রথযাত্রা দেশে বিদেশে

আষাঢ় মাসের সেরা উৎসব রথযাত্রা। পুরীর জগন্নাথদেবের রথ দেখতে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ ছুটে আসেন। শুধু এদেশেই নয় রথযাত্রা ঘিরে অন্যান্য দেশেও বছরের বিভিন্ন সময়ে উৎসবের আয়োজন হয়। লিখেছেন পিনাকী রঞ্জন পাল।

প্রাচীনকালে ভারতে সৌর, শাক্ত, বৈষ্ণব, জৈন, বুদ্ধ, হিন্দু প্রায় সব ধর্মের মানুষই রথের উৎসবে সামিল হতেন। ওড়িশায় আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ায় রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। জাতি, ধর্ম, সাম্প্রদায়িক হানাহানি ভুলে মানুষ এই মিলন মেলায় যোগ দিয়ে রথ টানেন ও রথ দেখেন। এমন সব ধর্মের মিলিত প্রয়াস আর কোনো উৎসবে দেখা যায় না।

ভারতেই শুধু নয়, ইউরোপের সিসিলি দ্বীপে ভাদ্র মাসে অনুষ্ঠিত হয় যীশুর মূর্তি নিয়ে রথযাত্রা উৎসব। ব্যাঙ্ককে বুদ্ধের রথযাত্রা উৎসব আজও জনপ্রিয়। এছাড়া লন্ডন, টোকিও, ওয়াশিংটন, সানফ্রানসিসকো, প্যারিস প্রভৃতি স্থানে রথযাত্রা উৎসব প্রায় জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।

‘ভবিষ্যপুরাণে’ লেখা আছে ভাদ্র মাসে সূর্যদেবের রথযাত্রার কথা। এই সূর্যদেবকে স্মরণ করেই ওড়িশার কোনার্কে গড়ে তোলা হয়েছিল সূর্যমন্দির। ‘বরাহপুরাণে’ কার্তিক মাসে কৃষ্ণ-রাধার রথে চড়ার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। স্কন্দ পুরাণে’ আছে বৈশাখ মাসে বিষ্ণুর রথযাত্রার কাহিনি। “শিবপুরাণে দেবী দূর্গার আশ্বিন মাসে রথযাত্রার বিবরণ পাওয়া যায়। ‘মৎস্যপুরাণে’ চৈত্র মাসে শিবের রথযাত্রার উল্লেখ আছে।

প্রায় সব ধর্মেই রথযাত্রার প্রচলন থাকলেও অনেকের মতে হিন্দু ধর্মেই সর্বপ্রথম এর সূচনা হয়েছিল। তবে কালক্রমে হিন্দুদের থেকে বৌদ্ধ ধর্মে রথের প্রস্তাব ছড়িয়ে পড়েছিল তা বলা যায়। খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে চীনা পরিব্রাজক ফা হিয়েন ভারত ভ্রমণে এসে বৈশাখী পূর্ণিমায় বুদ্ধের রথযাত্রা দেখেছিলেন। পরবর্তীকালে জৈনধর্মেও মহাবীর পার্শ্বনাথের রথযাত্রা দেখা গেছে।

Rath Yatra at home and abroad

প্রাচীন গল্পগাথায় রথ নিয়ে প্রচুর কাহিনি আছে। মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের রথের সারথি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। জাতকের গল্পে বুদ্ধের জন্মের ‘বহু বছর আগে প্রহ্লাদ প্রথমে সত্যযুগে মহাবিষ্ণুর রথ টেনেছিলেন। রামায়ণে রাজা দশরথকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বাঁচিয়ে এনেছিলেন তার রথের সারথি রানি কৈকেয়ী।

এমনই শত শত কাহিনি আছে রথকে নিয়ে। রথ চলমান বস্তু। রথকে মানবসমাজে গতির প্রতীক ধরা হয়। এদেশের মানুষ আজও রথকে এক ঐতিহ্যপূর্ণ গৌরবময় যান বলেই মনে করেন। দেশ স্বাধীনতা পাওয়ার পরে বেশ কয়েক বছর ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্র দিবসে আর স্বাধীনতার দিনে রথে চড়ে দিল্লির রাজপথ পরিক্রমা করতেন। পরে নিরাপত্তার কথা ভেবে এই অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আবার আসা যাক জগন্নাথদেবের রথযাত্রা প্রসঙ্গে। আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ায় প্রধান উৎসবটি হলেও এই কাঙ্খিত ক্ষণটিকে সুন্দর করে তোলার প্রস্তুতি বহুদিন আগে থেকেই নেওয়া হয়। রথের জন্য কাঠ সংগ্রহের কাজ শুরু হয় বসন্ত পঞ্চমী অর্থাৎ সরস্বতী পুজোর দিন থেকে। বহু আগে ভেলায় চাপিয়ে নদী পথে কাঠ আসতো দশপাল্লা ও রণপুরের জঙ্গল থেকে। পরে এই কাঠের জোগান দিতেন দশপাল্লার রাজা। বর্তমানে এই রথের কাঠ সরবরাহ করেন ওড়িশা সরকার।

রথ নির্মাণের কাজ শুরু হয় অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকে। বিশালাকায় তিনটি রথ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্মাণ করা তো চাট্টিখানি কথা নয়। তিনটি রথের আবার পৃথক পৃথক নাম আছে। যেমন-বলরামের রথের নাম ‘তালধ্বজ’, সুভদ্রার রথের নাম ‘দর্পদলন’ বা ‘দেবীদলন’ এবং জগন্নাথদেবের রথের নাম ‘নন্দিঘোষ’।

যেমন তেমন ভাবে এই রথগুলি কিন্তু তৈরি করা যায় না। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই রথগুলি তৈরি করতে হয়। তালধ্বজের উচ্চতা হবে বত্রিশ হাত দশ আঙুল, এই রথটি চোদ্দটি চাকার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে এবং সম্পূর্ণ রথটি তৈরি হয় ৭৬৩টি কাঠের খন্ড, দিয়ে। দর্পদলন বা দেবীদলনের উচ্চতা একত্রিশ হাত, এর চাকার সংখ্যা বারো এবং রথটি ৫১৬টি কাঠের খন্ড দিয়ে তৈরি হয়। নন্দিঘোষের উচ্চতা হবে তেত্রিশ হাত পনেরো আঙুল, ১৬ চাকার এই রথ তৈরি করতে লাগে ৮৩২ টুকরো কাঠ। নন্দিঘোষ রথের চূড়ায় চক্র আর শ্রীগরুড় অবস্থান করেন বলেই এই রথকে চক্রধ্বজ বা গরুড়ধ্বজ রথ বলে। জগন্নাথদেবের রথের রঙ পীতবর্ণ, সুভদ্রার রথ কৃষ্ণবর্ণ এবং বলরামের রথ নীলবর্ণের হয়ে থাকে। জগন্নাথদেবের সারথি হলেন মাতলি, বলরামের রথের সারথি হলেন সুদ্যুম্ন এবং সুভদ্রার রথের সারথি হলেন অর্জুন।

রথ নির্মাণের মধ্যেই জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমাতে অনুষ্ঠিত হয় স্নানযাত্রা। ঐদিন শ্রীক্ষেত্র বা পুরীর মন্দিরের পাশের স্নানমন্ডপে সোনাকুয়োর একশো আট কলসি জলে জগন্নাথদেব, বলরাম এবং সুভদ্রাকে স্নান করানো হয়। এইজন্য জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমাকে স্নানপূর্ণিমা বা দেবপূর্ণিমাও বলা হয়। বর্ষার কাঁচা জলে স্নান করে তিন দেবতাই। জ্বরে আক্রান্ত হন। ঐদিন থেকে পরবর্তী পনেরো দিন ভক্তরা আর দেবতাদের দর্শন পান না। এই সময়টাকে বলা হয় অনবসর। জ্বর হলে চিকিৎসা তো করাতেই হবে। এই সময় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা জগমোহনের পাশে খটশেষ নামক গৃহে বিশ্রাম করেন। তখন তাদের চিকিৎসা করেন বৈদ্য। সেই চিকিৎসকের তৈরি পাঁচন খেয়েই অবশেষে দেবতারা সুস্থ হন। সুস্থ হওয়ার পর ভক্তরা দেবতাদের দর্শন পান আবার আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ার দিন।

