পিনাকী রঞ্জন পাল
অনেক বছর আগের কথা। ইন্দোনেশিয়ার সেমরু রাজ্যে রাজা বছর মুদঙ্গ রাজত্ব চালাতেন। রাজা ছিলেন অত্যন্ত প্রজাদরদী। নিজের প্রজার সুখ সুবিধার ব্যাপারে সর্বদা তার নজর ছিল। রাজ্যের প্রজারাও তাদের রাজাকে ভীষণ ভালবাসত।
রাজা মুদঙ্গের প্রধানমন্ত্রী বাকা বৃদ্ধ হলেও ছিলেন ভীষণ বুদ্ধিমান। পঁচিশ বছর আগে যখন মুদঙ্গ সিংহাসনে বসেছিলেন তখন থেকেই বাকা রাজকার্য চালাতে রাজাকে সাহায্য করে আসছিলেন।
মুদঙ্গ পুরোপুরি বাকার ওপরে নির্ভরশীল ছিলেন। তাঁর পরামর্শ ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত তিনি নিতেন না। একদিন বাকা ভাবলেন এখন তিনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তাই রাজাকে পরামর্শ দেওয়ার উপযুক্ত তিনি আর নন। বাকা রাজাকে তাঁর ভাবনার কথা জানিয়ে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলেন। বাকার কথা শুনে রাজা ভীষণ দুঃখ পান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী মহোদয়, আমাদের এখনও আপনার প্রয়োজন আছে। আমি চাই প্রধানমন্ত্রীর পদে আপনিই বহাল থাকুন।
কিন্তু বাকা তো প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করবেন বলেই স্থির করেছেন। শেষে রাজাকে বাকার ত্যাগপত্র স্বীকার করতেই হল। তিনি বললেন, প্রধানমন্ত্রী মহোদয়, আমি চাই পদ ছাড়ার আগে আপনি নিজের সমকক্ষ কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল করে যাবেন।
বাকার তিনটি পুত্র ছিল, কাইমন, পোলামন আর তান্দুরন। তিনজনেই ছিল বীর আর বুদ্ধিমান। তাদের মধ্যে কোন একজনকে প্রধানমন্ত্রীর পদের জন্য নির্বাচন করাটা বাকার পক্ষে অস্বস্তিকর ছিল, কেন না তিনি তিনজনকেই সমানভাবে ভালবাসতেন। বাকা রাজার কাছে এসে জানান এই সমস্যার সমাধান কিভাবে করা যায়।
রাজার মাথায় একটি বুদ্ধি আসে। তিনি বাকাকে বলেন, আমি তিনজনেরই বুদ্ধির পরীক্ষা নেব। তাই এক এক করে তিনজনকেই আজ রাতে আপনার ঘরে ডেকে পাঠান। তারপর আমরা নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন করব।
রাত্রে বাকা সবার আগে কাইমনকে ডেকে বলেন, কাইমন, আজ রাতে তুমি রাজার বাগানে গিয়ে রাজপুকুর থেকে সোনালি মাছ চুরি করে আনবে। যদি তুমি রাজার সৈনিকদের হাতে ধরা পড় তবে মুখ কাজে লাগিয়ে যেভাবেই হোক ফিরে আসবে। আমার আশা যে তুমি নিজের পিতার আদেশের অবহেলা করবে না।
এইভাবে একে একে বাকা পোলামন আর তান্দুরনকেও একই কথা বলেন। কাইমন ভাইদের মধ্যে বড় ছিল। সে সঙ্গে সঙ্গে রাজার বাগানে লুকিয়ে প্রবেশ করে। যেই সে সোনালী মাছ ধরেছে অমনি রাজার এক সৈনিক তাকে ধরে ফেলে।
পিতার পরামর্শ স্মরণ করে সে তৎক্ষণাৎ সৈনিকের হাতে জোর কামড়ে দেয়। এইভাবে মুখের ব্যবহার করে কাইমন হাত ছাড়িয়ে ফিরে আসে।
এরপর পোলামন লুকিয়ে লুকিয়ে রাজার বাগানে ঢোকে আর সোনালি মাছ তুলে নেয়। তখন এক সৈনিক সেখানে এসে পড়ে। সৈনিককে দেখে পোলামন মাছ গিলে ফেলে যাতে কোন প্রমাণ না থাকে। এইভাবে মুখের ব্যবহার করে গোলামনও । নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে আসে।
এবার ছিল তান্দুরনের পালা। রাতের শেষ গ্রহরে সে নিঃশব্দে বাগানের গোট টপকে ভেতরে যায়। আর পুকুরের কাছে গিয়ে যেই না সোনালী মাছকে নিজের জালে আটকেছে তখনই রাজার সৈনিক এসে তাকে ধরে ফেলে।
সঙ্গে সঙ্গে তান্দুরনকে রাজার সামনে উপস্থিত করা হয়, কিন্তু সে একদম শান্ত ছিল।
তুমি কি রাজবাগানে চুরি করার চেষ্টা করেছিলে? রাজা জিজ্ঞেস করেন।
আজ্ঞে মহারাজ, তান্দুরন নিজের অপরাধ নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করে বলে, ‘মহারাজ, আমি এই অপরাধের জন্য বিন্দুমাত্র লজ্জিত নই, কেন না আমি এ কাজ করেছি আমার পিতা, যিনি এখানকার প্রধানমন্ত্রীও, তার আদেশে।
আমার পিতা কিছু ভেবেই আমাকে এমনটা করার আদেশ দিয়েছিলেন নিশ্চয়ই। তাদ্দুরনের জবাব শুনে রাজা ভীষণ প্রসন্ন হন। তিনি প্রধানমন্ত্রী বাকাকে বলেন, আমি তান্দুরনকেই প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করছি, কেননা সে নিজের মুখের ব্যবহার সত্য বলার জন্য করেছে। যেখানে অন্যেরা। নিজেদের বাঁচাবার জন্য মুখের ব্যবহার করেছে।
এ কথা শুনে বাকা তান্দুরনকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং আশীর্বাদ করেন।