পিনাকী রঞ্জন পাল
অনেক অনেকদিন আগের ঘটনা। তখন আফ্রিকার কঙ্গো প্রদেশে রাজা এম্বিয়ার শাসন ছিল। তিনি ভীষণ অত্যাচারী রাজা ছিলেন। রাজা এম্বিয়া তাঁর রাজ্যের সীমানায় পাহারারত সৈনিকদের আদেশ দিয়েছিলেন যে, যদি কোন বিদেশীকে সীমান্তের আশপাশে দেখা যায় তবে তৎক্ষণাৎ তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে।
আসলে রাজা এম্বিয়া ছিলেন একজন নরখাদক। তিনি মানুষের মাংস অতি আনন্দ সহকারে ভোজন করতেন। বন্দী বিদেশীদের কয়েকদিন আটকে রেখে ভারপর তাদের পশুর মত কেটে মাংস খেতেন রাজা এম্বিয়া।
সময় ছিল শীতকাল। রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে রাস্তা হারিয়ে প্রতিবেশী দেশ অ্যাঙ্গোলার একদল সৈনিক কঙ্গোর সীমানায় এসে উপস্থিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে কঙ্গোর সৈনিকরা তাদেরকে ঘিরে ফেলে। বন্দী করে তাদেরকে রাজার কাছে নিয়ে গেলে এম্বিয়া খুশিতে নেচে ওঠেন। বলেন, ‘যাও এদের নিয়ে কারাগারে বন্দী করে রাখ, কাল থেকে প্রতিদিন এক-একজনকে হত্যা করা হবে।’
রাজা এম্বিয়ার আদেশমত অ্যাঙ্গোলার সৈনিকদের কারাগারে আটকে রাখা হয়। তারা মোট কুড়ি জন ছিল। আলকামা পোলিশ নামে এক ব্যক্তি ছিল তাদের সেনাপতি। সে নিজের প্রাণের চেয়েও সঙ্গী সৈনিকদের নিয়ে চিন্তিত ছিল বেশি। সারারাত ধরে সে অত্যাচারী রাজা এম্বিয়ার কবল থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতে থাকে। ভোরের দিকে হঠাৎ তার মনে পড়ে, “আরে, আজ তো চন্দ্রগ্রহণ হবে।’ পর মুহূর্তে পোলিশের মুখে খুশির হাসি ভেসে ওঠে।
সকালে ভয়ানক শব্দের সঙ্গে কারাগারের ফাটক খোলে। রাজা এম্বিয়া নিজের এক বিশ্বস্ত সৈনিকের সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করেন। সে কোনরকম ভূমিকা না করেই পোলিশকে বলে, ‘সেনাপতি তোমার জীবনের অন্তিম মুহূর্ত এসে গেছে। মরবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও।’
এ কথা শুনে পোলিশ হাসতে হাসতে বলে, ‘তুমি একদম মূর্খ। তুমি আমাকে মারবে। আমি তো নিজের আঙুলের ইশারায় আকাশের সূর্য-চন্দ্রকে পর্যন্ত মেরে ফেলতে পারি।’
পোলিশের কথা শুনে এম্বিয়া কিছুটা ভয় পেয়ে বলেন, ‘বন্দী, আমি তোমার শক্তির পরীক্ষা নিতে চাই।”
পোলিশ হেসে বলে, “এটা এমন কি কঠিন কাজ। আজ রাতেই আমি আমার অসীম শক্তির প্রদর্শন করব। কিন্তু তার আগে আমাদের জন্য কিছু খাবার পাঠিয়ে দাও।’
‘এখনই ভাল ভাল খাবার পাঠাচ্ছি।’ বলেই রাজা এম্বিয়া সেখান থেকে চলে যান। কিছুক্ষণ পরে রাজার রন্ধনশালা থেকে খাবার এলে পোলিশ নিজের সঙ্গীদের নিয়ে।
তা খেয়ে শুয়ে পড়ে। রাতে চন্দ্রগ্রহণ লাগার কিছুক্ষণ আগে পোলিশের ঘুম ভেঙে যায়। সে এক পাহারাদারকে দিয়ে রাজা এম্বিয়ার কাছে। খবর পাঠায় যে তিনি যেন এখনই নিজের বিশাল সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কোন মাঠে চলে আসেন।
রাজা এম্বিয়া এর অপেক্ষাতেই তো ছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে একটি মাঠে উপস্থিত হন।
পোলিশকেও সেখানে আনা হয়। গ্রহণ লাগার সময় হয়ে আসতেই পোলিশ আকাশের দিকে নিজের আঙুল তুলে দেয়। গ্রহণ লাগার ফলে ধীরে ধীরে চাঁদের আকার ছোট হতে থাকে। এটা দেখে সেখানে উপস্থিত সমস্ত সৈনিক ভয় পেয়ে যায়। রাজা এম্বিয়াও ভীষণ ভয় পেয়ে যান।
যখন চাঁদের সামান্য অংশই দেখা যাচ্ছে তখন সব সৈনিক ঘাবড়ে গিয়ে চিৎকার করতে শুরু করে, ‘বাঁচাও…. বাঁচাও। চাঁদকে বাঁচাও। নয়ত সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার, হয়ে যাবে।
পোলিশ আকাশের দিকে আঙুল তুলে রেখে নিঃশব্দে হাসতে থাকে।
রাজা এম্বিয়া আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি পোলিশের পা জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘দয়া করে চুমি পুনরায় চাঁদকে জীবিত করে দাও। আমি তোমাদের মুক্ত করে দেব।’
রাজার কথা শুনে পোলিশ হাসতে হাসতে বলে, ‘মূৰ্খ, আমাদের মুক্ত করার তুমি কে ? নিজের প্রাণ বাঁচাও আগে।’
রাজা পুরোপুরি ভয় পেয়ে মিনতি করে বলেন, ‘আপনি যা বলবেন, আমরা খুশি হয়ে তাই করব, হুজুর।
পোলিশ প্রস্তাব রাখে, ‘আজ থেকে তোমরা আমার অধীনে থাকবে। কি রাজি আছ ?’
এম্বিয়া জোড় হাত করে বলেন, হুজুর।’ “আজ্ঞে হুজুর।
পরমুহূর্তে পোলিশ নিজের আঙুল নিচে নামিয়ে নেয়। ততক্ষণে চন্দ্রগ্রহণ শেষ হয়ে চাঁদ পুনরায় দেখা যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে আবার চাঁদ আগের অবস্থায় ফিরে আসতে থাকে।
রাজা এম্বিয়া খুশি মনে নিজের সৈনিকদের সঙ্গে ফিরে যান।
এইভাবে পোলিশের বুদ্ধির জোরে অ্যাঙ্গোলার একদল সৈনিক মৃত্যুর হাত থেকে শুধু বেঁচেই যায় না, উপরন্তু একটি নতুন রাজ্যও করায়ত্ত করে।