ঐদিন তিন দেবতা মাসীর বাড়ি গুন্ডিচা মন্দির রওনা দেন। রথযাত্রার প্রধান উৎসব সেদিনই অনুষ্ঠিত হয়। পুরীর মন্দিরের পূর্বদিকে অবস্থিত অরুণস্তম্ভ থেকে গুন্ডিচা মন্দির পর্যন্ত বিস্তৃত রাজপথটিকে বড়দান্ড বলে। এই রাস্তা দিয়েই রথ টানা হয়।

সুসজ্জিত তিনটি রথের প্রথমটি হল সুভদ্রা দেবীর ‘দেবীদলন’, এই রথে আরোহণ করাটাও হয় নিয়ম মেনে। দেবীদলনে প্রথম আরোহণ করেন শ্রীসুদর্শন। এরপর তালধ্বজ রথে আরোহণ করেন বলরাম বা বলভদ্র। তারপর সুভদ্রা এবং সবশেষে শ্রীজগনাথদেব। তিন দেবতা সেবকদের বা দইতাদের কাঁধে চেপে রথে আরোহণ করেন। এরপরই প্রাচীন রীতি অনুসারে গজপতি মহারাজ সোনার ঝাঁটা দিয়ে পথ পরিষ্কার করেন। ওড়িয়াতে এই পথ পরিষ্কারকে বলে ‘ছেরা পঙ্গুরা’। পথ পরিষ্কারের পরেই শুরু হয় পূজার্চনা। পূজা শেষ হবার পরে অসংখ্য মানুষের হরিধ্বনি, সংকীর্তনের মধ্য দিয়ে রথ টানা শুরু হয়। উপস্থিত ভক্তরা ঝাঁপিয়ে পড়েন রথের রশি ছোঁয়ার জন্য।

অপূর্ব সেই শোভাযাত্রার একদম সামনে ভক্তরা সংকীর্তন করেন। রথ বলগন্ডিতে (একটি জায়গার নাম) পৌঁছাবার পর রথ দাঁড় করিয়ে দেবতাদের ফল ও মিষ্টান্ন নিবেদন করা হয়। তারপর আবার যাত্রা শুরু। বিকেলের মধ্যেই সাধারণত তিনটি রথ গুন্ডিচা মন্দিরের কাছে চলে আসে। কিন্তু দেবতারা রথে রাত্রি যাপন করে পরদিন ভোরে গুন্ডিচার মহাবেদীতে অধিষ্ঠিত হন।

গুন্ডিচা মন্দিরে মোট নয় দিন থাকেন তিন দেবতা। এই কয় দিন মন্দিরে নানা উৎসব চলে। নয় দিন পর আষাঢ় মাসের শুক্লা একাদশীর দিন ফিরে যাওয়ার পালা। জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা রথের ওপরেই সোনার সাজ পরেন। রথেই ভোগ পর্ব সাঙ্গ হয়। দ্বাদশীর দিন মহাপ্ৰভুৱা মন্দিরে প্রবেশ করে রত্ন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। এই দ্বাদশীকে ‘গরুর শয়ন দ্বাদশী ও বলে। শেষ হয় এক বিশাল উৎসবের।

ওড়িশায় একবার উল্টোরথের দিন ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ জগন্নাথদেবের রথের রশি টেনেছিলেন। চৈতন্য মহাপ্রভূত বহুবার রথ টেনেছেন। তিনি জগন্নাথদেবের আকর্ষণে শেষ জীবনে ১৮ বছর পুরীতে কাটান। আজও বহু মানুষ রথের রশি টানার বাসনা নিয়ে পুরীতে রথযাত্রার দিনে হাজির থাকেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *