি অর্থাৎ আমি, দেবাশিস, নিমাই আর বিজন মেঘলা আকাশকে সঙ্গী করে জলপাইগুড়ি থেকে রওনা দিলাম পেলিং যাবার জন্য শিলিগুড়ির উদ্দেশে। শিলিগুড়ির সিকিম স্টেট ট্রান্সপোর্ট বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসে শুরু হল আমাদের পেলিং যাত্রা।

খেচিপেরি লেক

শহরের ভিড় পার করে একসময় আমাদের বাস প্রকৃতির কোলে এসে পড়ল। শুরু হল ওপরে ওঠার পালা। বাড়াই পাহাড়ের গা ঘেঁষা পথ ধরে বাস এগিয়ে চলল সবুজ বনস্পতিকে দু’পাশে রেখে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সুন্দরী তিস্তা। কখনও সে চলেছে একেবারে গা ঘেঁষে, আবার কখনও বা চলে গেছে সবুজে ছোঁয়া যাদের তলায়, আবার চলে যাচ্ছে বহু দূরে। মনে হচ্ছে আমরা চলেছি কোন বনভূমির মধ্য দিয়ে যার দু’দিকে শুধু নজরে আসছে প্রচুর গাছ-গাছালি। দিনের সূর্য রশ্মিও যেন মাটিকে স্পর্শ করতে অপারগ। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে পাখির কাকলি। যেতে যেতে নজরে এলো সবুজের ঢালে কিছু ধানক্ষেত, চোখে পড়ল তারই লাগোয়া কয়েকটি গ্রাম যেখানে ছড়ান ছিটান অবস্থায় রয়েছে কিছু কিছু ঘরবাড়ি। পড়ন্ত বেলায় আমরা এসে পৌঁছলাম। গেজিংয়ে। এটি একটি জেলা শহর। এখান থেকে পেলিং-এর দূরত্ব মাত্র ১১ কিমি। সারাটা রাস্তাই আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। গেজিং থেকে যাত্রা শুরু হওয়ার কিছু পরেই অন্ধকার নেমে এল পাহাড়ের গায়ে, মুছে দিল নিসর্গের দৃশ্য। হেড লাইটের আলোতে পথ আলোকিত করে বাস ছুটে চলল পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই ধরে। সন্ধ্যায় আমরা পৌঁছলাম পেলিং বাসস্ট্যান্ডে। বাস ছেড়ে রাস্তায় পা দিয়েই দেখলাম রাস্তা কর্দমাক্ত অর্থাৎ দিনে বৃষ্টি হয়েছে। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল আজকাল প্রায়ই বৃষ্টি হচ্ছে। লোয়ার পেলিং-এর স্যামথেনলিং লজে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়। সারাদিন গাড়ি চড়ে সকলেই ক্লান্ত, তাই খাওয়া-দাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি।

কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলস

পরদিন ভোরে যথারীতি আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন। ফলে তুষার শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার যে স্বর্গীয় সৌন্দর্য দেখার জন্য আমরা ছুটে এসেছিলাম তা থেকে বঞ্চিতই থেকে গেলাম। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে গোয়েচালা, মাউন্ট পান্তিম, কাবুর নর্থ ও সাউথ এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারাচ্ছন্ন শৃঙ্গগুলির ভূবনভোলান সৌন্দর্য দেখা যায়। তাই পোলিং গেলে উচিত হবে হোটেলে ভিউরূম নেওয়া।

খেচিপেরি লেক

একটু পরেই জিপ চলে এল আমাদের পেলিং-এর সাইট সিয়িং করাবার জন্য। অর্ধবৃত্তাকার পাহাড়ি পথ ধরে আমাদের জিপ এগিয়ে চলে। প্রথম গন্তব্যস্থল পেলিং ছাড়িয়ে ২ কিমি দূরের পেমিয়াংসি গুম্ফা। ১৬৯৭ সালে লাটসুন চেম্পো এখানে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে মন্দিরটি গুম্ফায় পরিণত হয়। চারতলা সমান উঁচু রক্তিম বর্ণের বর্তমান গুস্ফাটি সিকিমের দ্বিতীয় প্রাচীনতম মনাস্ট্রি। গুল্ফার বাহ্যিক রূপটি বড় সুন্দর হয়ে। উঠেছে এর সুক্ষ্মনিপুণ কাঠের কারুকার্যের জন্য। গুম্ফার কেন্দ্রস্থলে রয়েছে ধাতুনির্মিত বিশাল বুদ্ধের ধ্যানগম্ভীর মূর্তি। বুদ্ধমূর্তি ছাড়াও রয়েছে, বজ্রকালা, বজ্রপাল, পদ্মসম্ভাবা এবং লোককিশোরের মূর্তি। গুম্ফার তিনতলায় রয়েছে মহাগুড়ির স্বর্গীয় প্রাসাদ ‘সাংতোকপালরি’। এর কাঠের ভাস্কর্য সকলকে মুগ্ধ করে দেয়।

এরপর জিপ চলল কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলসের পথে। প্রায় ৩২ কিমি পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে আমরা এলাম ফলসের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে সামনে পড়ল একটি ফলস, যার জলধারা প্রায় ২০০ ফুট উঁচু থেকে শক্ত পাথরের গা বেয়ে আছড়ে পড়ছে। কিন্তু এটাই সব নয়, আসল ফলসটি একটু ভিতরে দু’টি পাহাড়ের খাঁজে এর অবস্থান। কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলসের কাছে পৌঁছনোর রাস্তা বেশ বিপজ্জনক। রাস্তা থেকে নেমে বড় বড় পাথর ডিঙিয়ে এলাম বিরাট উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে। এখানে পাতা বাঁশের মই বেয়ে ৩০ ফুট ওঠার পর ভাঙা একটি বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে এলাম কাঞ্চনজঙ্খা ফলসের সামনে। প্রায় ৫০০ ফুট উঁচু থেকে প্রবল জলধারা আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের গা-ঘেঁষে তলদেশের বড় বড় প্রস্তর খণ্ডের ওপর। জলধারার প্রবল গর্জনে সৃষ্টি হয়েছে এক আনন্দমুখর পরিবেশ। ১৯৯৫ সালে তবজোর ভুটিয়া নামে স্থানীয় এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক এই ফলসটি আবিষ্কার করেন।

প্রাণভরে কাঞ্চনজরা ফলস দর্শনের পর জিপ আমাদের নিয়ে ছুটলো খেচিপেরি লেকের দিকে। পেলিং থেকে খেচিপেরি লেকের দূরত্ব ২৬ কিমি। জিপ এসে থামল লেকে ঢোকার মুখে প্রধান গেটের সামনে। এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে লেকের কাছে। চোখে পড়ল একটা সাইনবোর্ড। লেখা রয়েছে “ইচ্ছাপূরণ হ্রদ”। পবিত্র এই হ্রদে ধুমপান, হট্টগোল করা, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া নিষিদ্ধ। চলার পথ বেশ অন্ধকার, মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসছে বিচিত্র পাখির কলরব। কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখা মিলল ঘন সবুজ বনানী ঘেরা স্বচ্ছ টলটলে জলের হ্রদ। পবিত্র এই লেকের বৈশিষ্ট্য হল, চারপাশে প্রচুর সবুজ গাছ তাদের পাতাগুলি ডুবিয়ে দিয়েছে লেকের জলে, কিন্তু লেকে একটিও পাতা আপনি কখনও পড়ে থাকতে দেখবেন না। বলা হয়, কোন পাতা জলে পড়লে তৎক্ষণাৎ পাখি এসে তা ঠোটে করে তুলে নেয়। কাঠের রেলিং ধরে তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি এই অপরূপ প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য। ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে নীল জলের ওপর সৃষ্টি হয়েছে এক মনোমুগ্ধকর নৈসর্গিক সৌন্দর্য। লেকের ধারে একটি ছোট্ট মন্দির আছে। শুনলাম মনস্কামনা পূরণ হলে ভক্তরা এসে এখানে তাদের ধর্মের ধ্বজা বেঁধে যায়।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল হল— সিংসোর সাসপেনশন ব্রিজ। পথে পড়ল রিম্বি সাসপেনশন ব্রিজ। সম্পূর্ণ কাঠের এই ব্রিজটি পেরিয়ে এলাম পাহাড়ের আর একদিকে। এখানে পড়ল একটি জলপ্রপাত, যা রিম্বি ফলস নামে পরিচিত। প্রায় ১৮০ ফুট উঁচু এই ফলসের ডানদিকে একটু দূরে রিম্বি নদীর ওপর গড়ে উঠেছে হাইডেল প্রোজেক্ট। আরও কিছুটা যাওয়ার পর আমরা পৌঁছালাম এশিয়ার সবচেয়ে উচ্চতম গর্জ ব্রিজ সিংসোর সেতুতে। পেলিং থেকে এই সেতুর দূরত্ব ২০ কিমি। দু’টি পাহাড়কে যুক্ত করে ঝুলন্তভাবে নির্মিত হয়েছে এই আশ্চর্য লসেতু। সবুজ পাহাড়ের মনোরম পরিবেশে এই সেতুর শোভা এককথায় অপূর্ব।

এবার ফিরে যাবার পালা। ৯ কিমি যাওয়ার পর পথে পড়ল সাঙ্গে ফলস। এর উচ্চতা ২০০ ফুট। পর্যটকদের কাছে মাঝারি উচ্চতার এই ফলসটির আকর্ষণও কম নয়। দেখতে দেখতে দিন ফুরিয়ে এল। অন্ধকার নেমে এল পাহাড়ের কোলে, জিপের চড়া আলোয় পথকে আলোকিত করে আমরা এগিয়ে চললাম পেলিং শহরের দিকে। একসময় অঝোরে শুরু হল বৃষ্টি।

বৃষ্টিস্নাত পেলিংকে পরদিন ভোরে বিদায় জানিয়ে বলি—’আবার আসিব ফিরে’, কেননা পেলিংকে প্রাণভরে যে দেখাই হল না। ঘন কুয়াশার চাদর পেলিংকে ঢেকে আমাদের জিপ ছুটে চলল সবুজ বনানীর মধ্য দিয়ে। সমতলের দিকে।

প্রয়োজনীয় তথ্য কিভাবে যাবেন : শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ডের অপরদিকে আছে সিকিম স্টেট ট্রান্সপোর্ট বাসস্ট্যান্ড। এই স্ট্যান্ড থেকে পেলিং বা গেইজিং যাবার বাস পাওয়া যায়। এ ছাড়াও স্ট্যান্ডের সামনে অনেক শেয়ার জিপ বা মারুতিও পাবেন পেলিং যাবার।

কোথায় থাকবেন : আপার ও লোয়ার মিলিয়ে মধ্যবিত্তদের নাগালের মধ্যে প্রায় ২৫টা হোটেল আছে। এ ছাড়াও পেমিয়াংশিতে আছে সিকিম ট্যুরিজম পরিচালিত হোটেল ‘মাউন্ট পান্তিম’। এদের নিজস্ব গাড়িতে দর্শনীয় স্থানগুলি দেখাবার ব্যবস্থা আছে। অন্য হোটেলগুলি থেকেও সাইট সিয়িং-এর ব্যবস্থা রয়েছে।

picture credit raja mukherjee

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *