পিনাকী রঞ্জন পাল : ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় শেষ হল রবিচন্দ্রন অশ্বিনের অবসরের মাধ্যমে। বিশ্ব ক্রিকেটে অফ-স্পিনের মানচিত্রে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়েছেন তিনি। এক বিস্ময়কর কেরিয়ার শেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে এক বর্ণাঢ্য অধ্যায়কে বিদায় জানালেন অশ্বিন। ব্রিসবেনের গাব্বা স্টেডিয়ামে বর্ডার-গাভাসকার ট্রফির তৃতীয় টেস্ট ড্র হওয়ার পর, সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত হয়ে এই ঘোষণা করেন তিনি।
১৩ বছরের কেরিয়ার : একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি
১৩ বছরের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে অশ্বিন সংগ্রহ করেছেন ৭৬৫টি আন্তর্জাতিক উইকেট। টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর অবদান অনন্য। ১০৫টি টেস্ট ম্যাচে তিনি শিকার করেছেন ৫৩৭টি উইকেট, যার মধ্যে ৩৭ বার পাঁচ বা তার বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড রয়েছে। ব্যাট হাতেও তিনি কম যাননি; করেছেন ৩৪৭৪ রান, যার মধ্যে রয়েছে ৬টি শতরান ও ১৪টি অর্ধশতরান।
বিশেষত, চলতি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে একমাত্র বোলার হিসেবে ১০০-এর বেশি উইকেট নিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, স্পিন বোলিংয়ে তাঁর দক্ষতার শীর্ষে ছিলেন তিনি। তবুও, সাম্প্রতিক ফর্মের কারণে এবং বিদেশের মাটিতে সীমিত সুযোগ পাওয়ার কারণে, অবসরের সিদ্ধান্ত তাঁর কাছে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল।
অবসরের ঘোষণা : একটি আবেগঘন মুহূর্ত
ব্রিসবেনে, ম্যাচ শেষে সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত হন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। অধিনায়ক রোহিত শর্মাকে পাশে নিয়ে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এটাই আমার শেষ দিন। তবে ক্রিকেট আমার মধ্যে এখনও বেঁচে আছে। ক্লাব স্তরে খেলা চালিয়ে যাব, কিন্তু দেশের হয়ে আর নয়।”
এই ঘোষণার মুহূর্তে অশ্বিনের কণ্ঠে আবেগ স্পষ্ট ছিল। তিনি তাঁর সহখেলোয়াড় বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, অজিঙ্ক রাহানে এবং চেতেশ্বর পুজারার নাম করে তাঁদের সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। তাঁর কথায়, “আমার বলে ক্যাচ ধরে নেওয়ার জন্য ওদের কাছে আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ। আমার কেরিয়ারটা ওদের কারণেই এতটা সফল হয়েছে।”
রোহিতের প্রতিক্রিয়া : দলনেতার সম্মান
অধিনায়ক রোহিত শর্মা অশ্বিনের অবসরের ঘোষণাকে সম্মান জানিয়েছেন। তবে, তিনি জানিয়েছেন যে তিনি অশ্বিনকে আরও কিছুদিন দলে ধরে রাখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। রোহিত বলেন, “আমি পারথে গিয়ে ওর সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারি। আমি অন্তত পিঙ্ক বল টেস্ট পর্যন্ত থাকতে বলেছিলাম। কিন্তু ওর মনে হয়েছিল, ওর সময় শেষ হয়েছে।”
অশ্বিনের অবসর প্রসঙ্গে রোহিত আরও বলেন, “অশ্বিনের সিদ্ধান্তকে আমরা সকলেই সম্মান জানাই। ও ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য যা করেছে, তা কোনওদিন ভোলার নয়।”
কেরিয়ার এবং উত্তরাধিকার
২০১১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টেস্ট অভিষেক করেছিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। সেই ম্যাচেই ৯ উইকেট নিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, ভারতীয় স্পিন আক্রমণে নতুন যুগের সূচনা করতে চলেছেন। এরপর এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ছিলেন ভারতীয় টেস্ট দলের অন্যতম স্তম্ভ।
অশ্বিনের সাফল্যের গল্প শুধুমাত্র পরিসংখ্যানে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর কৌশল, উইকেট নেওয়ার দক্ষতা এবং ম্যাচের মোড় ঘোরানোর ক্ষমতা তাঁকে সর্বকালের সেরাদের মধ্যে স্থান দিয়েছে। স্পিন বোলিংয়ের প্রতিটি দিক নিয়ে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাঁকে প্রতিনিয়ত নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
বিশেষত ঘরের মাঠে অশ্বিন ছিলেন এক অতুলনীয় শক্তি। ভারতীয় পিচের স্পিন-সহায়ক পরিবেশে তাঁর অফ-স্পিন বলিং ছিল প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু বিদেশের মাটিতেও, বিশেষত ২০২১ সালের ঐতিহাসিক গাব্বা টেস্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে, তিনি তাঁর দক্ষতার ছাপ রেখেছেন।
সাম্প্রতিক ফর্ম এবং অবসরের কারণ
সাম্প্রতিক সময়ে অশ্বিনের ফর্ম অবশ্য আশানুরূপ ছিল না। নিউজিল্যান্ড সিরিজে এবং অ্যাডিলেডে পিঙ্ক বল টেস্টে তাঁর পারফরম্যান্স প্রশ্নের মুখে পড়েছিল। অস্ট্রেলিয়া সফরে একমাত্র টেস্টে মাত্র একটি উইকেট নেওয়া অশ্বিনের জন্য হতাশাজনক ছিল। এ ছাড়া, টেস্ট দল নির্বাচনে বিদেশের মাটিতে তাঁর জায়গা হারানোর প্রবণতা হয়তো তাঁকে অবসরের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।
ভারতের স্পিন আক্রমণে শূন্যতা
অশ্বিনের অবসর ভারতীয় স্পিন আক্রমণে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করবে। বিশেষত, ঘরের মাঠে স্পিন-বান্ধব পিচে অশ্বিন ছিলেন ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অস্ত্র। তাঁর অভিজ্ঞতা এবং উইকেট নেওয়ার দক্ষতা নতুন প্রজন্মের বোলারদের জন্য এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
অশ্বিন জানিয়েছেন যে তিনি ক্লাব ক্রিকেটে খেলা চালিয়ে যাবেন। তাঁর অভিজ্ঞতা এবং কৌশল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্রিকেটারদের কাছে প্রেরণা হয়ে থাকবে। অশ্বিনের বিদায় ভারতীয় ক্রিকেটে এক যুগের অবসান ঘটালেও, তাঁর উত্তরাধিকার চিরকাল বেঁচে থাকবে তরুণ স্পিনারদের মধ্যে।
অশ্বিনকে কুর্নিশ
ভারতীয় ক্রিকেটে রবিচন্দ্রন অশ্বিন শুধু একজন বোলার নন, তিনি এক প্রতিষ্ঠান। তাঁর অবসরে ভারতীয় ক্রিকেট এক মহান যোদ্ধাকে হারাল। তবে তাঁর কীর্তি এবং অবদান চিরকাল ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে অমর হয়ে থাকবে। অশ্বিনকে কুর্নিশ, শুভ কামনা ভবিষ্যতের জন্য।