অরুণ কুমার : শিশু জাতি গঠনের মূল ভিত্তি। শিশুদের পর্যাপ্ত জীবনযাত্রার অধিকার, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও সেবা, খেলাধুলা ও বিনোদনের অধিকার রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে একটি সুষম খাদ্য, ঘুমানোর জন্য একটি উষ্ণ বিছানা এবং স্কুলে পড়াশোনার প্রবেশাধিকার। শিশুদের অপব্যবহার, অবহেলা, শোষণ এবং বৈষম্য থেকে সুরক্ষার অধিকার রয়েছে।

সারা বিশ্বের ১৮০ টি দেশের মধ্যে শিশুর অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সবথেকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে আমাদের দেশ ভারত।
অল ইন্ডিয়া লিগ্যাল এইড ফোরামের সাধারণ সম্পাদক তথা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জয়দীপ মুখোপাধ্যায় এই কথাগুলি শনিবার জলপাইগুড়িতে একটি শিশু সুরক্ষা বিষয়ক আলোচনা সভায় উল্লেখ করেছেন।
এদিন তিনি প্রধান বক্তা হিসেবে শিশু অধিকার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য আইনগত তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, আমাদের দেশ শিশুদের অধিকার রক্ষায় দায়বদ্ধ। প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলোতে যদি তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে সেই দেশের শিশুদের তুলনায় আমাদের দেশের শিশুরা যথেষ্ট সুরক্ষিত। কিন্তু তবুও শিশুদের প্রতি নির্যাতন যৌন নির্যাতন সেইসঙ্গে শিশু পাচার এর মত ঘটনা ঘটে চলেছে। এ বিষয়ে আমাদের সকল পক্ষকে সচেতন হতে হবে সতর্ক থাকতে হবে।

আইনজীবী জয়দীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, আমাদের উন্নয়নমুখী দেশ ভারতের জনসংখ্যা এতটাই বিপুল যার ফলে আর্থ সামাজিক কারণে শিশুদেরও সমস্যার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হচ্ছে। এটা কেবল সচেতনতার মধ্য দিয়েই মোকাবেলা করা সম্ভব। ‘কমিটেড টু চিলড্রেন’ বিষয়ক এক সেমিনারে এই তথ্য তুলে ধরেন তিনি।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমাদের ভারতীয় সংবিধান বিভিন্নভাবে শিশু সুরক্ষাকে সুনিশ্চিত করেছে। নারী এবং শিশুদের জন্য কিছু বিশেষ সুযোগ-সুবিধা তৈরী করা (১৫ (৩) নং ধারা) জীবন এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার (২১ নং ধারা) ৬-১৪ বছরের শিশুদের জন্য অবৈতনিক এবং আবশ্যিক শিক্ষার অধিকার (২১ক ধারা) পাচার হওয়া থেকে এবং বলপূর্বক শিশু শ্রম থেকে সুরক্ষার অধিকার (২৩নং ধারা) হারানো মাধ্যমে শিশুর অধিকার এদেশের সুরক্ষিত করা হয়েছে ।
উপস্থিত শ্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এদিন মুখোপাধ্যায়ের জানিয়েছেন, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে শিশুদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাসহ মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, সুযোগের সমতা, অধিকার ও কর্তব্য এবং জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এদিন তিনি সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের প্রায় ৩০ টির বেশী রায় দিয়েছে যার দ্বারা আমাদের দেশের শিশুদের অধিকার সুরক্ষিত হয়েছে বলে তিনি এক প্রশ্নের উত্তরে জানান। তিনি আরো বলেন বিদ্যালয় থেকে শিশুদের পড়ার হার হ্রাস করার লক্ষ্যে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, শিশু অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দারিদ্র্য প্রধান অন্তরায়। বৃহৎ অংশের শিশুদের দারিদ্র্য বিমোচন, পুষ্টি, স্বাস্থ্য সেবা, নিরাপদ আশ্রয়, পয়ঃনিষ্কাশন ইত্যাদি সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে সরকার বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসন, পর্যায়ক্রমে শিশু শ্রম নিরসন, শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহার বন্ধ করা ও তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে শিক্ষা ও বিনোদনের উপযুক্ত সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে বিভিন্ন কার্যক্রম। