রাষ্ট্রীয় উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ও জলপাইগুড়ি

লেখক পঙ্কজ সেন

জলপাইগুড়ির নারী শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে যে সকল বিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো রাষ্ট্রীয় উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি জলপাইগুড়ি জেলায় মেয়েদের প্রথম ও একমাত্র সরকারি বালিকা বিদ্যালয় হিসেবেও পরিচিত। ১৯৪৮ সালে শহরের কেন্দ্রস্থল ডিবিসি রোডে অবস্থিত নূর মঞ্জিল ভবনে (কমার্স কলেজের উল্টো দিকে) সর্বপ্রথম বিদ্যালয়টির পথচলা শুরু হয়। বিদ্যালয়ের প্রথম প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন গ্ল্যাডিশ মজুমদার। তিনি ১৯৪৮ সালের ২৮ জুলাই থেকে ২২ শে নভেম্বর, ১৯৪৮ পর্যন্ত মাত্র চার মাস প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। অবশ্য এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য প্রধান শিক্ষিকারা ছিলেন – জ্যোৎস্না সরকার (ময়না দি), সুপ্রভা দাসগুপ্ত (মিনি দি), আরতি গুহ ,শান্তি দি, বাণী মৌলিক, কৃষ্ণা মজুমদার প্রমূখ।

দেশভাগের আগে চট্টগ্রামে “খাস্তগীর পাঠশালা” নামক একটি পাঠশালা ছিল। এই পাঠশালার ১০ জন শিক্ষিকা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে জলপাইগুড়িতে এসে এই বিদ্যালয়ে যোগ দেন। প্রথম থেকেই বিদ্যালয়টি তৃতীয় শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ছিল। ১৯৫৮ সালে বিদ্যালয়টি তার পূর্ব জায়গা ত্যাগ করে বর্তমান স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্বোধন করেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা বাংলার রূপকার ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়। অনেক মেধাবী ছাত্রী এই বিদ্যালয় থেকে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে আজ ভারত সহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে অন্যতম কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-এর একসময়ের উপাচার্য ভারতী রায়। ১৯৫৪ সালে গীতা ঘোষ পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের মধ্যে রাজ্যে প্রথম হন। বিদ্যালয় এর কৃতি ছাত্রী সংঘমিত্রা নিয়োগী ২০১৫ সালের ১৭ ই আগস্ট কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। পূর্বে তিনি জার্মানির “পলিমার সাইন্স ইনস্টিটিউট” এ কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৫ সালে বিদ্যালয়ের ছাত্রী সুদেষ্ণা চৌধুরী উচ্চমাধ্যমিকে জেলায় প্রথম হয়। ২০০৪ সালে সুরঙ্গমা চক্রবর্তী মাধ্যমিকে পশ্চিমবঙ্গে তৃতীয় এবং মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়।

২০২২ সালের ২৮শে জুলাই বিদ্যালয়ের ৭৫ বছর পূর্তি (প্লাটিনাম জুবিলী বর্ষ) খুবই আড়ম্বরের সহিত পালিত হয়। এই দিন সকাল ৯ ঘটিকায় ট্যাবলো সহ এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা শহরে বার হয়েছিল। লাল-সাদা স্কুল বাড়িটার সাথে সাদা জামা, লাল বেল্ট আর লাল পাড় সাদা শাড়ির এক আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। রাষ্ট্রীয় উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে যে নিজস্ব বার্ষিক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় তার নাম হলো “বাণীদীপ”। বিদ্যালয়ের ফুলের বাগানকে অতি সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলার ক্ষেত্রে মালি ভাই সিকিল দার ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। বিদ্যালয়ের হোস্টেল প্রথমে অবস্থিত ছিল নূরমঞ্জিল ভবনে। তৎকালীন হোস্টেল সুপার গৌরীদির তত্ত্বাবধানে ছাত্রীরা সারিবদ্ধ হয়ে সুশৃংখলভাবে বিদ্যালয়ে আসতো। পরবর্তীতে অবশ্য বিদ্যালয়ের হোস্টেল সেখান থেকে সরিয়ে বিদ্যালয়ের নিজস্ব ভবনেই নিয়ে আসা হয়। নূরমঞ্জিলে থাকাকালীন সময়ে হোস্টেলের মেয়েদের জন্য আলাদা টিফিন আসতো।

২০১৮ সালের ২৮ শে অক্টোবর সর্বপ্রথম “পুনর্মিলন উৎসবে” শামিল হয় এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তনীরা। ‘ ফিরে চলো মাটির টানে ‘ শিরোনামকে সামনে রেখে এই পুনর্মিলন উৎসবে শামিল হলেন বিদ্যালয়ের ছাত্রী ও শিক্ষিকারা। বিদ্যালয়ের নিজস্ব প্রাঙ্গনেই এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শহরে মেয়েদের এই সরকারি বিদ্যালয় আমাদের কাছে অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের। আমার পিতা স্বর্গীয় উমাপদ সেন এই বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী ছিলেন। ১৯৭৫ সালে ১২ই জুলাই তিনি পদোন্নতির মাধ্যমে জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলে করণিক হিসেবে নিযুক্ত হন। আমার দুই কাকু স্বর্গীয় নারায়ণ চন্দ্র সেন এবং স্বর্গীয় নিকুঞ্জ মোহন সেন এই বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী ছিলেন। তারা কেমিস্ট্রি এবং বায়োলজি ল্যাবরেটরীর কাজে নিযুক্ত ছিলেন।

(রাষ্ট্রীয় উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় সংক্রান্ত এই বিবরণীতে কোন ভুল বা ত্রুটি থাকলে তা একেবারেই অনিচ্ছাকৃত। বিদ্যালয় সম্পর্কে আপনাদের যে কোন মতামত কমেন্ট বক্সে উল্লেখ করলে খুবই বাধিত হবো।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *