লেখক পঙ্কজ সেন
১৭ই মে ১৯৩৩ সাল। সুদূর আন্দামানের সেলুলার জেলে পায়রার কক্ষের সমান আয়তনের জেলখানায় অনশনরত বন্দী মোহিত মোহন মৈত্র চোখ বন্ধ করে শুয়ে। সারা শরীর জুড়ে তার নিদারুণ অত্যাচারের চিহ্ন স্পষ্ট, ঘা থেকে ক্ষত হয়ে গিয়েছে। কতদিন যে স্নান করতে পারেননি।
অবিভক্ত বাংলার পাবনা জেলার (বেড়া থানার অন্তর্গত ভারেঙ্গা গ্রাম, তার জন্মতারিখ জানা যায় না) ২৫ বছর বয়সী এই দামাল ছেলে জেলের অন্ধকার কক্ষে শুয়ে মাঝে মাঝে আপন মনে বিড়বিড় করে কোন গান ধরেন। চোখে -মুখে তার শুধু একটাই স্বপ্ন স্বাধীন ভারত দেখে যাওয়া।

তিন সপ্তাহ ধরে জেলে ইংরেজ পুলিশের অকথ্য মারধর, নির্যাতন সত্ত্বেও একদানা খাবার মুখে তোলেননি পাঞ্জাবি দেশপ্রেমিক যুবক মহাবীর সিংহ, নমন দাস এবং মোহিত মোহন মৈত্র। তবুও তারা কোনো রকম আপোষ করেননি দেশের শত্রু ইংরেজদের সঙ্গে। কারণ তাদের সকলের মনে-প্রাণে যে একটাই দাবি ও স্বপ্ন আজাদী। সেলুলার জেলে তাদের প্রতি কিরকম অত্যাচার করা হতো, তার একটা নমুনা দেওয়া হলো : বিপ্লবীদের রাতের পর রাত না খাইয়ে ফেলে রাখা হতো, বরফের উপর শুইয়ে চলতো পাশবিক অত্যাচার, কড়া রোদে ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে অজ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত চলতো চাবুক মারা, ১৮ ঘণ্টা একটানা ঘানি টানতে বাধ্য করা, নারকেল পিষে রোজ ২৫ কেজি তেল বানানো ইত্যাদি আরও কত কি! করতে না চাইলে বা কথার অবাধ্য হলে দেওয়ালের হুক থেকে ঝুলিয়ে ডান্ডা দিয়ে অমানুষিক ভাবে পেটানো হতো। কিন্তু কি অপরাধ ছিল তাদের! তাদের সব থেকে বড় অপরাধ, তারা ছিল প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাইতো ইংরেজ সরকার জেলে থাকাকালীন সময়ে নিদারুণ অত্যাচার চালিয়ে তাদের মনোবল ভাঙার সব রকম প্রচেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ইংরেজরা ভেবেছিলো তাদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে বাংলা ও পাঞ্জাবের এই দামাল ছেলেরা জেলারের কাছে মুচলেকা দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেবে। কিন্তু দেশপ্রেমিক ভারত মায়ের এই মহান সন্তানেরা এই দুটির কোনটাই করেনি।
বিপ্লবী যুগান্তর দলের সক্রিয় কর্মী মোহিত মৈত্র কলিকাতার খিদিরপুর ডকে আগ্নেয়াস্ত্র ও তাজা কার্তুজসহ ১৯৩২ সালে ইংরেজ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। বিচারে তার আলিপুর জেলে কয়েক মাস থাকার পর, পরবর্তীতে তাকে আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। জেলে থাকাকালীন সময়ে তিনি অন্যান্য বিপ্লবীদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ইংরেজদের ভারত ছাড়ার দাবিতে তথা পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার দাবিতে ১৯৩৩ সালের ১৭ই মে থেকে আমরণ অনশনে নামেন। অত্যাচারী জেল কর্তৃপক্ষ মোহিত মৈত্রের সেলে প্রবেশ করে তাকে জোর করে খাওয়ানোর অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। শেষে জনা কয়েক ইংরেজ সৈন্য তার নাকে পুরু নল ঢুকিয়ে জবরদস্তি দুধ খাওয়ানোর প্রচেষ্টা চালায়। মোহিত মৈত্র প্রতিরোধের অনেক চেষ্টা করলেও তাদের বর্বরতা এতটাই চরমে ওঠে যে, এই শীর্ণ ক্লান্ত শরীরে আর তা পেরে ওঠে না। ফলস্বরূপ দুধ,খাদ্যনালীতে না ঢুকে শ্বাসনালীতে ঢুকে যায়। অবস্থার অবনতি হলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দশ দিন যমে-মানুষে টানাটানি চলে। অবশ্য এটা চলার আরেকটা কারণ হলো, মোহিত মৈত্রের ওষুধ বা খাবার না খাওয়ার জেদ। সাহেব ডাক্তার তাকে ওষুধ খাওয়ানোর জন্য অনেক অনুরোধ করলেও তিনি শুধু মুচকি হেসে বলেছিলেন,”I am still on hunger strike. My comrades are not eating”. ১৯৩৩ সালের ২৮শে মে আন্দামানেই বীরের মৃত্যুবরণ করেন বিখ্যাত বিপ্লবী মোহিত মোহন মৈত্র।
এত কিছুর পরেও মোহিত বাবুর পরিবারের কাছে তার মৃতদেহ পাঠানো হয়নি। এমনকি মৃত্যুর পর শ্মশানে অর্ধদগ্ধ অবস্থায় মোহিত মৈত্রের মৃতদেহ বঙ্গোপসাগরের জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ইংরেজরা। যেমনটা আমরা আমাদের দেশের প্রকৃত বীর যোদ্ধা বা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাস ছুঁড়ে ফেলেছি আস্তাকুড়ে। আমরা ভুলে গেছি তাদের অবদান ও আত্মত্যাগকে। হয়তো সেদিন ইংরেজ কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলে, বা প্রধানমন্ত্রীর আসনের লোভ করলে, সাবধানি হয়ে স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক নেতা হলে মনে থাকতো!
বাঙালি চিরকাল আত্মবিস্তৃত জাতি। আমরা ভুলে গেছি হয়তো স্বাধীনতাটা অনেক রক্ত ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে এসেছিলো। এই দামাল ছেলেগুলির এই মহান আত্মত্যাগকে আজকের নব প্রজন্ম কতটা মূল্য দেয়!!! এই ঘটনার বিবরণ শৈলেশ দের “আমি সুভাষ বলছি”তে পাওয়া যায়।
যাই হোক, এই বিখ্যাত বিপ্লবী স্মরণে স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববাংলা থেকে আগত শরণার্থীদের মধ্য থেকেই জলপাইগুড়িতে একটি কলোনির নাম রাখা হয় “মোহিতনগর কলোনি”। এই বিপ্লবীর নামে এই এলাকায় বিদ্যালয় রেল স্টেশন রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মোহিত মোহন মৈত্র কিন্তু তার জীবদ্দশায় একবারের জন্য জলপাইগুড়িতে আসেননি। আন্দামানের সেলুলার জেলে মোহিত মোহন মৈত্রের পূর্ণাঙ্গ মূর্তি থাকলেও, মোহিতনগরে তার কোনরকম মূর্তি আজ পর্যন্ত গড়ে উঠলো না। আশা করি ভবিষ্যতে তার মূর্তি এখানে গড়ে উঠবে। এই সকল ইতিহাস পাঠ্যবইতে স্থান পাবে।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার : ময়ুখ রঞ্জন ঘোষ।