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার যৌথভাবে এই শিশু অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জয়দীপ মুখার্জি আরো বলেন, ১৯৯০ সালে রাষ্ট্রসংঘ শিশু অধিকার সনদ (Convention on the Rights of the Child, CRC) ১৯৮৯ এ স্বাক্ষর ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ভারত অন্যতম। এই অবস্থার পরিপেক্ষিতে আমাদের দেশে, শিশুদের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শিশুর অধিকার সুরক্ষার জন্য জাতীয় কমিশন (এনসিপিসিআর) জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট ২০১৫ -এর ১০৯ -এর ধারার আওতায় একটি নজরদারি কর্তৃপক্ষ হিসেবে এবং কোভিড ১৯ আক্রান্ত শিশুদের সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান সমস্যার কথা বিবেচনা করে শিশুদের যত্ন ও সুরক্ষার প্রয়োজনে একটি অনলাইন ট্র্যাকিং পোর্টাল – ‘বাল স্বরাজ (কোভিড কেয়ার লিঙ্ক)’ চালু করেছে । শিশুদের যত্ন ও সুরক্ষার প্রয়োজনে, তাদের অনলাইন ট্র্যাকিং এবং ডিজিটাল রিয়েল টাইম মনিটারিং ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে কমিশন এই পোর্টাল তৈরি করেছে । কোভিড ১৯ আক্রান্ত হয়ে যেসব শিশু তাদের বাবা বা মা অথবা উভয়কেই হারিয়েছে সেইসব শিশুদের খোঁজখবর রাখার জন্য কমিশন এই পোর্টালের ‘কোভিড কেয়ার’- লিঙ্কে তথ্য আপলোড করতে সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে । এছাড়াও যে সকল শিশু পরিবার হারিয়েছে বা কোন অভাব অনটনের মধ্যে রয়েছে তাদের জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট ২০১৫-এর ধারা ২(১৪)এর আওতায় যত্ন ও সুরক্ষার প্রয়োজন । এই আইনের আওতায় প্রদত্ত সমস্ত সুবিধা অনুসরণ করে এধরণের শিশুদের কল্যাণ সুনিশ্চিত করতে হবে ।
এদিনের বক্তাদের মধ্যে ছিলেন, প্রাবন্ধিক উমেশ শর্মা, সাংবাদিক অরুন কুমার, সাহিত্যকার গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রমিক নেতা স্বপন সরকার, মালকানি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান প্রশান্ত সরকার, কোচবিহার সুনীতি একাডেমির প্রধান শিক্ষিকা মনিদীপা নন্দী বিশ্বাস স্থানীয় আইন মহাবিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীরা তাদের বক্তব্য রাখেন। এদিনের অনুষ্ঠানে অন্যতম অতিথি স্থানীয় বিধায়ক ডা: প্রদীপ কুমার বর্মা ব্যস্ত থাকায় তিনি আসতে পারেন নি। বক্তারা সকলেই শিশু অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারে পাশাপাশি তার রূপায়নের ক্ষেত্রে সমস্ত শ্রেনীর মানুষের অবদান অবদান রাখা জরুরি বলে গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
একটি সমাজসেবামূলক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান শিশু চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম আয়োজিত এই “কমিটেড ফর চিল্ড্রেন” শিশুদের প্রতি দায়বদ্ধ আইনি সচেতনতা বিষয়ক সেমিনারে বক্তারা এদিন শিশুদের অধিকারের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
উক্ত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা শনিবার দিন জলপাইগুড়ি শহরের বাসভবনের নির্মল বসু মঞ্চে এই সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন।